ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৬০): আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর খায়বার অভিযানের প্রভাব
ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানের যেকোনো অভিযানের পর বাগদাদের সাদ্দাম সরকারের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকরা তীব্র মনোকষ্টে ভুগত।
এসব দেশ ইরাককে এ যুদ্ধে সম্ভাব্য পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে বাগদাদের প্রতি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বাড়িয়ে দিত। ইরাকের সাদ্দাম সরকার কূটনৈতিক অঙ্গনে নিজেকে আরব সমাজের অংশ হিসেবে তুলে ধরে আরব দেশগুলোর সম্মিলিত শক্তিকে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের প্রয়াস পেত। বহু আরব দেশের শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল একইরকম।
এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইরান শক্তিশালী হয়ে ওঠে কিনা তা নিয়ে আরব শাসকদের মধ্যে ছিল চরম উৎকণ্ঠা। আর ইরান যদি ইরাকের অভ্যন্তরে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করত তাহলে আরব দেশগুলোর উৎকণ্ঠা বহুগুণে বেড়ে যেত। খায়বার অভিযান শেষ হওয়ার পর ১৯৮৪ সালের ১৫ মার্চ ইরাক সরকার ১৮টি আরব দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে বাগদাদে এক সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সম্মেলন থেকে সাদ্দাম সরকারের স্বার্থ রক্ষা করতে ইরানের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়।
খায়বার অভিযানের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ইরানের ইসলামি সরকার বিরোধী ‘পিপলস মুজাহেদিন’ নামক সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ইরাকের সহযোগিতায় নামার ঘোষণা দেয়। মাসুদ রাজাভির নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠী এ পর্যন্ত অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে ইরানের সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতা মিলিয়ে প্রায় ১৭ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ইরানি জনগণের সামনে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে যাওয়ার পর গোষ্ঠীর নেতারা দেশ থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে আশ্রয় নেয়। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে ইরাকের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজ ফ্রান্স সফর করেন। তিনি প্যারিসে মোনাফেকিন গোষ্ঠীর নেতা মাসুদ রাজাভির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
তখন পর্যন্ত মোনাফেকিন গোষ্ঠী ইরানের ভেতরে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে সাদ্দামকে সরবরাহ করা এবং ইরানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর মধ্যেই নিজের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু রাজাভির সঙ্গে তারিক আজিজের সাক্ষাতের পর এই গোষ্ঠী তার আগের তৎপরতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একটি সামরিক বাহিনীও গঠন করে। মোনাফেকিন গোষ্ঠীর এই বাহিনীকে ইরাকে মোতায়েন করা হয় এবং বাহিনীর সদস্যরা ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকিদের অভিযানের সময় অগ্রবর্তী সৈন্য হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। খায়বার অভিযান শেষে প্রায় দেড় মাসের মতো ইরানের আবাসিক এলাকা ও শহরগুলোতে ইরাকি বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বন্ধ থাকে। কিন্তু ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকে যুদ্ধ আবাসিক এলাকাগুলোর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময়কার যুদ্ধ ‘শহর ও তেল ট্যাংকারের যুদ্ধ’ নামে বেশি পরিচিতি পায়।
১৯৮৪ সালের ২৩ এপ্রিল তিনটি ইরাকি যুদ্ধবিমান ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের ‘পিরানশাহর’ শহরের আবাসিক এলাকাগুলোর ওপর অগ্নিবোমা ‘নাপাম’ নিক্ষেপ করে। ওই হামলায় ৪০টি বাড়ি ধ্বংস, ১৭ ব্যক্তি নিহত ও ৪৪ জন আহত হন। ১৯৮৪ সালের ৫ জুন তিনটি ইরাকি যুদ্ধবিমান ইরানের ‘বানে’ শহরের রাজপথে বিক্ষোভরত সম্মিলিত জনতার ওপর গুচ্ছবোমা বর্ষণ করে। ফার্সি ১৩৪২ সালের ১৫ খোরদাদের ঘটনার স্মরণে অনুষ্ঠিত ওই বিক্ষোভ মিছিলে সেই হামলায় অন্তত ৩০০ মানুষ নিহত ও অপর ৩০০ জন আহত হন। এছাড়া, ইরানের ‘মসজিদ সোলায়মান’, ‘পশ্চিম গিলান’, ‘নাহাভান্দ’ ও ‘দেজফুল’ শহরে ইরাকি বাহিনীর হামলায় আরো বহু মানুষ হতাহত হন।
১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ইরাকি বাহিনী ইরানের ‘খার্ক’ দ্বীপের তেল স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা অব্যাহত রাখে। ইরানের তেল রপ্তানিতে বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে এ কাজ করা হয়। কিন্তু ১৯৮৪ সালের এপ্রিল থেকে ইরাকিরা ইরানের তেল রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে ইরাকি বিমান বাহিনী পারস্য উপসাগরে কাতারের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত হামলার পরিধি বিস্তৃত করে। এ সময় ফ্রান্স সরকার ইরাকি বাহিনীর হাতে পাঁচটি অত্যাধুনিক সুপার এটেনডার্ড জঙ্গিবিমান তুলে দেয়। এসব জঙ্গিবিমান চালানোর জন্য পাইলটও বাগদাদে পাঠায় প্যারিস। সেইসঙ্গে প্যারিসের কাছ থেকে বাগদাদ পায় ১০ লাখ ডলার মূল্যের নিখুঁত ‘এক্সোসেট’ ক্ষেপণাস্ত্র যা ইরাকি নৌবাহিনীর শক্তি বাড়িয়ে দেয়।
এসব সমরাস্ত্র বিক্রি করে ফ্রান্স আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভবান হয়। বলা হয়, ইরাক-ইরান যুদ্ধের আট বছরে ইরাকি বাহিনী ফ্রান্সের কাছ থেকে এক হাজার ২০০ এক্সোসেট ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করে। ইরানের খার্ক দ্বীপে ইরাকি বাহিনীর মুহুর্মুহু হামলায় ইরানের তেল রপ্তানিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হলেও এদেশের তেল রপ্তানি কখনো বন্ধ হয়নি। এদিকে রামেজান, ওয়ালফাজ্র ও খায়বারের মতো বড় অভিযানে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পুরোপুরি অর্জিত না হওয়ায় ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা ইরাকিদের বিরুদ্ধে ছোটখাট গেরিলা হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ কাজে ইরাকে সাদ্দাম সরকারের দমন অভিযান থেকে বাঁচতে ইরানে আশ্রয় গ্রহণকারী ইরাকি নাগরিকদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৮৪ সালে জুন মাসে অর্থাৎ হিজরি পবিত্র রমজান মাসে ইরানের সেনাবাহিনীতে রমজান নামের একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ইরাকি মুজাহিদদের নিয়ে গঠন করা হয় ইমাম সাদেক (আ.) নামের একটি ব্রিগেড। পরবর্তীতে ইরাকের সাদ্দাম বিরোধী ইরাকি মুজাহিদদের নিয়ে আগেই গঠিন বাদ্র ফোর্সের সঙ্গে এই ব্রিগেডকে একীভূত করা হয়। আর এই বাদর ফোর্সের কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় ইসমাইল দাগায়েগিকে যিনি পরবর্তীতে ইরাক-ইরান যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান।
মূলত ইরাকের উত্তরাঞ্চলে দেশটির আগ্রাসী বাহিনীর রণপ্রস্তুতি সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়ার জন্য রামেজান ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়। ক্যাম্পটি ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে ছোট ছোট অভিযান পরিচালনা করে যুদ্ধকে আবার ইরাকের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এই ক্যাম্পের পক্ষ থেকে সুসংগঠিত একটি শাহাদাতপিয়সী বাহিনীকে ইরাকের ভেতরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই বাহিনী সন্তর্পনে ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের সোলায়মানিয়া শহরের আশপাশের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। এদিকে রমজান ক্যাম্পের যোদ্ধারা ইরাকের অপর শহর কিরকুকের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
ইরানের বাদ্র ফোর্সে যে শুধু ইরাক থেকে পালিয়ে আসা লোকজনই যোগ দিয়েছিল তাই নয় বরং ইরাকি বন্দিদের মধ্যে যারা সাদ্দাম বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে বাগদাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের তিন হাজার সেনাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদের অনেকে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শাহাদাতবরণ করেন। এদিকে রামেজান ক্যাম্পের গেরিলা অভিযানের একই সময়ে ইরাকিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফ্রন্টে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করার জন্যও ইরানের সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি চলতে থাকে।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।