মে ০৮, ২০২১ ১৭:৫৯ Asia/Dhaka

বদর অভিযানে ইরান সাফল্য লাভ করার পর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ইরাকের পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইরাককে শুধুমাত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা করে ইরানের অগ্রগতি রোধ করা যাবে না।

ইরানি যোদ্ধারা ঈমানি চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন বলে তারা সামান্য অস্ত্রসস্ত্র নিয়েই শত্রুর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন। কিন্তু ইরাকিদের মধ্যে সে চেতনার অভাব থাকার কারণে তারা সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র দিয়েও যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন কোনো সাফল্য পাচ্ছিল না। এ অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে পেরে না উঠে ইরাকের সাদ্দাম সরকার ইরানের বিভিন্ন শহরে ব্যাপকহারে বোমাবর্ষণ ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে শুরু করে। বাগদাদের পরিকল্পনা ছিল এই যে, এসব হামলায় ব্যাপকহারে বেসামরিক ইরানি নাগরিক নিহত হতে শুরু করলে ইরানের জনগণই তাদের সরকারের প্রতি ক্ষিপ্ত হবে এবং তারা যেকোনো উপায়ে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।

কিন্তু ইরাকের ওই ঘৃণিত পদক্ষেপের ফল হয় উল্টো। ইরানি জনগণ ১৯৮৫ সালে এক গণভোটে অংশ নিয়ে যুদ্ধের ব্যাপারে ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.)’র সিদ্ধান্তের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা করেন। তারা বলেন, যুদ্ধের ব্যাপারে ইমাম যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটিই চূড়ান্ত এবং এ ব্যাপারে জনগণের আর কোনো বক্তব্য থাকবে না।   

ওদিকে ইরাকের সাদ্দাম সরকার যখন ইরানের বেসামরিক অবস্থানে এবং পারস্য উপসাগরের তেল ট্যাংকারগুলোতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল তখন বাগদাদের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সামকির সহযোগিতা আরো বেড়ে যায়। কথিত শান্তি ও মানবাধিকারের রক্ষক এসব পশ্চিমা দেশ ইরাক সরকারের অপরাধযজ্ঞের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে। তারা উল্টো সাদ্দামকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে এবং বাগদাদের হাতে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র পর্যন্ত তুলে দেয়।

ফ্রান্স সরকার ইরাকের হাতে যেসব মিরেজ জঙ্গিবিমান দিয়েছিল তার একটি

ইরাক-ইরান যুদ্ধের শুরু থেকে যেসব দেশ বাগদাদের সমরাস্ত্রের চাহিদা পূরণ করেছে সেগুলোর মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। ১৯৮৩ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে এই সাহায্যের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে ইরানে বোমাবর্ষণ করার জন্য ফ্রান্স সরকার ইরাকের হাতে যেসব মিরেজ জঙ্গিবিমান তুলে দিয়েছিল সেগুলো ১৯৮৮ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ইরাক ব্যবহার করে। ফ্রান্সের সমরাস্ত্র পেয়ে ইরাকি বাহিনী তাদের দেশ থেকে প্রায় এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হরমুজ প্রণালিতে পর্যন্ত অভিযান চালানোর সাহস পায়। বিশেষ করে ইরাকের টার্গেট ছিল ইরানের তেল ট্যাংকারগুলোর যাতায়ত স্তব্ধ করে দিয়ে এদেশের রপ্তানি আয়ে ধস নামানো।

ইরাকি বাহিনী যুদ্ধের শেষ চার বছরে পারস্য উপসাগরে ইরানের বিভিন্ন রকমের জাহাজে হামলা জোরদার করে। ফলে ওই উপসাগরে ইরান ও ইরাকের মধ্যে ‘তেল ট্যাংকারের যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যায়। সাদ্দাম বাহিনী একইসঙ্গে ফ্রান্সের অত্যাধুনিক মিরেজ জঙ্গিবিমান ব্যবহার করে ইরানের ‘ফজর জাম’ গ্যাস শোধনাগারে হামলা চালায়। পাশাপাশি ফ্রান্স তার সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রাডার ব্যবস্থা ইরাকের সাদ্দাম সরকারের হাতে তুলে দেয়। এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে ইরাকি বাহিনী তাদের অবস্থানগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া ইরানি পদাতিক বাহিনীর গতিবিধি আগেভাগে টের পেয়ে যায়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফাঁস হয়ে পড়া কাগজপত্র থেকে জানা যায়, ফরাসি শাসকরা এসব সমরাস্ত্র সাদ্দামের হাতে তুলে দেয়ার বিনিময়ে বাগদাদের কাছ থেকে বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

ফ্রান্স সরকার শুধুমাত্র যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে ইরাকের কাছ থেকে সমরাস্ত্র বিক্রি বাবদ এক হাজার ১০০ কোটি ডলার অর্থ হাতিয়ে নেয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও সাদ্দাম সরকার সমরাস্ত্র লাভ করে এবং এসব দেশের সাহায্যে ইরাক তার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়। ফরাসিরা এমন সময় সাদ্দামকে সহযোগিতা করছিল যখন এ যুদ্ধের দায়ী পক্ষ কে- তা তাদের জানা ছিল এবং তারা জানত যে, ইরাক ইরানের ওপর আগ্রাসন চালানোর কারণে এ যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

ইরাকের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জ্যাক শিরাক ১৯৮৬ সালের ৩০ নভেম্বর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সাদ্দামই ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিল। শিরাক বলেন, ইরাক ইরানে হামলা শুরু করার কয়েকদিন আগেই তিনি বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন এবং এ হামলা না চালানোর জন্য সাদ্দামের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। জ্যাক শিরাক আরো বলেন, তার আহ্বানের জবাবে ইরাকি শাসক সাদ্দাম তাকে জানান, ইরানের সেনাবাহিনী বিপ্লবের পর যুদ্ধ করার মনোবল সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে এবং সেদেশের সংখ্যালঘু আরব জনগোষ্ঠী বিদ্রোহ করেছে। কাজেই ইরাকি বাহিনী ইরানে হামলা চালালে ইরানি জনগণ তাদেরকে স্বাগত জানাবে এবং এক সপ্তাহের মধ্যে গোটা ইরান ইরাকের দখলে চলে আসবে।

ফ্রান্সের পরলোকগত সাবেক প্রধানমন্ত্রী জ্যাক শিরাক আরো বলেন, অথচ এই যুদ্ধ শুরুর ছয় বছরের মাথায় ইরান সরকারের অবস্থান অতীতের চেয়ে শক্তিশালী হয়। লেবাননে অপহৃত কিছু ফরাসি নাগরিককে ইরানের সহযোগিতায় মুক্ত করার পর শিরাক এই গোপন তথ্য ফাঁস করেন। কাজেই দেখা যাচ্ছে, ফ্রান্স সরকার ইরাক-ইরান যুদ্ধের আগ্রাসী শক্তিকে সম্পূর্ণ শনাক্ত করার পরও সেই বাগদাদ সরকারকে সর্বাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করেছে।  ফ্রান্স সরকার যুদ্ধের সময় ইরাকের নৌশক্তিকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান, বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হাতে পাওয়ার পর ইরাকের নৌশক্তি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যায়। দেশটির আগ্রাসী বাহিনী আগের চেয়ে অনেক সহজে ইরানি জাহাজে হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করে।

১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে ইরানের তেলবাহী ট্যাংকারগুলোতে ইরাকের হামলা ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। হামলার কারণে ইরানি তেলের ক্রেতারা এদেশের খার্ক বন্দরে এসে তেল সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকে। সে সময় খার্ক বন্দর থেকেই ইরানের বেশিরভাগ তেল রপ্তানি হতো। ইরাকি হামলা বেড়ে যাওয়ায় ইরান যুদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলো থেকে দূরে একটি তেল টার্মিনাল স্থাপন করতে বাধ্য হয়। ইরানি তেল ট্যাংকারগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খার্ক থেকে তেল বহন করে ওই টার্মিনালে পৌঁছে দিত এবং সেখান থেকে বিদেশি জাহাজগুলো ইরানি তেল কিনে নিয়ে যেত। এ কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে ইরান ২২টি নতুন তেল ট্যাংকার কিনতে বাধ্য হয়। এর ফলে তখন পর্যন্ত ইরানের তেল ট্যাংকারগুলোর তেল বহন সক্ষমতা ১০ লাখ টন থাকলেও নতুন তেল ট্যাংকারগুলো কেনার ফলে সে সক্ষমতা ৬০ লাখ টনে উন্নীত হয়।  এদিকে পারস্য উপসাগরে ইরাকের এই অমানবিক হামলার জবাবে ইরান ঘোষণা করে, যদি ইরানি তেল ট্যাংকারের নিরাপত্তা না থাকে তাহলে পারস্য উপসাগরে অন্য দেশগুলোর ট্যাংকারগুলিরও নিরাপত্তা থাকবে না। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।