ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৬৬): সাদ্দামকে পাশ্চাত্যের ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতা
ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখে পাশ্চাত্য।
তারপরও ইরান চরম সীমাবদ্ধতা নিয়ে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান চালায়। ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করে রাখার একই সময়ে পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরাকের সাদ্দাম সরকারের হাতে সর্বাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম তুলে দেয়। যুদ্ধের প্রথম কয়েক বছরে ইরাকিরা পারস্য উপসাগরে ইরানের তেল রপ্তানির দু’টি বন্দর আল-বাকর ও আলামিয়ে’তে হামলা চালায়। ইরানের তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া ছিল সাদ্দামের এ কাজের উদ্দেশ্য। সে সময় পারস্য উপসাগরে ইরানের তেমন কোনো তেল স্থাপনা ছিল না। কিন্তু যে কয়েকটি ছিল সেগুলোর ওপর ইরাকিদের অব্যাহত হামলা চেয়ে চেয়ে দেখা ইরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ কারণে নিজের ক্ষয়ক্ষতি প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইরাকের কিছু লক্ষ্যবস্তুতে প্রতিরক্ষামূলক হামলা চালাতে বাধ্য হয় ইরান।
পাশাপাশি ইরান কিছু বীমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় যার ভিত্তিতে ইরাকি হামলায় ইরানের তেল বহনকারী কোনো জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই কোম্পানি সঙ্গে সঙ্গে সেই জাহাজ উদ্ধার করে দিতে সম্মত হয়। সেইসঙ্গে ইরাকের হামলা থেকে তেল রপ্তানি প্রক্রিয়াকে রক্ষা করার জন্য ইরান নিজের রপ্তানি বন্দরকে খার্ক দ্বীপ থেকে সরিয়ে হরমুজ প্রণালির লার্ক দ্বীপে স্থানান্তর করে। পাশাপাশি ইরান আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু বাতিল জাহাজকে সাগরে ছড়িয়ে রেখে দেয়। এসব জাহাজে এমন কিছু ব্যবস্থা স্থাপন করা হয় যাতে ইরাকি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র এসব জাহাজে আঘাত হানে। ফলে তেল বহনকারী আসল জাহাজগুলো সাগরে নিরাপদে চলাচল করতে সক্ষম হয়।
এদিকে ইরান রাজনৈতিক দিক দিয়ে এই ঘোষণা দেয় যে, ইরাক যদি পারস্য উপসাগরকে অনিরাপদ করে তোলে তবে এই অঞ্চল অন্য কোনো দেশের জন্যও নিরাপদ থাকবে না। তেহরান আরো ঘোষণা করে, ইরানের তেল রপ্তানি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে হরমুজ প্রণালি দিয়ে আর কোনো দেশের তেল রপ্তানি হবে না। অবশ্য ইরান কখনোই এই হুমকি বাস্তবায়িত করেনি। তবে ইরানের নৌবাহিনী সব সময় পারস্য উপসাগর দিয়ে নিরাপদে জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছে। এ সময় ইরানের তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর ইরাকিদের হামলা অব্যাহত থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান পারস্য উপসাগর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজগুলোতে তল্লাশি চালানো শুরু করে। কোনো জাহাজে করে কেউ যাতে ইরাককে সমরাস্ত্র সরবরাহ করতে এবং পারস্য উপসাগর দিয়ে যাতে ইরাকের তেল রপ্তানি হতে না পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা নেয় ইরান।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত পারস্য উপসাগরে ইরানের পক্ষ থেকে বিদেশি জাহাজগুলোর ওপর চল্লাশি অব্যাহত থাকে। পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এবং তেল ট্যাংকারগুলো হামলার শিকার হলে ইরানের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হতো বলে তেহরান এই সাগরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। কিন্তু খার্ক দ্বীপসহ ইরানের তেল কূপগুলোতে ইরাকি বাহিনীর হামলা অব্যাহত থাকায় তেহরানও একই ধরনের পাল্টা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। ইরাক ও ইরানের মধ্যকার যুদ্ধে এক সময় সৌদি আরব প্রকাশ্যে জড়িয়ে যায়। ১৯৮৫ সালের ১৯ মে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী তেহরান সফরে আসেন।
এ সময় ইরানের তৎকালীন পার্লামেন্ট স্পিকার আকবর হাশেমি রাফজানজানি আগ্রাসী ইরাক সরকারকে সাহায্য করোর জন্য রিয়াদের তীব্র সমালোচনা করেন। তার বক্তব্যের জবাবে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, ইরাকের মাটিতে ইরান হামলা চালানোর পর থেকে রিয়াদ বাগদাদের প্রতি সামরিক সহযোগিতা দিতে শুরু করেছে। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স সৌদ আল-ফয়সাল ইরানকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবের জবাবে ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার বলেন, যদি আপনারা এ যুদ্ধের আগ্রাসী শক্তি হিসেবে ইরাককে চিহ্নিত করতে এবং এই ভয়াবহ অপরাধ করার কারণে তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারেন তবে তেহরান যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে রাজি রয়েছে। কিন্তু রিয়াদ ইরানের এ প্রস্তাব মেনে নেয়নি।
১৯৮৫ সালে ওয়ালফাজর অভিযান শুরু হওয়ার এবং কৌশলগত ফাও বন্দর দখল করার আগে ইরাকের সামরিক সক্ষমতা অতীতের তুলনায় আরো শক্তিশালী হয়। ওই বছর ইরাক সরকার তার বার্ষিক জিডিপির প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার খরচ করে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও আমেরিকার কাছ থেকে শত শত জঙ্গিবিমান আমদানি করে সাদ্দাম সরকার। এর ফলে ইরাকের জঙ্গিবিমানের সংখ্যা প্রায় ৬০০তে উন্নীত হয়। ফ্রান্স সরকার তার অত্যাধুনিক মিরেজ জঙ্গিবিমানের সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য ফরাসি পাইলটও পাঠিয়ে দেয়। ফলে বিমান বাহিনীর সক্ষমতার দিক দিয়ে ইরাকের শক্তি ইরানের প্রায় চারগুণ হয়ে যায়। ইরাক সরকারকে যে এসব সামরিক সরঞ্জামের সবই নিজের অর্থ খরচ করে কিনতে হয়েছে তা নয়; বরং সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো বাগদাদকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়ে সাহায্য করে।
এদিকে, ইউরোপীয় দেশগুলিও বাগদাদের প্রতি সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে দেয়। জার্মানি সাদ্দাম সরকারের হাতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র তুলে দেয়। অস্ট্রিয়া ইরাককে এমন কিছু অত্যাধুনিক কামান সরবরাহ করে যা দিয়ে ৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা সম্ভব। এসব সামরিক সহযোগিতা নিয়ে ইরাকি বাহিনী পারস্য উপসাগরের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বিশেষ করে ইরানের খার্ক বন্দরের তেল স্থাপনায় হামলা বৃদ্ধি করে। সেইসঙ্গে ইরানের সাধারণ জনগণকে তেহরানের প্রতি ক্ষেপিয়ে তোলার লক্ষ্যে ইরাকিরা ইরানের আবাসিক এলাকাগুলোর ওপরও হামলা চালিয়ে যায়। যুদ্ধের এ পর্যায়ে ইরাকের সামরিক শক্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে বাগদাদের পক্ষে ইরানের আরো গভীরে হামলা চালানোর সুযোগ তৈরি হয়। পাশাপাশি ইরাকি বাহিনী ইরানের বিভিন্ন অর্থনৈতিক স্থাপনার ওপরও হামলা চালাতে থাকে।
যুদ্ধের পঞ্চম বছরেও ইরাকের প্রতি মার্কিন সরকারের গোয়েন্দা সহযোগিতা অব্যাহত থাকে। আমেরিকা ইরানের সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে তার স্যাটেলাইট ও গোয়েন্দা বিমানগুলোর সাহায্যে গৃহিত তথ্য বাগদাদের হাতে তুলে দেয়। সেইসঙ্গে ইরাককে কৃষি সহায়তার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ বাগদাদের হাতে তুলে দেয় ওয়াশিংটন। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে ইরানি যোদ্ধারা অসীম সাহসিকতা নিয়ে ওয়ালফাজর-৮ অভিযান পরিচালনা করেন। ইরাক যখন সামরিক শক্তির দিকে দিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছিল তখন ইরানি যোদ্ধারা বাগদাদকে তাদের সামরিক সক্ষমতা প্রদর্শন করেন।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।