জুন ১৫, ২০২১ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

কবি হাফিজকে নিয়ে আমরা কথা বলেছি গত আসরে। আজকের আসরে আমরা এখানকার আরেক জগদ্বিখ্যাত কবি সাদি'কে নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।

শিরাজ শহরের উত্তর - পূর্বে কবি সাদীর স্মৃতিস্তম্ভটি অবস্থিত । বর্তমান স্মৃতিস্তম্ভটি বানানো হয়েছে ১৯৫২ সালে । কবি হাফিজের মাযারের মতো সাদীর মাযারটিও চমৎকার একটা বাগানের ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে। খুবই সাদামাটা করে তৈরী করা হয়েছে এই স্তম্ভটি। ইরাক এবং সিরিয়া সফরকালে ক্রুসেডারদের হাতে বন্দী জীবনযাপন শেষে কবি সাদী শিরাজে ফিরে আসেন । শিরাজে ফিরে এসেই তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যকর্মগুলো সৃষ্টি করেন। গুলেস্তান এবং বুস্তান তার শ্রেষ্ঠ কাব্যের অন্যতম ।

তাঁর এসব কাব্যে রয়েছে মানুষের নৈতিক চরিত্র উন্নত করার অমূল্য বাণী। এই কাব্যগ্রন্থগুলো বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। আজো বিভিন্ন দেশের বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এসব গ্রন্থ পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত । পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত তাঁর মাজার স্তম্ভের কাছে দাঁড়ালে আধ্যাত্মিক এক আমেজে মন ভরে যায়। কতো কথা , কতো স্মৃতি ভেসে ওঠে ভক্তদের মনে-তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চলুন এবারে এই মহা মনীষীর জীবনী নিয়ে খানিকটা কথা বলা যাক ।কবি সা'দীর পুরো নাম হলো মোশাররফ উদ্দীন মোসলেহ ইবনে আব্দুল্লাহ সা'দী । তিনি হিজরী ৬০৬ সালে শিরাজে জন্মগ্রহণ করেন। সাদীর পরিবার ছিল দ্বীনি পরিবার। তাঁর বাবা ছিলেন সমাজে যথেষ্ঠ সম্মানিত। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো বাল্যকালেই তিনি তাঁর বাবাকে হারান।

বাবার মৃত্যুর পর সাদী পড়ালেখার জন্যে শিরাজেই মাসউদ ইবনে মোসলেহ এর কাছে যান। তিনি ছিলেন তাঁর সমকালে মস্ত জ্ঞানী ব্যক্তি। শিরাজেই তিনি ধর্মীয় ও সাহিত্য বিষয়ক প্রাথমিক পাঠ সমাপ্ত করেন। তারপর তিনি পড়ালেখার উদ্দেশে বাগদাদে যান। আর এই বাগদাদ সফর তার পরবর্তী অন্যান্য দীর্ঘ সফরের সূচনা করেছিলো। ৬২০ হিজরীতে কবি সাদী বাগদাদে যান। সেখানে নেজামিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। তৎকালীন সময়ের বিদগ্ধজনদের সাথে অর্থাৎ সে সময়কার খ্যাতিমান মনীষীদের সাথে তাঁর দেখা সাক্ষাৎ হয়। মোল্লা নূরউদ্দীন আবাদুর রহমান জামী এ প্রসঙ্গে বলেছেন - সাদী তৎকালীন বড়ো বড়ো ব্যক্তিত্বের সাহচর্য পেয়েছেন। এমনকি আল্লামা শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর সাথেও তাঁর পরিচয় হয়। সোহরাওয়ার্দীর সাথে কবি সাদী একই নৌকায় সমুদ্র ভ্রমণও করেছেন।

যাই হোক , বাগদাদের নেজামিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা শেষ করার পর কবি সাদী দীর্ঘ সফরে যান। বর্তমান যুগে তো বিভিন্ন ধরণের যানবাহন এমনকি বিমান থাকায় বিশ্বভ্রমণ বেশ সহজ হয়ে গেছে। সাদীর সময়কালে যানবাহন বর্তমান যুগের মতো এতো আধুনিক বা এতো উন্নত ছিলোনা। তিনি সে সময়কার যানবাহন ব্যবহার করেই সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক থেকে অগ্রসর তৎকালীন বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। ইরান সাহিত্যের ইতিহাস তৃতীয় খণ্ডে উল্লেখ করা হয়েছে যে , কবি সাদী রোম বা বর্তমান ইতালী , হেজাজ বা বর্তমান সৌদি-আরব , শাম বা বর্তমান সিরিয়া , হিন্দুস্তান বা ভারতের সোমনাথ , মিশর , চীনের কাশগড় প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ৬২১ হিজরীতে শিরাজ থেকে তিনি তাঁর সফর শুরু করেন এবং ৬৫৫ হিজরী পর্যন্ত সফর অব্যাহত রাখেন। এ বছরই তিনি শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেন এবং লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।

পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ সফর করে বিচিত্র জাতি , সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে জগত - জীবন আর মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার বোঝা কাঁধে নিয়ে কবি সাদী শিরাজে ফেরেন। আর তাঁর লেখনীতে সেইসব অভিজ্ঞতার শৈল্পিক সঞ্চার ঘটিয়ে বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন ।সাদী বহুবার পায়ে হেঁটে হজ্জ্ব করতে গেছেন। তিনি জেহাদের উদ্দেশে রোম এবং হিন্দুস্তানে গেছেন। এতো ভ্রমণ , এতো পর্যটনের পরও সাদী কিন্তু ক্লান্ত বোধ করতেন না , বরং উজ্জীবিত হতেন। তাঁর বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ গুলেস্তাঁ এবং বোস্তাঁ এই দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতারই নান্দনিক ফলাফল। কবি শেখ সাদীর মাজার কমপ্লেক্সে গেলে তাঁর এই কষ্টকর অথচ ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু জীবনের কথা আপনাদের মনে পড়ে যাবে। তারপরও সেখানকার সবুজ-শ্যামল বাগিচা ঘেরা মনোরম পরিবেশ আপনাকে কিছুটা ভাবাবেগে আপ্লুত করে তুলবে। তাঁর মাযার বা সমাধি স্থাপত্যটি খুবই সাদামাটা করে নির্মিত হয়েছে।

১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে তাঁর বর্তমান সমাধি স্তম্ভটি নির্মিত হয়েছে। সমাধিটি শিরাজের উত্তর-পূর্বে সবুজ বাগানের মাঝে অবস্থিত। ফলে কবির স্মৃতিময় জীবনের পাশাপাশি এক আধ্যাত্মিক আবহ তৈরী হয় সেখানে। বিশ্বব্যাপী যেই কবি শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন , যাঁর প্রসঙ্গে অন্য কবি বলেছেন , সাদীর লেখা যদি কবিতা হয় তাহলে আমাদের লেখাতো ছাইপাঁশ । অর্থাৎ তার সামনে নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিতে অন্যরা ভয় পেতেন । সেই কবি এখন শুয়ে আছেন পরম নিশ্চিন্তে সুনসান নীরব এক বাগিচায় । তাঁর নীরবতা আপনাকে কেবল ভাবিয়ে তুলবে । নিয়ে যাবে সুদূর অতীতের দিনগুলোতে , যখন কবি ছিলেন শত জঞ্জালের মাঝেও একাকী ভূবনচারী, নীরব লেখক।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ