জুন ১৫, ২০২১ ১৯:৩১ Asia/Dhaka

গত কয়েকটি আসরে আমরা বলেছি, ইরানি যোদ্ধারা ১৯৮৫ সালের শেষদিকে ওয়ালফাজর-৮ নামক সফল অভিযান চালিয়ে ইরাকের কৌশলগত উপত্যকা ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ‘ফাও’ দখল করেন।

ইরানের চালানো যে তিনটি অভিযান আট বছরের ইরান-ইরাক যুদ্ধে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে সেগুলো হচ্ছে- বায়তুল মুকাদ্দাস, কারবালা-৫ এবং ওয়ালফাজর-৮ অভিযান। কিন্তু অভিনবত্ব, কৌশল ও জটিলতার দিক দিয়ে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানকে অন্য সব অভিযানের চেয়ে এগিয়ে রাখতে হবে। যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ছোট-বড় নানা ধরনের অভিযানের সমন্বয়ে। এসব অভিযানের কোনো কোনোটি সফল হয় এবং কোনো কোনোটির নামের পেছনে ব্যর্থতা  বা পরাজয়ের গ্লানি জড়িয়ে থাকে।  আবার এসব আলাদা আলাদা অভিযান যেহেতু একটি বৃহৎ যুদ্ধের অংশ কাজেই এগুলোকে আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করার উপায় নেই।

গোটা যুদ্ধকে মূল্যায়ন করতে হলে এসব অভিযানের ধারাবাহিকতা মাথায় রেখে বিশ্লেষণ করতে হবে। আর তাহলেই গোটা যুদ্ধের জয় বা পরাজয় সম্পর্কে যে মূল্যায়নটি বেরিয়ে আসবে তা হবে সঠিক ও নির্ভুল। ইরানের ওপর ইরাকের আগ্রাসনের শুরু থেকে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত ইরানের বিজয়গুলো পরাজয়ের বৃত্ত থেকেই বেরিয়ে এসেছে। রমজান ও প্রাথমিক ওয়ালফাজর অভিযানে ইরান পরাজিত হওয়ার পর এদেশের যোদ্ধাদের মধ্যে বিজয়ী হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় এবং তারা হুরুল হুয়াইজা জলাশয় দখল করতে সক্ষম হন। খায়বার ও বদর অভিযানে ইরানের ব্যর্থতা ওয়ালফাজর-৮ ও কারবালা-৩ অভিযানে বড় ধরনের বিজয়ের পটভূমি তৈরি করে। কাজেই সার্বিক বিশ্লেষণে একথা বলা যায় যে, খায়বার ও বদর অভিযান যেমন পুরোপুরি ব্যর্থ ছিল না তেমনি ওই দুই অভিযানের অভিজ্ঞতা ছাড়া ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে এত বিশাল বিজয় অর্জন করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার।

খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার সফল অভিযান চালানোর পর হুরুল হুয়াইজা জলাভূমিতে ইরান খায়বার অভিযাান চালায়। অভিযানে সেখানকার ‘মাজনুন’ নামক দ্বীপ দখল করা সম্ভব হলেও কৌশলগত সবগুলো লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৮৫ সালে আরভান্দ নদী পেরিয়ে ইরাকের সর্বদক্ষিণের ভূখণ্ড ফাও দখলের অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা উদ্ভাবনি কৌশলের আশ্রয় নেন এবং তাতে সফলতা লাভ করেন।  এই অভিযানের সবচেয়ে অভিনব দিক ছিল প্রশস্ত ও খরস্রোতা আরভান্দ নদী পার করে হাজার হাজার সৈন্য এবং ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ ওপারে নিয়ে যাওয়া। তখন পর্যন্ত রণকৌশলের দিক দিয়ে এ বিষয়টি ছিল সমরবিদদের কাছে কিম্ভুতকিমাকার ও বিস্ময়কর।

আরভান্দ নদীর পানি মূলত চারদিকেই প্রবাহিত হয়- উত্তর থেকে দক্ষিণে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে এবং আড়াআড়িভাবে পূর্ব ও পশ্চিমে। ভাটার সময় এটির পানি দক্ষিণে প্রবাহিত হয় এবং কয়েক ঘণ্টা পরেই জোয়ারের সময় এটির প্রবল স্রোত উত্তরমুখে ধাবিত হয়। আর জোয়ারের সময় এটির প্রশস্ততা পূর্ব-পশ্চিমে বেড়ে যায় এবং ভাটার সময় দুই কূল থেকেই পানি কমে গিয়ে নদীর অনেক গভীরে চলে যায়। কাজেই এই নদীর পানি দিনের কোন সময় কেমন আচরণ করবে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা এবং সে অনুযায়ী যুদ্ধের কৌশল ঠিক করা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। অভিযানে ইরানের ১৪০ ব্যাটেলিয়ন পদাতিক সৈন্য এবং ১৬ ব্যাটেলিয়ন গোলন্দাজ ইউনিট অংশগ্রহণ করে এবং তাদেরকে আকাশ থেকে বিমান সহায়তা দেওয়া হয়। অভিযানে ইরাকের প্রায় ৫০ হাজার সেনা হতাহত এবং তাদের দুই হাজার ১০৫ সেনা ইরানের হাতে বন্দি হয়। অভিযানে ইরাকের পরাজয়ের ফলে যুদ্ধের সামরিক ভারসাম্য ইরানের পক্ষে চলে আসে।

ফাও উপত্যকা দখলের অভিযানে ইরানের বিজয়ের ফলে তৎকালীন সামরিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকাংশে ইরানের অনুকূলে বদলে যায় এবং যুদ্ধ সমাপ্তির প্রক্রিয়া আরো জটিল আকার ধারণ করে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই অভিযান সুদূরপ্রসারি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ইরান ফাও দ্বীপ দখল করার ফলে ইরানি যোদ্ধারা কুয়েত সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কুয়েতে তখন মার্কিন সেনা মোতায়েন ছিল বলে আমেরিকা বিষয়টিকে মধ্যপ্রাচ্যে তার অবৈধ স্বার্থ রক্ষার জন্য বিপজ্জনক ঠাহর করে। এ কারণে ওয়াশিংটন ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান ও উত্তর ইয়েমেন সফর করেন এবং এসব দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন। মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড মরফি ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

পাশাপাশি মার্কিন সরকার ঘোষণা করে, পারস্য উপসাগরে তার যুদ্ধজাহাজগুলো বিপদের মুখে পড়লে দেশটি সরাসরি অ্যাকশনে চলে যাবে। আমেরিকা কুয়েত উপকূলের নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে পারস্য উপসাগরের উত্তর অংশে চারটি রণতরী পাঠায়। এ সময় ইরাক-ইরান যুদ্ধের ব্যাপারে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে করণীয় ঠিক করার উদ্যোগ নেয় আমেরিকা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ পি. শুল্টজ বলেন, “ইরান ও ইরাকের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যে শলাপরামর্শ চলছে।” মার্কিন সরকার যুদ্ধের এ পর্যায়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রস্তাব পাস করে এবং তেলে দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়।

এদিকে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নও এ যুদ্ধের ব্যাপারে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে। শীর্ষস্থানীয় সোভিয়েত কূটনীতিক আন্দ্রেই গ্রোমিকো বলেন, “এ যুদ্ধের ব্যাপারে মস্কোর নীতি অপরিবর্তনীয়। যখন ইরাক ইরানের ভূমিতে অনুপ্রবেশ করেছিল তখন আমাদের যে নীতি ছিল এখন ইরাকের ভূমিতে ইরান অনুপ্রবেশ করার পরও আমাদের নীতি একই রয়েছে।” এ সময় সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এদওয়ার্দ শেভার্দনাদজে ইরাকে ছুটে যান। সোভিয়েত ইউনিয়ন সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে, যুদ্ধ বন্ধের জন্য সাদ্দামের পরিকল্পনার প্রতি মস্কো সমর্থন জানাচ্ছে।  এদিকে ১৯৮৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, ইরাক ও ইরানকে যার যার সৈন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তরেখার পেছনে সরিয়ে নিতে হবে এবং কঠোরভাবে যুদ্ধবিরতি পালন করতে হবে।

এমন সময় নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে সেনা সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হলো, যখন ইরান ইরাকের ফাও দ্বীপ দখল করেছে। অথচ এর আগে যতদিন ইরাকি সেনারা ইরানের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিল ততদিন এই নিরাপত্তা পরিষদ এ যুদ্ধের ব্যাপারে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করে আসছিল।  ইরাক সরকার তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের ৫৮২ নম্বর প্রস্তাবটি মেনে নিলেও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে, এ যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে আগে আগ্রাসী দেশ হিসেবে ইরাককে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ