সূরা ফুসসিলাত: আয়াত ১-৭ (পর্ব-১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা ফুসসিলাত নিয়ে আলোচনা শুরু করব। মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় ৫৪টি আয়াত রয়েছে। অন্যান্য মাক্কি সূরার মতো ফুসসিলাতেও আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনার মতো বিশ্বাসগত বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। প্রথমেই এই সূরার ১ থেকে ৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১-৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
حم (1) تَنْزِيلٌ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (2) كِتَابٌ فُصِّلَتْ آَيَاتُهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ (3) بَشِيرًا وَنَذِيرًا فَأَعْرَضَ أَكْثَرُهُمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ (4)
“হা-মিম।” (৪১:১)
“(এটি একটি কিতাব যা) অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”(৪১:২)
“এটি (এমন) এক কিতাব, যার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আরবি (ভাষায়) কুরআনরূপে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য।”(৪১:৩)
“(এই কিতাব) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই (এটি থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সুতরাং তারা (কুরআনের আহ্বান) শুনতে পায় না।” (৪১:৪)
পবিত্র কুরআনের মোট ২৯টি সূরা হুরুফে মুকাত্তায়াত দিয়ে শুরু হয়েছে। আগের অনেক সূরার তাফসিরে আমরা বলেছি, পরবর্তী আয়াতের বিষয়বস্তু অনুযায়ী এসব হরফের মাধ্যমে মহান আল্লাহর বিশালত্ব ও গরিমা বর্ণনা করা হয়। মহাপ্রজ্ঞাবান ও পরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হওয়া এই মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আয়াতগুলো এসব হরফেরই সমষ্টি। অথচ এসব হরফ একত্রিত করে কোনো মানুষের পক্ষে এরকম একটি আয়াতও সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, পবিত্র কুরআন কিতাব আকারে নাজিল হয়নি কিংবা রাসূলুল্লাহ (সা.)ও এটি লেখেননি; বরং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর কলব বা অন্তরে ওহী হিসেবে যা কিছু নাজিল হতো তিনি তা মানুষকে পড়ে শোনাতেন। এভাবেই এর নামকরণ হয়েছে কুরআন। এ ছাড়া, রাসূলের নির্দেশে চার ব্যক্তি তাঁর পবিত্র মুখ থেকে উচ্চারিত আয়াতগুলো লিখে রাখতেন। এ কারণে কুরআনের আরেক নাম কিতাব।
পবিত্র কুরআন শুদ্ধ ও সাবলিল আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে এবং যে কেউ সত্য জানতে চায় তার জন্য এই কিতাবের আয়াতগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট ও বোধগম্য। এই কুরআন মানুষকে সুসংবাদ দানের পাশাপাশি সতর্ককারী হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে। এই মহাগ্রন্থ মানুষকে একদিকে সৎ ও নেক কাজ করতে উৎসাহিত করে এবং অন্যদিকে মন্দ ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করে দেয়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ নবী-রাসূলদের পাশাপাশি আসমানি কিতাবসমূহের দাওয়াতের বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ধরনের মানুষ রিপুর তাড়না ও শয়তানের কুমন্ত্রণার কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। তারা যা খুশি তাই করতে বা বলতে পারে না।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কুরআন আল্লাহর বাণী; রাসূলের নিজস্ব বক্তব্য নয়। এই কিতাবের বক্তব্য মহান আল্লাহর অসীম দয়া ও ভালোবাসা থেকে উৎসারিত। নিঃসন্দেহে এই কুরআনের শিক্ষা বাস্তবায়ন করলে উন্নত লক্ষ্যপানে মানব সমাজের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধিত হবে।
২- মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছু পবিত্র কুরআনে নানা আঙ্গিকে খুলে খুলে বর্ণনা করা হয়েছে।
৩- পবিত্র কুরআন মানুষকে জ্ঞান, সচেতনতা ও আলো দান করে। যে কেউ সত্য উপলব্ধি করতে ও সঠিকভাবে জানতে চায় তার উচিত কুরআন অধ্যয়ন করা।
সূরা ফুসসিলাতের ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ وَفِي آَذَانِنَا وَقْرٌ وَمِنْ بَيْنِنَا وَبَيْنِكَ حِجَابٌ فَاعْمَلْ إِنَّنَا عَامِلُونَ (5)
“এবং ওরা বলে: তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহবান করছ, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর (কঠিন) আবরণে আচ্ছাদিত, আমাদের কর্ণে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে অন্তরাল। সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর এবং আমরাও আমাদের কাজ করে যাই।” (৪১:৫)
এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলের দাওয়াতের মোকাবিলায় মক্কার কাফেরদের প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: বিশ্বনবী (সা.) যখন তাদের সামনে কুরআনের বাণী তেলাওয়াত করেন তখন তারা তা না শুনে উল্টো রাসূলকে হতাশ করে দেয়ার জন্য বলে: হে মুহাম্মাদ! বৃথা চেষ্টা করো না। আমাদের কান বন্ধ হয়ে আছে এবং তোমার কথা আমরা শুনতে পাই না। যতটুকু শুনি তাও আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে না। মনে হয় যেন, তোমার আর আমাদের মধ্যে এমন কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে যা তোমার বাণীকে আমাদের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে বাধা দেয়। কাজেই তোমার দাওয়াতের বাণী শুনে আমাদের কাজ নেই। আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দাও আর তুমিও তোমার মতো থাকো।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পবিত্র কুরআনের আয়াত আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টিধারার সমতুল্য। বৃষ্টির পানি নরম মাটিতে পড়লে তা ভেতরে প্রবেশ করে মাটিকে উর্বর করে। কিন্তু পাথরের উপর পড়লে তা ভেতরে প্রবেশ তো করেই না, উল্টো বাইরের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। দাম্ভিক ও হঠকারী মানুষের অন্তরও কুরআনের আয়াতের সামনে এমন আচরণ করে।
২- ব্যক্তি যদি কুরআনের বাণী গ্রহণ করতে না চায় তাহলে তা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, আল্লাহর রাসূলের মুখ থেকে নিঃসৃত হলেও লাভ হয় না।
সূরা ফুসসিলাতের ৬ ও ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ وَوَيْلٌ لِلْمُشْرِكِينَ (6) الَّذِينَ لَا يُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ بِالْآَخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ (7)
“(হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন: আমি তোমাদের মত একজন মানুষ, (পার্থক্য এই যে) আমার প্রতি (এই) ওহী (নাজিল) হয় যে, তোমাদের মাবুদ কেবলমাত্র অদ্বিতীয় ইলাহ। অতএব তোমরা তাঁরই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তাঁরই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আর দুর্ভোগ মুশরিকদের জন্য—” (৪১:৬)
“যারা যাকাত প্রদান করে না এবং তারাই পরকালে অবিশ্বাসী।” (৪১:৭)
মক্কার মুশরিকদের দাম্ভিক বক্তব্যের জবাবে আল্লাহর রাসূল তাদেরকে বলেন: আমিও তোমাদের মতোই একজন মানুষ। আমি নিজেকে যেমন সৃষ্টিকর্তা দাবি করছি না তেমনি মানুষ হিসেবেও আমি তোমাদের চেয়ে উন্নত নই। আমি তোমাদের বংশেরই একজন সাধারণ মানুষ। তোমাদের সঙ্গে আমার একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে আমার অন্তরে এই মর্মে ওহী নাজিল হয় যে, আমি যেন শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকি এবং তোমাদেরকেও এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর দিকে আহ্বান করি। তোমরা জেনে রেখো, আমি জোর করে আমার বক্তব্য তোমাদের ওপর চাপিয়ে দেব না। আমি তোমাদেরকে সঠিক পথের দিশা দিচ্ছি এবং তোমাদেরকে মূর্তিপূজা পরিহার করে এক আল্লাহর ইবাদত করার দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। সেটা করলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।
এরপর মুশরিকদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলা হচ্ছে: শিরকের পথে অটল থাকলে তোমাদেরকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে। পরের আয়াতে মুশরিকদের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে কিয়ামতকে অস্বীকার করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে যাকাত না দেয়া অর্থাৎ অভাবী ও দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য না করা। এই আয়াতে পরিষ্কার করে দেয়া হচ্ছে যে, যারা দান করে না তারা প্রকারান্তরে কিয়ামতে বিশ্বাস করে না। মুখে তারা যতই আল্লাহর নাম উচ্চারণ করুক তাতে কিছু যায় আসে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন, তাদের নিজেদের দিকে নয়।
২- অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের প্রভাব মানুষের দৈনন্দিন প্রতিটি কাজে প্রকাশ পেতে হবে। এটি নিছক কোনো বিশ্বাস নয় বরং মানুষের গোটা জীবন পরিচালনার রোড ম্যাপ।
৩- মুমিন ব্যক্তি তৌহিদের পথে দৃঢ়ভাবে অটল থাকে। সে আল্লাহর পথে অবিচল থাকা ও পথভ্রষ্ট না হওয়ার জন্য সারাক্ষণ অতীত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে।
৪- ঈমান শুধু মুখে দাবি করার বিষয় নয়। কেউ যদি যাকাত না দেয় তাহলে বুঝতে হবে মুখে সে যতই ঈমানের দাবি করুক না কেন তার মধ্যে কুফর ও শিরক বিদ্যমান।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।