জুন ২৩, ২০২১ ২২:৪২ Asia/Dhaka

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর'র সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ চলমান করোনা বাস্তবতায় যথেস্ট নয়।

রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, কালো টাকা সাদা করা প্রসঙ্গে প্রচলিত আইন আছে কিন্তু এবার স্পষ্ট করে নতুন কিছু বলা না হলেও- অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কাউকে প্রশ্ন করা যাবে না এমনি একটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে যা বিতর্কিত। পরোক্ষভাবে বোঝা যায় এর মানে ঐ টাকা দুর্নীতিজাত। 

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের বাজেট পেশ করা হয়েছে। তো একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনার দৃষ্টিতে কেমন হয়েছে এবারের বাজেট?

ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: ধন্যবাদ আপনাকে। এবারের বাজেটটি গত বছরের চেয়ে একটু তো পার্থক্য হওয়ার দাবিদার ছিল। কারণ গতবছরের যে বাজেট; যেটি এখনও চলমান আছে সেটিও কিন্তু একটি করোনাকালেরই বাজেট ছিল। তখন বলা হয়েছিল কিভাবে করোনা মোকাবেলা করা হবে তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি, বরাদ্দ ইত্যাদি থাকতে হবে। কিন্তু চলমান সেই  বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে সামান্য কিছু পয়সা বেশি দেয়া হয়েছিল আর একটা থোক বরাদ্দের কথা ছিল। এছাড়া আর সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। অর্থাৎ বাজেট দেখে মনে হয়েছিল কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল এই করোনা সাময়িক থাকবে তারপর করোনা চলে যাবে এবং সবকিছু স্বাভাবিক হবে। সেজন্য তাঁরা স্বাভাবিক বাজেট  করেছিলেন।

তবে এবার ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের বেলায় প্রায় সব পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে করোনা মহামারির প্রবল প্রকোপে জর্জরিত হয়ে প্রায় দেড় বছরের মতো কষ্টে আছে মানুষ এবং তাদের অর্থনীতি। সুতরাং মানুষ এবং অর্থনীতিকে উদ্ধার করে পরবর্তী অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, গতানুগতিক বাজেট হলে হবে না। একে  করোনা মোকাবেলা বান্ধব বাজেট হওয়া উচিত। জীবন ও জীবিকার বাজেট হওয়া উচিত। বিভিন্ন দিক থেকে এই কথাগুলো বলা হয়েছে। এখন প্রস্তাবিত বাজেটটি দেখে মনে হচ্ছে- করোনার বিষয়ে কিছুটা বিবেচনা সেখানে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আবার সেই বরাদ্দ বিভাজনের সময় গিয়ে দেখা যাচ্ছে সেই গতানুগতিকা রয়েছে। বিরাট একটা ব্যয়ের বাজেট এবং খাতওয়ারি বরাদ্দ বিভাজনে আগে যেমন ছিল এবারও তেমনই রয়েছে। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যখাতে এবারও একহাজার কোটি টাকার মতো সংখ্যায় বেশি দেখানো হয়েছে। থোক বরাদ্দটাও সেই আড়াই হাজার কোটি টাকা আছে। আলাদা করে টিকার জন্য কিছু টাকা রাখা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোনো জায়গায় করোনা মোকাবেলার বিষয় এ বাজেট বরাদ্দের মধ্যে নেই।

কর্মহীন মানুষ

বরং উল্টো কিছু হয়েছে। মনে করা হয়েছিল এবারের বাজেটটি হবে জীবন ও জীবিকার এবং কর্মসংস্থান সৃজনমূলক। খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে ইনফরমাল সেক্টরে যারা আছেন তাদেরকে সক্রিয় করার উপায় এবং সকলকে খাদ্য এবং স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করার জন্য যা যা দরকার তা থাকবে এই বাজেটে। কিন্তু বরাদ্দ বিভাজনের ভেতর এ ব্যাপারে খুব স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বলয়ে কিছু সংখ্যা বাড়ান হয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাতার পরিমাণ বাড়ান হয়েছে কিন্তু এখানেও কথা উঠবে তাদেরকে কিছু নগদ সহায়তা দিয়েই কি বসে থাকা হবে। প্রান্তিক মানুষদের কিছু নগদ সহায়তা দিলেই শুধু হবে না। এমনভাবে সহায়তা দিতে হবে যেন কাজ সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ কাজের বিনিময়ে খাদ্য- এ ধরণের হয়। কিন্তু এ ধরণের কর্মসূচি খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক বাজেটে কেবল ফিগার থাকে ও অর্থ আইনের ভেতর আইনগত বিষয়গুলো থাকে। সেগুলো পুরোপুরি না বুঝলে কিংবা বাস্তবায়নে না গেলে বোঝা যাবে না যে , যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার দ্বারা কি ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

রেডিও তেহরান: এ নিয়ে সরকার দ্বিতীয়বারের মতো করোনার ভেতরে বাজেট প্রণয়ন করল। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা কি চলমান বাস্তবতায় যথেষ্ট বলে আপনি মনে করেন?

করোনা

ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে চলমান বাস্তবতায় তাকে মোটেও যথেস্ট বলে মনে করি না। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষাখাতে সবসময় আমাদের বাজেট কম থাকে। গতবছরের বাজেটে করোনার কারণে কিছু টাকা বেশি দেয়া হয়েছিল, ছিল থোক বরাদ্দ কিন্তু এবছর এসে বাস্তবতার নিরীখে দেখা যায় যে সেই টাকা তারা খরচ করতে পারেন নি। অথবা যা খরচ করেছেন দেখা যাচ্ছে যে খরচ অনুযায়ী সম্পদ কিংবা সুযোগ সেবাবে সৃষ্টি কিংবা বৃদ্ধি হয় নি। তাছাড়া নানান ধরণের অভিযোগও উঠেছে। সুতরাং টাকা বরাদ্দ কম দিয়েছেন; আরেকটু বেশি দিলে ভালো হতো কি না একথা বলারও সময় এখনও আসেনি। কারণ আদৌ এই টাকা নিয়ম নিষ্ঠভাবে ব্যয় করতে পারবেন কি না?

রেডিও তেহরান: বাজেট প্রস্তাবনার পর অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল কালো টাকা সাদা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- এ টাকা তো অবৈধ পথে অর্জিত। তাহলে কেন তা বৈধ করার সুযোগ দেয়া হবে? এতে কী অন্যরা দুর্নীতি করতে কিংবা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনে উৎসাহিত হবেন না? 

ড.মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: দেখুন, এবারের বাজেট প্রস্তাবে কিন্তু কালো টাকা সাদা করার যে বিষয় সেটি কন্টিনিউ থাকবে বা নতুন করে হবে এরকম কথা বলা হয় নি।তবে আকার ইঙ্গিতে বোঝানো হয়েছে যে ইচ্ছে করলে আবার এ বিষয়টি তারা দিতে পারেন। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার এই বলে যে, আমাদের আইনের ভেতরে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের আইনগত সুযোগ বহুকাল আগে থেকেই যথারীতি আছে। চলতি অর্থবছরে যেটি নতুন করে হয়েছে সেটি হচ্ছে- তিনটি সুযোগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা যাবে।

একটি হচ্ছে- যার যা কর আছে সেটাই দেয়ার কথা কিন্তু এবার তারা বলেছেন শতকরা ১০ ভাগ হিসেবে দেয়া যাবে। এটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক উঠেছে। যারা সৎ ও নিয়মিত করদাতা তাদের জন্য অনুৎসাহিতমূলক। একইসাথে নতুন করদাতা আসার ক্ষেত্রে বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কর না দিয়ে  যদি পরে সহজে দেয়া যায় তাহলে আমি কেন কর দাতা হয়ে কঠিন শর্তের মধ্যে যাব।

দুই হচ্ছে- জরিমানার যে বিধানটা ছিল এবং আছে- সেটি নেই। মানে জরিমানা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

আর তৃতীয় যে ব্যত্যয়টি ঘটেছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছে যে কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না। এই প্রশ্ন করার বিষয়টিকে দুটো ভাগ করা দরকার। একটি হচ্ছে অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ হয় দুই কারণে-(১) পদ্ধতিগত কারণ- যেমন জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে অথচ দেখানো যায়নি ইত্যাদি। অর্থাৎ লেনদেন ঠিক আছে কিন্তু কিছু পদ্ধতিগত কারণে কিছু টাকা বাদ থাকে। এই অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ  নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টি খুব বেশি কঠিন ছিল না। কিন্তু যখন এবার বলা হলো এই টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, কেউ প্রশ্ন করবে না। আর তখনই প্রশ্ন এসে গেছে যে- কোন টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করলে তার সমস্যা হবে?

বাজেটে কালো টাকা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না

তাহলে পরেক্ষাভাবে বোঝা যাচ্ছে, এটা প্রকৃতপক্ষে কালো টাকা সাদা করার বিষয়।  যখন এই অপদর্শিত টাকা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দেব না কিংবা ব্যাখ্যা চাওয়া হবে না  তখন বোঝা যাচ্ছে এটি পুরোপুরি দুর্নীতির টাকা। এই দুর্নীতিজাত টাকা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না-একথাটি বলা মানে সংবিধানের ২০ এর ২ ধারায় পরিষ্কার বলা আছে রাষ্ট্র এমন একটি অবস্থান নিশ্চিত করবেন কেউ যেন দুর্নীতিজাত অর্থ ব্যবহার না করতে পারে।  অর্থাৎ পরোক্ষভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে বলা হয়েছে রাষ্ট্রকে। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সরকার প্রধান সবসময় বলে আসছেন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। অর্থাৎ দুর্নীতি হবে না। কিন্তু কালো টাকা সাদা করার সময় যদি কাউকে কোনো প্রশ্ন না করা হবে না একথা যদি বলা হয় তাহলে সেটি সম্পূর্ণ নৈতিকতাবিরোধী একটি বিষয়। এ বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। এই যে তিনটি কারণ- এটি বিতর্কিত। এটা যদি করা হয় তাহলে নৈতিকতা  এবং দুর্নীতি দমনের বিষয়ে সাংঘর্ষিক হবে। সংঘর্ষিক হবে-  যারা সৎ এবং নিয়মিত কর দিচ্ছেন তাদের সাথে কমহারে কর দেয়ার সুযোগটি। 

রেডিও তেহরান: তো জনাব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৩

ট্যাগ