আসমাউল হুসনা (পর্ব-৩৬)
বিশ্ব-জগতে আমাদের অবস্থানকে বুঝতে হলে তার আগে খানিকটা বুঝতে হবে মহান আল্লাহর নামগুলোর অর্থ ও তাৎপর্য।
মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম আল-আলিইয়্যু বা আলী। এর অর্থ সর্বোচ্চ বা সর্বশ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ'র চেয়ে শ্রেয় ও উচ্চতর কিছু থাকা অসম্ভব। এ নামটি পবিত্র কুরআনে মোট ৮ বার এসেছে। একবার এসেছে মহান আল্লাহর 'হাকিম' নামের সঙ্গে, দুই বার মহান আল্লাহর 'আলিম' নাম ও ৫ বার তাঁর 'কাবির' নামের সঙ্গে। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ) বলেছেন, 'মহান আল্লাহ নিজের জন্য অনেক নাম বাছাই করেছেন যাতে ওইসব নামে তাঁকে ডাকা হয়। আল্লাহকে ওইসব নামে ডাকা না হলে তিনি পরিচিতি লাভ করবেন না। মহান আল্লাহ নিজের জন্য প্রথম যে নাম বেছে নিয়েছেন তা হল আলীউল আযিম তথা সর্বোচ্চ মাত্রায় গৌরবান্বিত বা সবচেয়ে বড়। কারণ তিনি সর্বোত্তম বা সর্বশ্রেষ্ঠ'।
আলিইয়্যু শব্দের মূল হচ্ছে আলা/আলাও তথা উন্নততর, উচ্চতর ও শ্রেয়। মহান আল্লাহর 'আলী' নামও তাঁর আযিম নাম-এর মতই (তথা বড় বা মহীয়ান নাম) এই বাস্তবতা তুলে ধরে যে মানুষের কল্পনা সবচেয়ে বড় বা মহান হিসেবে যা কিছু ধারণা বা কল্পনা করতে পারে মহান আল্লাহ তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি বড়। মহান আল্লাহর সত্ত্বার স্বরূপ বোঝার সাধ্য কোনো মানুষের নেই। তবে এই দুই নামের পার্থক্য হল আজিম হচ্ছে এমন বড় বা শ্রেষ্ঠত্ব যে তার মোকাবেলায় মানুষ ও সমগ্র সৃষ্টিকুল অতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ। অন্যদিকে আলী নামের অর্থ তিনি এতই উচ্চ পর্যায়ের যে কোনো হৃদয় তা কল্পনাও করতে পারে না এবং কোনো পূর্ণতা ও শ্রেষ্ঠত্বই মহান আল্লাহ'র পূর্ণত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে তুলনারই যোগ্য নয়।
মহান আল্লাহ আলী নামের প্রকাশ ঘটিয়ে বান্দাহ বা সৃষ্টিকুলের ওপর নিজেকে তুলে ধরেন যাতে তাঁর সৃষ্টির মর্যাদাও বেড়ে যায়। তাঁর এই বান্দাহরা আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলেন এবং আল্লাহর প্রতি তাদের আত্মসমর্পণ, বিনম্রতা ও বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসা সীমাহীন হয়ে পড়ে। আর এ অবস্থায় তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই সম্মানিত ও বড় হিসেবে দেখতে পান না। এ ধরনের বান্দাহ প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অতি মহান উপাস্যের আশ্রয়ে দেখতে পান এবং মহান আল্লাহ তাঁর এই দাসদের দাসত্বের পর্যায়কে উন্নত করেন। মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)। তিনি মহান আল্লাহর এই নামের সর্বোচ্চ প্রতিচ্ছায়া। তাই নামাজের রুকুতে তিনি তিনবার বলতেন: সুবহানা রাব্বিয়াল আ'যিম ওয়া বিহামদিহি। এর অর্থ পবিত্র আমার অতি-উচ্চ মহান প্রতিপালক এবং আমি তাঁর প্রশংসা করছি। এরপর সিজদায় গিয়ে তিন বার তিনি বলতেন: সুবহানা রাব্বিয়াল আ'লা ওয়া বিহামদিহি। অর্থাৎ পবিত্র উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন আমার প্রভু এবং আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তাই মহানবীর (সা) উম্মত হিসেবে আমরাও নামাজের রুকু ও সিজদায় এই দুই বাক্য উচ্চারণ করে থাকি। নামাজের রুকুতে এইভাবে মহান আল্লাহর প্রতি আমরা সম্মান দেখিয়ে থাকে এবং মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে আমরা রুকুতে স্মরণ করি। মহান আল্লাহর অন্তহীন শ্রেষ্ঠ গৌরবের কাছে মাথা নুয়ে আমরা তাঁর মহত্বের ও শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়ে থাকি।
মহান আল্লাহর প্রতি সিজদার অর্থ হল আল্লাহর সামনে আমরা কেবলই নতজানু নই, একইসঙ্গে পুরোপুরি আত্মসমর্পিত। এ অবস্থায় বিনম্র ও ভীতি-বিহ্বল চিত্তে মহান আল্লাহর উচ্চতর নাম উচ্চারণ করে আমরা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেই। আর এ অবস্থা হচ্ছে মহান আল্লাহর ইবাদাতের সর্বোত্তম অবস্থা।
মহান আল্লাহ কখনও কখনও সর্বোত্তম প্রতিপালক হিসেবে নিজ দাসদেরকে কল্যাণের দিকে উৎসাহিত করেন যাতে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মর্যাদা পেতে পারে। সুরা লাইল-এর ১২ থেকে ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমার দায়িত্ব পথ প্রদর্শন করা আর আমি মালিক ইহকালের ও পরকালের। অতএব আমি তোমাদেরকে প্রজ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে। (১৬) যে মিথ্যা প্রতিপাদন করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়; (১৭) এবং অচিরেই সর্বাধিক সাবধানীকে তথা খোদা-সচেতনকে তা হতে দূরে রাখা হবে। (১৮) যে তার সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য (১৯) এবং আল্লাহর কাছে কেউই প্রতিদান লাভের কোনো অধিকার রাখে না আল্লাহর দেয়া সম্পদ অন্যকে দানের বিনিময়ে (২০) কেবল তার মহান প্রতিপালকের বা রাব্বিয়াল আ'লা'র সন্তুষ্টি কামনা ব্যতীত; (২১) কেবল এই ধরনের দানশীলরাই অতিসত্বর সন্তোষ লাভ করবে।
আলা বা আলাও বলতে কখনও বলদর্পিতা ও অহংকারকেও বোঝানো হয়। যেমন, ফিরআউন বলত: আনা রাব্বুকুমুল আ'লা- আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপালক বা উপাস্য।
ফিরআউন পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্বের খাহেশ রাখত বলেই বড় উপাস্য হবার দাবি করত। অথচ মহান আল্লাহ এমন লোকদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলেন যারা পৃথিবীতে আল্লাহর অবাধ্য হত না, কর্তৃত্বকামী ছিল না ও অশান্তি সৃষ্টি করত না। সুরা কাসাসের ৮৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,
এই পরকাল আমি তাদের জন্যে নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে আলীত্ব বা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না। খোদাসচেতনদের জন্যেই রয়েছে শুভ পরিণাম।
কেউ যদি সম্মান পেতে চায় তাহলে তার উচিত আল্লাহর মোকাবেলায় বিনম্র হওয়া। যে আল্লাহর মোকাবেলায় নতজানু হয় আল্লাহ তাকে মর্যাদা দান করেন বলে হাদিস রয়েছে। আর বিনম্রতা হচ্ছে দরিদ্রতম ব্যক্তিও যদি সত্য কথা বলে তা মেনে নেয়া। আর সত্য বা বাস্তবতাকে অস্বীকার করাই হচ্ছে অহংকার করা। মহান আল্লাহ সুরা বাক্বারার ২০৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,
আর যখন তাকে বলা হয় যে, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার অহংকার ও একগুঁয়েমি তাকে পাপ উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং তার জন্যে দোযখই যথেষ্ট। আর নিঃসন্দেহে তা হলো নিকৃষ্টতর ঠিকানা।
মহান আল্লাহর আলী নামের প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় হযরত মুসা নবীর (আ) মধ্যেও। তিনি ছিলেন মহান আল্লাহর বিনম্রতম দাসদের অন্যতম। তিনি প্রথমে প্রবল পরাক্রান্ত ফিরআউনকে সুপথে আনার মিশনে তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তাঁর ভয়কে সাহসে রূপান্তর করতে বললেন: ভয় পেয়ো না! তুমিই কর্তৃত্বশীল বা আলা। অর্থাৎ কেবল মুসাই ফিরআউনের ওপর বিজয়ী হতে সক্ষম। কারণ মহান আল্লাহর আলা বা শ্রেষ্ঠত্বের ছায়া পড়েছে তাঁর ওপর। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।