সূরা জুখরুফ : আয়াত ১-১০ (পর্ব-১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। মক্কায় অবতীর্ণ অন্যান্য সূরার মতো এই সূরাতেও আল্লাহ, পরকাল ও নবুওয়াতের মতো আকিদাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই সূরার প্রথম চার আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
حم ﴿١﴾ وَالْکِتَابِ الْمُبِینِ ﴿٢﴾ إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِیًّا لَعَلَّکُمْ تَعْقِلُونَ ﴿٣﴾ وَإِنَّهُ فِی أُمِّ الْکِتَابِ لَدَیْنَا لَعَلِیٌّ حَکِیمٌ ﴿٤﴾
“হা-মীম।”(৪৩:১)
“সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ।”(৪৩:২)
“নিশ্চয় আমি এটা অবতীর্ণ করেছি আরবি (ও সুস্পষ্ট) ভাষায় কুরআন রূপে, যাতে তোমরা (তা) উপলব্ধি করতে পার।”(৪৩:৩)
“আর নিশ্চয় তা উম্মুল কিতাবে আমার কাছে (সংরক্ষিত আছে), আর তা হল অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানে পূর্ণ।” (৪৩:৪)
পবিত্র কুরআনের সাতটি সূরা মুকাত্তায়াত হরফ ‘হা-মীম’ দিয়ে শুরু হয়েছে। বাকি ছয়টি সূরার মতো জুখরুফেও এই হরফগুলোর ঠিক পরপরই কুরআন নাজিলের কারণ হিসেবে মানবজাতির হেদায়েতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে হুরুফে মুকাত্তায়াতের পর পবিত্র কুরআনের শপথ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। এই কিতাবের বক্তব্য অত্যন্ত স্বচ্ছ ও পরিষ্কার এবং তা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে; মানুষকে সঠিক পথ ও সৌভাগ্য অর্জনের পন্থা দেখিয়ে দেয়।
এই কিতাব সর্বপ্রথম নাজিল হয় আরবি ভাষাভাষি মানুষের জন্য। তা সত্ত্বেও এই গ্রন্থ শুধুমাত্র আরব জাতির জন্য নাজিল হয়নি বরং এর বক্তব্য গোটা মানবজাতির জন্য বোধগম্য করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। তিনি সব মানুষকে এই কিতাবের আয়াতগুলো নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করার এবং অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে এর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ যেন ঈমান আনার পর এই কিতাবের গঠনমূলক শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করে সে আহ্বানও এখানে রয়েছে।
পবিত্র কুরআন মুহাম্মাদ (সা.) নামক একজন মানুষের রচিত বলে কেউ কেউ দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহর বাণী এবং এর মূল রহস্য আল্লাহর কাছে উম্মুল কিতাব বা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে উৎসারিত এই কিতাব থেকেই অতীতের সব আসমানি কিতাবের বাণী গৃহিত হয়েছে। পার্থিব ও পরকালীন জীবনে সৌভাগ্য অর্জনের প্রতিটি বিষয় এই মহাগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে এবং এই কিতাব সব ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বিকৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এতটা পবিত্রতার অধিকারী যে আল্লাহ তায়ালা এটির কসম খেয়েছেন।
২- চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করে আল্লাহর পথ বাছাই করতে হবে, কারো দেখাদেখি এটি করলে তা মানুষের অন্তরে স্থায়ী হয় না।
সূরা জুখরুফের ৫ খেকে ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَفَنَضْرِبُ عَنْکُمُ الذِّکْرَ صَفْحًا أَنْ کُنْتُمْ قَوْمًا مُسْرِفِینَ ﴿٥﴾ وَکَمْ أَرْسَلْنَا مِنْ نَبِیٍّ فِی الأوَّلِینَ ﴿٦﴾ وَمَا یَأْتِیهِمْ مِنْ نَبِیٍّ إِلا کَانُوا بِهِ یَسْتَهْزِئُونَ ﴿٧﴾ فَأَهْلَکْنَا أَشَدَّ مِنْهُمْ بَطْشًا وَمَضَى مَثَلُ الأوَّلِینَ ﴿٨﴾
“তোমরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায় বলে কি আমি তোমাদের নিকট হতে কুরআন প্রত্যাহার করে নেব?” (৪৩:৫)
“আর পূর্ববর্তীদের কাছে আমরা বহু নবী প্রেরণ করেছিলাম।” (৪৩:৬)
“তাদের কাছে এমন কোন নবী আসেনি যাকে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি।” (৪৩:৭)
“ফলে যারা এদের চেয়ে শক্তিতে প্রবল ছিল আমি তাদেরকে ধ্বংস করেছি এবং পূর্বের জাতিগুলোর ভাগ্য এভাবেই শেষ হয়েছিল। (৪৩:৮)
আল্লাহ তায়ালার একটি রীতি হচ্ছে তিনি মানুষকে হেদায়েত করার জন্য সৃষ্টির শুরু থেকে যুগে যুগে পৃথিবীতে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন এবং তাদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তবে প্রত্যেক নবীর যুগেই কিছু মানুষ ও সমাজের শাসক শ্রেণি নবীদের বিরোধিতা করেছে এবং নবীদের অপদস্থ করার জন্য তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপে মেতে উঠেছে। কখনো কখনো তারা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এই বিরোধিতা করেছে এবং নবীদের পাশাপাশি তাদের একনিষ্ঠ অনুসরণকারীদের হত্যা করতেও তারা পিছ-পা হয়নি। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালার রিসালাতের প্রক্রিয়া চালু ররেখেছেন এবং মানুষকে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেননি। অবশ্য বিরোধিতাকারী সেইসব মানুষের পরিণতি ছিল ধ্বংস এবং তাদের পরিণতি পরবর্তীদের জন্য শিক্ষা হয়ে রয়েছে।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- সামনে প্রতিবন্ধকতা আসলেই ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও ধর্ম প্রচারকরা দায়িত্ব পালন ছেড়ে দিতে পারবেন না। বিরোধীরা যতই ঠাট্ট-বিদ্রূপ ও অপমান-অপদস্থ করুক তাদেরকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
২- আল্লাহর শাস্তি শুধুমাত্র পরকালের জন্য নির্ধারিত নয় বরং পার্থিব জীবনেও কিছু শক্তিশালী দাম্ভিক জাতিকে তিনি দুনিয়াতেই সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
সূরা জুখরুফের ৯ খেকে ১০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ لَیَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِیزُ الْعَلِیمُ ﴿٩﴾ الَّذِی جَعَلَ لَکُمُ الأرْضَ مَهْدًا وَجَعَلَ لَکُمْ فِیهَا سُبُلا لَعَلَّکُمْ تَهْتَدُونَ ﴿١٠﴾
“আপনি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন: কে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে: এগুলো তো পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ (আল্লাহই) সৃষ্টি করেছেন।”(৪৩:৯)
“যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে বানিয়েছেন শয্যা এবং তাতে বানিয়েছেন তোমাদের চলার অনেক পথ, যাতে তোমরা সঠিক পথ পেতে পার।” (৪৩:১০)
এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: মূর্তিপূজক মুশরিকদের কাছেও যদি জিজ্ঞাসা করা হয় এই বিশ্বজগত কে সৃষ্টি করেছেন তাহলে তারা একবাক্যে বলবে: আল্লাহ তায়ালাই আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই মুশরিকরা বিশ্বজগত পরিচালনার কাজে আল্লাহর সঙ্গে বহু উপাস্যকে শরীক করে নেয়।
দৈনন্দিন নানা ব্যস্ততার কারণে বেশিরভাগ মানুষ সৃষ্টির শুরু এবং জগতের সমাপ্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না। তারা খাওয়া-পরা ও আনন্দ-ফুর্তি নিয়ে ব্যস্ত এবং এই কাজের জন্য অর্থ উপার্জনের চিন্তায় সারাক্ষণ মশগুল থাকে। অথচ এসব কিছু মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য নয় এবং এসব পার্থিব চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত সুখ অনুভব করে না।
এ ব্যাপারে মানুষকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে তাদেরকে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য সম্পর্কে অবগত করার জন্যই নবী-রাসূলগণ পৃথিবীতে এসেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন, যে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে তার জন্য এতসব নেয়ামত দান করেছেন এবং ভূপৃষ্ঠকে বিশ্রাম নেয়ার জন্য বিছানা করে দিয়েছেন তাকে ভুলে গেলে চলবে না। এই পৃথিবী নিজের অক্ষের ওপর ২৪ ঘণ্টায় একবার এবং সূযের্র চারপাশে বছরে একবার ঘুরতে থাকা সত্ত্বেও আমরা ভূপৃষ্ঠে বসে এতসব গতির কিছুই অনুভব করি না। এটি আল্লাহ তায়ালার বড় অনুগ্রহ।
তাঁর আরেকটি অনুগ্রহ হচ্ছে ভূপৃষ্ঠে তিনি বহু পথ তৈরি করে দিয়েছেন যাতে মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর স্থলভাগ এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, তাতে নানা প্রাকৃতিক কারণে বিভিন্ন রকমের পথ তৈরি হয়ে গেছে। পাহাড়ি এলাকায় উঁচু উঁচু পর্বতের ভেতর দিয়ে এমন সব গিরিখাদ রয়েছে যে, মানুষ সহজেই তার ভেতর থেকে নিজের চলার পথ খুঁজে নিতে পারে। এটিও মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার আরেকটি বিস্ময়কর অনুগ্রহ। কাজেই যিনি এতসব নেয়ামতরাজি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়েছেন ইবাদতের একমাত্র যোগ্য সত্ত্বা তিনিই।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১- মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির মাধ্যমেই আল্লাহকে খুঁজে পায়। কিন্তু খুঁজে পাওয়ার পর যাতে তাঁকে ভুলে না যায় সেজন্য তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে হয় এবং এই কাজের জন্যই নবী-রাসূলগণ পৃথিবীতে এসেছেন।
২- আমরা আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহসমূহের দিকে গভীর মনোনিবেশ করলেই আল্লাহর প্রতি উদাসীনতার হাত থেকে রক্ষা পাব।
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।