সূরা জুখরুফ : আয়াত ৪৩-৪৮ (পর্ব-৭)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এই সূরার ৪৩ ও ৪৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَاسْتَمْسِکْ بِالَّذِی أُوحِیَ إِلَیْکَ إِنَّکَ عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِیمٍ ﴿٤٣﴾ وَإِنَّهُ لَذِکْرٌ لَکَ وَلِقَوْمِکَ وَسَوْفَ تُسْأَلُونَ ﴿٤٤﴾
“কাজেই আপনার প্রতি যা ওহী করা হয়েছে তা দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করুন। নিশ্চয় আপনি সরল পথে রয়েছেন।” (৪৩:৪৩)
“আর কুরআন হলো অবশ্যই আপনার ও আপনার জাতির জন্য উপদেশ বাণী। আর (এ সম্পর্কে) অচিরেই তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” (৪৩:৪৪)
এই দুই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আপনি যে পথ অনুসরণ করছেন সেটিই সঠিক পথ, এতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি নেই। কাজেই কাফেররা যদি আপনার দাওয়াতের বাণী গ্রহণ না করে তাহলে এর অর্থ এই নয় যে, আপনি সরল পথ থেকে সরে গেছেন।
আপনার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওহী নাজিল হয়েছে আপনি তার ভিত্তিতে দৃঢ়চিত্তে নিজের পথে অটল থাকুন; আপনি জেনে রাখুন আপনি সিরাতুল মুস্তাকিম বা সরল পথে রয়েছেন এবং এটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত জীবনবিধান।
প্রকৃতপক্ষে মানুষকে উদাসীনতার ঘুম থেকে জাগ্রত করা এবং তাদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্যই পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে। কাজেই আপনার উম্মতকে কঠোরভাবে এই কুরআনের শিক্ষাকে আকড়ে ধরতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করতে হবে। মানুষের বিবেক ও সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই ওহী নাজিল হয়েছে এবং কুরআনে কারিম অনুসরণ করলে মানুষ উদাসীনতার অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবে।
মানুষ সারাক্ষণ যেসব বিষয় ভুলে থাকে তার একটি হচ্ছে কিয়ামতের বিচার দিবস। সেখানে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে। পবিত্র কুরআনের আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী মানুষ জীবন পরিচালিত করেছে কিনা সে সম্পর্কে জবাবদিহীতা না করে কেউ মুক্তি পাবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষের মুক্তির একমাত্র নিশ্চিত উপায় হচ্ছে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা। এ ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
২- পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি রাসূলের জীবনাদর্শ ও সুন্নাহকেও অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসৃত পথকে সঠিক পথ বলে বর্ণনা করেছেন।
৩- কিয়ামতের দিন প্রত্যেক মুসলমানকে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।
সূরা জুখরুফের ৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَاسْأَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِکَ مِنْ رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ آلِهَةً یُعْبَدُونَ ﴿٤٥﴾
“আর আপনার পূর্বে আমরা আমাদের রাসূলগণ থেকে যাদেরকে প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কি রহমান ছাড়া ইবাদাত করা যায় এমন কোন ইলাহ স্থির করেছিলাম?” (৪৩: ৪৫)
মক্কার মুশরিকরা নিজেদেরকে হযরত ইব্রাহিম ও হযরত ইসমাইল আলাইহিমুস সালামের বংশধর বলে দাবি করত। তারা প্রতি বছর হজের মতো কিছু ইবাদত পালন করত এবং কাবা শরিফের প্রতি সম্মান জানাত। কিন্তু একই সঙ্গে তারা আল্লাহর এই ঘরে মূর্তি রেখে সেগুলোর পূজাও করত। এই প্রেক্ষাপটে এই মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান করার লক্ষ্যে মহানবী (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: অতীতের নবীদের অনুসারীদের জিজ্ঞাসা করুন, সেসব নবী কি রহমান অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন? আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের বলছেন, তারা যেন কাফেরদের কাছে জিজ্ঞাসা করে, মহান আল্লাহ কি তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপসনা করার অনুমতি দিয়েছেন? যদি আল্লাহ সত্যিই তেমন কোনো আদেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ, আমরা আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য করি এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ছাড়াই মেনে চলি।
এই প্রশ্নের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা একথাই বলতে চেয়েছেন যে, সকল নবী-রাসূল মানুষকে তৌহিদ বা একত্ববাদের দিকে আহ্বান জানাতে এই পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁদের সবাই কঠোরভাবে শিরক ও মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করে গেছেন। পাশাপাশি আল্লাহ একথাও বুঝিয়েছেন, আমাদের নবী (সা.) মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান করে এক আল্লাহর ইবাদত করার যে আহ্বান জানাচ্ছেন সেটি নতুন কোনো কথা নয়। বরং যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলের দাওয়াতের মূল বিষয়বস্তুই ছিল এটি।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- সকল ঐশী ধর্মের অভিন্ন দিক হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ এবং পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.) এই বিষয়টির ওপরই জোর দিয়েছেন।
২- আল্লাহ তায়ালার পরিবর্তে বা আল্লাহর পাশাপাশি অন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তির উপাসনা করার অনুমতি ইসলামে নেই। ইবাদত হতে হবে একমাত্র রহমানুর রহিম আল্লাহ তায়ালার।
সূরা জুখরুফের ৪৬ থেকে ৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مُوسَى بِآیَاتِنَا إِلَى فِرْعَوْنَ وَمَلَئِهِ فَقَالَ إِنِّی رَسُولُ رَبِّ الْعَالَمِینَ ﴿٤٦﴾ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِآیَاتِنَا إِذَا هُمْ مِنْهَا یَضْحَکُونَ ﴿٤٧﴾
“আর অবশ্যই আমি মূসাকে আমার আয়াত (ও নিদর্শনাবলীসহ) ফেরাউন ও তার নেতৃবর্গের নিকট পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমি সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল।”(৪৩:৪৬)
“অতঃপর যখন তিনি তাদের কাছে আমার নিদর্শনাবলী নিয়ে আসলেন তখনি তারা তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে লাগল।” (৪৩:৪৭)
এই দুই আয়াতে হযরত মূসা (আ.)-এর জীবনের একটি অংশের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: হযরত মূসার ওপর দায়িত্ব ছিল বনি ইসলাইল জাতিকে সরল পথে পরিচালিত করা। সেইসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ফেরাউনের কাছেও সত্যের দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ সময় আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসাকে কিছু মুজেযা বা অলৌকিক নিদর্শন দান করেন। তিনি তাঁকে বলেন, হযরত মূসা যেন নিজের রিসালাতের নিদর্শন হিসেবে এগুলো ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গের সামনে তুলে ধরেন।
আল্লাহর এই মহান নবী যখন ফেরাউনের রাজদরবারে প্রবেশ করেন তখন তাঁর পরনে ছিল অতি সাধারণ পোশাক। ফেরাউন ও তার সভাসদকে উদ্দেশ করে হযরত মূসা বলেন, তিনি তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় হেদায়েত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছেন।
আল্লাহর নবীর এই কথা শুনে রাজদরবারের সবাই তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও হাসাহাসি শুরু করে দেয়। কারণ, তারা মক্কার কাফেরদের মতোই মনে করত, আল্লাহ তায়ালা যদি সত্যিই কাউকে নবী হিসেবে পাঠাতে চাইতেন তাহলে সমাজের কোনো অধিপতি বা রাজ দরবারের কোনো পারিষদকে নবী হিসেবে পাঠাতেন। এমন কাউকে পাঠাতেন না যার কোনো নাম-ঠিকানা-পরিচয় নেই এবং যে একদিন ফেরাউনের ঘরে তার পালকপুত্র হিসেবে বড় হয়েছে। এমন একজন কপর্দকহীন মানুষ কিনা বলে ফেরাউন ও তার জাতিকে হেদায়েত করতে এসেছে!
যাই হোক, ইতিহাসের প্রতি পরতে পরতে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ ও তাঁর সত্যের বাণী নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শাসক শ্রেণির কাছেও দাওয়াতের বাণী নিয়ে যেতেন। কারণ, শাসকরা সংশোধিত না হলে সমাজের সাধারণ মানুষকে সংশোধন করা সম্ভব নয়।
২- নবী-রাসূলগণ ছিলেন পুত-পবিত্র চরিত্রের অধিকারী এবং সর্বোচ্চ নৈতিক গুণে গুণান্বিত। সেইসঙ্গে তারা নিজেদের নবুওয়্যাতের বিষয়টি মানুষের সামনে প্রমাণ করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন মুজেযা বা অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শন করতেন।
৩- ইসলামের শত্রুদের কাজই হচ্ছে উপহাস, বিদ্রূপ ও অপমান করা। কুরআনের বাণীর সামনে তাদের সকল যুক্তি অচল বলেই তারা এই বাঁকা পথ বেছে নেয়।
সূরা জুখরুফের ৪৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَمَا نُرِیهِمْ مِنْ آیَةٍ إِلا هِیَ أَکْبَرُ مِنْ أُخْتِهَا وَأَخَذْنَاهُمْ بِالْعَذَابِ لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُونَ ﴿٤٨﴾
“আর আমি ওদেরকে যেসব নিদর্শন দেখিয়েছি তার প্রত্যেকটি ছিল ওর পূর্ববর্তী নিদর্শন অপেক্ষা বৃহত্তর এবং আমি ওদেরকে (নানারকম) শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করেছিলাম, যাতে ওরা (সৎপথে) প্রত্যাবর্তন করে।” (৪৩:৪৮)
আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হচ্ছে: ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গ যাতে সত্য প্রত্যাখ্যান করতে না পারে সেজন্য তাদের কাছে এমন সব অলৌকিক নিদর্শন পাঠিয়েছি যেগুলো ছিল তার আগের মুজেযাগুলোর তুলনায় বড় ও বেশি বিস্ময়কর। আমি এটি এজন্য করেছি যে, তারা যদি সত্যিকার অর্থে সরল পথের সন্ধ্যান করে তাহলে যেন মিথ্যা অহংকার ও আত্মম্ভরিতা ত্যাগ করে সরল পথটি পেয়ে যায়। কিন্তু অলৌকিক নিদর্শন যত বড় হয় ফেরাউনিদের একগুঁয়েমি ও জেদ তত বেড়ে যায়। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের দেশে খরা ও দুর্ভিক্ষের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ পাঠিয়ে হুঁশিয়ার করে দেন যাতে তারা সত্য পথে ফিরে আসে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মহান আল্লাহ মানুষকে হেদায়েত করার জন্য বারবার তাদেরকে সতর্ক করেন, হুঁশিয়ার করে দেন। এটি আমাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের নিদর্শন।
২- বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও সত্য পথে ফিরে না গেলে আল্লাহ পার্থিব জগতের শাস্তি পাঠান। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর দিকে ফিরে যাওয়ার আরো একটি সুযোগ দেন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।