সূরা জুখরুফ : আয়াত ৪৯-৫৬ (পর্ব-৮)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এখন জানবো এই সূরার ৪৯ ও ৫০ নং আয়াতে মহান আল্লাহ কি বলেছেন:
وَقَالُوا یَا أَیُّهَا السَّاحِرُ ادْعُ لَنَا رَبَّکَ بِمَا عَهِدَ عِنْدَکَ إِنَّنَا لَمُهْتَدُونَ ﴿٤٩﴾ فَلَمَّا کَشَفْنَا عَنْهُمُ الْعَذَابَ إِذَا هُمْ یَنْکُثُونَ ﴿٥٠﴾
“আর তারা বলেছিল, হে জাদুকর! তোমার রবের কাছে তুমি আমাদের জন্য তা প্রার্থনা কর যা তিনি তোমার সাথে অঙ্গীকার করেছেন, নিশ্চয়ই আমরা হেদায়েতের পথ অবলম্বন করব।” (৪৩:৪৯)
“কিন্তু যখন আমি তাদের থেকে শাস্তি সরিয়ে নিলাম তখনই তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে বসল।”(৪৩: ৫০)
গত আসরে আমরা বলেছিলাম, আল্লাহর রাসূল হযরত মূসা (আ.) ফেরাউনের রাজদরবারে গিয়ে তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দেন এবং কিছু অলৌকিক নিদর্শন তুলে ধরেন। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গ হযরত মূসার দাওয়াতের মূলবাণী অর্থাৎ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর একত্ববাদ মেনে নিয়ে তাঁর ইবাদত করতে অস্বীকার করে। কিন্তু যখন আল্লাহর শাস্তি আসে এবং তারা কঠিন দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায় তখন তারা হযরত মূসাকে বলে: তিনি যদি আল্লাহকে বলে এই ঐশী গজব তুলে নেন তাহলে তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর ইবাদত করতে শুরু করবে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যখন তারা হযরত মূসার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তখনও তারা এই সম্মানিত নবীকে যাদুকর বলে অভিহিত করে। তারা ভেবেছিল, যাদুকরদের মতো নবীগণও কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা প্রদর্শন করে নিজেদের চারপাশে লোকজন জড়ো করতে চান। তাদের এই সম্মোধন থেকেই বোঝা যায়, এই দাম্ভিক ও অহংকারী লোকগুলো ঈমান আনার যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা মিথ্যা। তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় খুঁজছে মাত্র; হেদায়েতের পথ অবলম্বন তাদের উদ্দেশ্য নয়।
কাজেই পরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন: এসব অপরাধী জালেমের কাছ থেকে যখন বিপদ উঠিয়ে নিলাম এবং ঘুর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেমে গেল তখনই তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাল।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বেশিরভাগ মানুষ বিপদে পড়লে তা থেকে মুক্তির জন্য দোয়া পেতে আল্লাহর ওলীদের কাছে ধর্না দেয়।
২- বিপদে পড়লে মানুষের মধ্যে আল্লাহকে চেনার সহজাত প্রবৃত্তি জেগে ওঠে এবং তারা আল্লাহ তায়ালাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু বিপদ কেটে গেলে তারা আবার উদাসীন হয়ে যায় এবং আল্লাহকে ভুলে যায়।
সূরা জুখরুফের ৫১ থেকে ৫৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَنَادَى فِرْعَوْنُ فِی قَوْمِهِ قَالَ یَا قَوْمِ أَلَیْسَ لِی مُلْکُ مِصْرَ وَهَذِهِ الأنْهَارُ تَجْرِی مِنْ تَحْتِی أَفَلا تُبْصِرُونَ ﴿٥١﴾ أَمْ أَنَا خَیْرٌ مِنْ هَذَا الَّذِی هُوَ مَهِینٌ وَلا یَکَادُ یُبِینُ ﴿٥٢﴾ فَلَوْلا أُلْقِیَ عَلَیْهِ أَسْوِرَةٌ مِنْ ذَهَبٍ أَوْ جَاءَ مَعَهُ الْمَلائِکَةُ مُقْتَرِنِینَ ﴿٥٣﴾
“আর ফেরাউন তার সম্প্রদায়ের মাঝে ঘোষণা দিয়ে বলল- হে আমার সম্প্রদায়! মিশরের রাজত্ব কি আমার নয়? আর এ সব নদনদী আমার (প্রাসাদসমূহের) নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে না? তোমরা কি (আমার এই শ্রেষ্ঠত্ব) দেখ না?” (৪৩: ৫১)
“নাকি আমি এ ব্যক্তি হতে শ্রেষ্ঠ নই, যে হীন এবং স্পষ্ট কথা বলতেও প্রায় অক্ষম!” (৪৩: ৫২)
“(সে নবী হলে) তাকে স্বর্ণের বালা দেওয়া হল না কেন অথবা তার সঙ্গে ফেরেশতাগণ কেন এল না?” (৪৩: ৫৩)
ফেরাউন ও তার জাতি হযরত মূসার পক্ষ থেকে প্রদর্শিত মুজেযাগুলো দেখেছিল এবং তাঁর দোয়ায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এই দু’টি বিষয় সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপক প্রভাবে ফেলে এবং ফেরাউনের প্রতি তাদের এতদিনের বিশ্বাসে ফাটল ধরে। তারা হযরত মূসাকে সত্যি সত্যি আল্লাহর নবী বলে ভাবতে শুরু করে।
এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ফেরাউন জনগণের সামনে হযরত মূসা (আ.)কে অপমান করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার জাতির সামনে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়। ফেরাউন ঘোষণা করে: মিশরের এই বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক কি আমি নই? এই নদ-নদীগুলো কি আমার নির্দেশে চলে না? তোমরা কি এগুলোকে আমার প্রাসাদ ও উদ্যানসমূহের নীচ দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখ না? অথচ মূসার কি আছে? সে না ঠিকমতো কথা বলতে পারে আর না তার সঙ্গে কোনো ফেরেশতা আছে। সমাজ অধিপতিদের মতো তার কোনো প্রাসাদ বা দামী পোশাক কিংবা স্বর্ণালঙ্কারও নেই। তোমরা যা চাইবে আমার কাছে তা-ই পাবে কিন্তু মূসা সম্পূর্ণ কপর্দকহীন একজন মানুষ। তাহলে কেন তোমরা তার কথা শুনে তার আল্লাহর ইবাদত করতে চাও?
তৎকালীন যুগে মিশরের নীলনদ ছিল অন্য সব ছোট নদীর উৎস এবং এসব নদ-নদী গোটা মিশরের সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মানুষের কৃষিকাজ ও খাবার পানির উৎস এই নীলনদের পানি ফেরাউনের নির্দেশে বণ্টন করা হতো। কাজেই জনগণের জীবন ও জীবিকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ ফেরাউন নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিল। এভাবে ফেরাউন ভাবত সে সত্যিই জনগণের খোদায় পরিণত হয়েছে। কাজেই অন্য কাউকে অর্থাৎ বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে সে সাধারণ মানুষের প্রতিপালক হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- সাম্রাজ্যবাদী ও তাগুতি শক্তিগুলো যুক্তি বা বুদ্ধির ধার ধারে না। তারা বরং নিজেদের ক্ষমতা, সম্পদ ও বাহ্যিক জৌলুস নিয়ে গর্ব করে এবং এসব বিষয়কে নিজেদের সৎপথে থাকার নিদর্শন বলে মনে করে।
২- মানুষের বাহ্যিক চেহারা, বেশভুষা কিংবা তাদের কথা বলার ধরণকে উপজীব্য করে তাদেরকে অপমান করা ফেরাউনি বৈশিষ্ট্য।
৩- ফেরাউনের মতো সম্পদ ও ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি অন্য কোনো বিষয়কে উপজীব্য করেও নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে তবে সেও ফেরাউনি চরিত্রের অধিকারী।
সূরা জুখরুফের ৫৪ থেকে ৫৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَاسْتَخَفَّ قَوْمَهُ فَأَطَاعُوهُ إِنَّهُمْ کَانُوا قَوْمًا فَاسِقِینَ ﴿٥٤﴾ فَلَمَّا آسَفُونَا انْتَقَمْنَا مِنْهُمْ فَأَغْرَقْنَاهُمْ أَجْمَعِینَ ﴿٥٥﴾ فَجَعَلْنَاهُمْ سَلَفًا وَمَثَلا لِلآخِرِینَ ﴿٥٦﴾
“এভাবে (ফেরাউন) তার সম্প্রদায়কে বোকা বানাল, ফলে তারা তার আনুগত্য মেনে নিল৷ নিশ্চয় তারা ছিল এক ফাসিক সম্প্রদায়।” (৪৩:৫৪)
“অতঃপর যখন তারা আমাকে ক্ৰোধাম্বিত করল তখন আমি তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিলাম এবং তাদের সকলকে একত্রিতভাবে নিমজ্জিত করলাম। ”(৪৩:৫৫)
“ফলে পরবর্তীদের জন্য তাদেরকে করে রাখলাম (খারাপ) পূর্বসূরী ও দৃষ্টান্ত।”(৪৩:৫৬)
ফেরাউন নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি হযরত মূসা (আ.)কে অপমান করে প্রকৃতপক্ষে জনগণকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে তাদের পক্ষে বুদ্ধি খাটিয়ে সত্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয় না। সে তার জাতিকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে নিজের শান-শওকতকে তাদের চোখের সামনে এতটা বড় করে তুলে ধরে যে, এসব মানুষ বোকা বনে যায়। ফলে তারা বিনা বাক্যব্যয়ে ফেরাউনের আনুগত্য মেনে নেয়।
এখানে মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের যুগে যুগে সকল তাগুতি ও দাম্ভিক শাসক নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণকে বোকা বানায়। তারা জনগণকে অজ্ঞতার অন্ধকারে রেখে নিজেদের বিভ্রান্ত আচার-আচরণকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়। কারণ জনগণ যদি শিক্ষার আলো পায় ও জেগে ওঠে তাহলে তাদের ক্ষমতার ভিত কেঁপে উঠবে।
বর্তমানেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো স্যাটেলাইট চ্যানেল, রেডিও ও ভার্চুয়াল জগত সৃষ্টি করে জাতিগুলোর বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা করার ক্ষমতাকে হরণ করেছে। এসব গণমাধ্যম ব্যবহার করে তারা জাতিগুলোর মগজ ধোলাই করছে এবং তাদেরকে নানারকম চটকদার খবরে মশগুল করে রেখে প্রকৃত ঘটনাপ্রবাহ থেকে তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখছে। এর ফলে জনগণ কোনোকিছু উপলব্ধি করতে পারছে না এবং এসব শক্তি তাদের ক্ষমতার মসনদ ধরে রেখেছে।
এখানে জরুরি বিষয় হলো- ফেরাউনের যুগের জনগণেরও দোষ কম ছিল না। তাদের মধ্যে যে মিথ্যাচার ও উদাসীনতা প্রচলিত ছিল তার কারণে তারা অতি সহজে ফেরাউনের আদেশ-নিষেধ মেনে নিত এবং তাকে নিজেদের খোদা বলে মনে করত। এভাবে তাদের এই বিপথগামীতার জন্য তারা নিজেরাই অনেকাংশে দায়ী ছিল। এ কারণে তারা হযরত মূসার দাওয়াতের বাণী মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
যারা স্বেচ্ছায় ফেরাউনের মতো নিকৃষ্ট ও জঘন্য শাসকের আধিপত্য মেনে নেয় তাদেরকে ফেরাউনের ওপর আরোপিত শাস্তিও ভোগ করতে হয়। আল্লাহ ফেরাউনের সঙ্গে তাদেরকেও নীলনদে ডুবিয়ে মারেন। কাজেই ফেরাউন ও তার জাতির এই ভয়ানক পরিণতিতে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য রয়েছে মস্তবড় শিক্ষা।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- অত্যাচারী শাসকরা জনগণকে দুর্বল ও বুদ্ধিহীন মনে করে। এ ধরনের জাতিগুলো আত্মপরিচয় ভুলে যায় বলে শাসকদের অত্যাচার মাথা পেতে নেয়।
২- যে সমাজের মানুষ আল্লাহর আনুগত্য করে না তাদের পরিণতি এমনই হয় এবং তারা সাম্রাজ্যবাদী ও অত্যাচারী শাসকের আনুগত্য মেনে নেয়।
৩- কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা পাপে ডুবে থাকা জাতিগুলোকে এই পৃথিবীতেই শাস্তি দেন এবং তাদেরকে পরবর্তী জাতিগুলোর জন্য শিক্ষণীয় বিষয় করে রাখেন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।