সূরা জুখরুফ : আয়াত ৫৭-৬২ (পর্ব-৯)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এখন জানবো এই সূরার ৫৭ ও ৫৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ কি বলেছেন:
وَلَمَّا ضُرِبَ ابْنُ مَرْیَمَ مَثَلا إِذَا قَوْمُکَ مِنْهُ یَصِدُّونَ ﴿٥٧﴾ وَقَالُوا أَآلِهَتُنَا خَیْرٌ أَمْ هُوَ مَا ضَرَبُوهُ لَکَ إِلا جَدَلا بَلْ هُمْ قَوْمٌ خَصِمُونَ ﴿٥٨﴾
“আর যখনই মরিয়ম-তনয় (ঈসার) দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়, তখনই আপনার সম্প্রদায় হঠাৎ করে তাতে (ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে) শোরগোল আরম্ভ করে দেয়।” (৪৩:৫৭)
“এবং বলে: ‘আমাদের দেবতাগুলি শ্রেষ্ঠ, না ঈসা?’ এরা তো কেবল ঝগড়া করার উদ্দেশ্যেই আপনাকে এ কথা বলে। বস্তুতঃ এরা তো এক ঝগড়াটে সম্প্রদায়।”(৪৩: ৫৮)
ইতিহাসে এসেছে, মক্কার মুশরিকরা তাদের মূর্তিপূজাকে সত্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য বিশ্বনবী (সা.)-এর সামনে খ্রিস্টানদের উদাহরণ তুলে ধরত। তারা বলত: খ্রিস্টানরা যেমন মরিয়ম নামের এক নারীর সন্তান ঈসা মাসিহ’র উপাসনা করে আমরাও তেমনি আমাদের দেবতাদের উপাসনা করি। যদি আমাদের উপাসনা মিথ্যা হয় তাহলে তাদের উপাসনাও মিথ্যা এবং আমাদেরকে যদি আমাদের উপাস্যগুলোসহ জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হয় তাহলে মাসিহ’কেও জাহান্নামে যেতে হবে।
মক্কার কাফেররা আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে ঝগড়া করার উদ্দেশেই মূলত এই অসার তুলনা করত। তারা নিজেদের অন্যায় কাজ বন্ধ করার পরিবর্তে সে কাজের ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করত এবং এ কাজ করতে গিয়েও তারা আরেক অনর্থক তুলনার আশ্রয় নিত। বর্তমানেও বহু অপরাধী তাদের অপরাধের ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে এই একই পন্থা অবলম্বন করে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ফেরাউনের মতো যেসব মানুষ নিজে অন্য মানুষের উপাস্য হতে চেয়েছে এবং তাদের উপাসনা করতে জনগণকে বাধ্য করেছে তারা জাহান্নামে যাবে। কিন্তু হযরত ঈসা (আ.) কখনোই নিজেকে উপাস্য বলে দাবি করেননি বরং কেউ এ কাজ করতে চাইলে তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হতেন। তিনিসহ সব নবী-রাসূল এক আল্লাহর ইবাদত করার দাওয়াত দিতে ধুলির ধরায় আগমন করেছিলেন; তাদের নিজেদের ইবাদতের দাওয়াত দিতে নয়।
এই দুই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- অপরের ভ্রান্ত বিশ্বাসকে উপহাস না করে উপযুক্ত যুক্তি তুলে ধরে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
২- পবিত্র কুরআনে সত্য জানার জন্য আলোচনা ও পরামর্শ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যায় কাজের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ঝগড়া ও কূটতর্কে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন আল্লাহ তায়ালা।
সূরা জুখরুফের ৫৯ ও ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِنْ هُوَ إِلا عَبْدٌ أَنْعَمْنَا عَلَیْهِ وَجَعَلْنَاهُ مَثَلا لِبَنِی إِسْرَائِیلَ ﴿٥٩﴾ وَلَوْ نَشَاءُ لَجَعَلْنَا مِنْکُمْ مَلائِکَةً فِی الأرْضِ یَخْلُفُونَ ﴿٦٠﴾
“ঈসা একজন বান্দা ছাড়া আর কিছু নয় যার প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, আর বনি ইসরাঈলের জন্য আমি তাকে করেছিলাম নিদর্শন ও নমুনা।”(৪৩: ৫৯)
“আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের পরিবর্তে ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারি যারা (পৃথিবীতে) তোমাদের উত্তরাধিকারী হবে।” (৪৩: ৬০)
আগের দুই আয়াতে মক্কার মুশরিকদের পক্ষ থেকে তাদের দেবতাদের সঙ্গে হযরত ঈসা (আ.)-এর তুলনা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতে হযরত ঈসা (আ.)-এর পরিচয় তুলে ধরে আল্লাহ পাক বলছেন: তিনি নিজেকে আল্লাহর বান্দা বা দাস বলে জানতেন এবং খ্রিস্টানরা তাঁর উপসনা করুক তা তিনি কখনোই চাননি। তিনি বরং এ কাজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নবুওয়্যাত ও রিসালাতের নিয়ামত দান করেছিলেন যাতে তিনি পরিপূর্ণ আদর্শ মানব হিসেবে বনি ইসরাইল জাতির সামনে নিজেকে হেদায়েতপ্রাপ্তদের নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। তিনি যেসব মুজিযা বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখাতেন তার প্রত্যেকটি ছিল আল্লাহ তায়ালার মহিমা ও হযরত ঈসা’র নবুওয়্যাতের নিদর্শন।
তিনি যতদিন মানুষের মাঝে জীবনযাপন করেছেন ততদিন তিনি নিজে এক আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং সবাইকে সেই সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরবর্তীতে খ্রিস্টানরা আল্লাহর পরিবর্তে হযরত ঈসার উপাসনা করতে শুরু করে দিয়েছে। পরের আয়াতে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে তোমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের দিকে আহ্বান করছেন তা এজন্য নয় যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ঈমান ও ইবাদতের মুখাপেক্ষী। কারণ, তিনি চাইলে তোমাদের পরিবর্তে এই পৃথিবীতে ফেরেশতাদের পাঠাতে পারেন যারা সারাক্ষণ বিনম্রচিত্তে এক আল্লাহর ইবাদত করবে ও তাঁর আদেশ-নিষেধ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালার ইবাদত মানুষের পূর্ণতা ও উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হওয়ার মাধ্যম। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর ইবাদতের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্টিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
২- ইতিহাসের প্রতিটি যুগে ইহুদিরা হযরত ঈসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে এসেছে, অথচ তিনি ছিলেন বনি ইসরাইল জাতিরই অধিবাসী। ইহুদিরা শুধুমাত্র উগ্রতা ও গোঁয়ার্তুমির কারণে তাঁর নবুওয়্যাতকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
৩- মহান আল্লাহ চান মানুষ স্বেচ্ছায় ও বুঝেশুনে ঈমান গ্রহণ করুক। তা না হলে তিনি পৃথিবীতে মানুষের পরিবর্তে ফেরেশতাদের পাঠাতে পারতেন যাদের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা নেই এবং যারা আল্লাহর আদেশে সার্বক্ষণিক তাঁর ইবাদতে মগ্ন রয়েছে।
সূরা জুখরুফের ৬১ থেকে ৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِنَّهُ لَعِلْمٌ لِلسَّاعَةِ فَلا تَمْتَرُنَّ بِهَا وَاتَّبِعُونِ هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِیمٌ ﴿٦١﴾ وَلا یَصُدَّنَّکُمُ الشَّیْطَانُ إِنَّهُ لَکُمْ عَدُوٌّ مُبِینٌ ﴿٦٢﴾
“আর নিশ্চয় সে (অর্থাৎ ঈসা) হবে কিয়ামতের এক সুনিশ্চিত আলামত। সুতরাং তোমরা কিয়ামত সম্পর্কে সংশয় পোষণ করো না এবং আমারই অনুসরণ কর। এটিই সরল পথ।” (৪৩:৬১)
“আর শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই (আল্লাহর পথ অনুসরণ) হতে নিবৃত্ত না করে, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”(৪৩:৬২)
আগের আয়াতগুলোর সূত্র ধরে এই দুই আয়াতে হযরত ঈসা (আ.)-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: হযরত ঈসার অস্তিত্বই কিয়ামতের অন্যতম সুস্পষ্ট আলামত। কারণ, পিতা ছাড়া শুধুমাত্র একজন মায়ের গর্ভে তাঁর জন্মের মাধ্যমে বোঝা যায়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ আবার আমাদেরকে জীবিত করতে পারবেন। হযরত ঈসার একটি মুজিযা ছিল এই যে, তিনি পৃথিবীতেই মৃত মানুষকে জীবিত করতে পারতেন। এছাড়া, নির্ভরযোগ্য হাদিস অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ.) শেষ জামানায় আসমান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবেন যা হবে পৃথিবীর সমাপ্তি ও কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বলক্ষণ। খ্রিস্টানরাও ভূপৃষ্ঠে হযরত ঈসার পুনরাগমনে বিশ্বাস করে। এরপর কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে আল্লাহ বলছেন: তোমরা কিয়ামত দিবসের ব্যাপারে মনে বিন্দুমাত্র সংশয় পোষণ করো না। কারণ, ওই দিবসের প্রতি উদাসীন হয়ে গেলেই তোমরা নানারকম পাপকাজ ও অপরাধে জড়িয়ে পড়বে যার পরিণতি হচ্ছে জাহান্নাম।
তোমরা বরং আল্লাহর নির্দেশিত সিরাতুল মুস্তাকিম অনুসরণ করো। এটি হচ্ছে নবী-রাসূলদের নির্দেশিত পথ যা মানুষকে সব ধরনের বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্যের পথ দেখায়।
অবশ্য আল্লাহর দেখানো পথের পাশাপাশি শয়তানেরও পথ রয়েছে যে কিনা ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে কিয়ামতের কথা ভুলিয়ে রাখে। ফলে মানুষ ইচ্ছাস্বাধীন জীবনযাপন করে এবং পরিণতিতে দুনিয়া ও আখিরাতে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। শয়তান এই কাজ করে মানুষের প্রতি তার প্রকাশ্য শত্রুতার কারণে। মানুষের আদিপিতা হযরত আদমকে আল্লাহর আদেশে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে শয়তান আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। তখন সে এই শপথ করেছিল যে, যে আদমের কারণে তাকে বিতাড়িত হতে হলো সেই আদমের সন্তানদের কিয়ামত পর্যন্ত সে পথভ্রষ্ট করে যাবে। আল্লাহ বলছেন: এখন তোমরা কীভাবে এই কসম খাওয়া শত্রুর মোকাবিলায় নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করো এবং তার প্রতারণার জালে আটকে গিয়ে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরে যাও?
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১- নবী-রাসূলগণের উপস্থিতি, তাদের কথা ও কাজ মানুষকে কিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
২- সিরাতুল মুস্তাকিমে চলার জন্য মানুষের সামনে আদর্শ প্রয়োজন। এই সরল পথে চলা তাদেরকে শিখতে হবে আল্লাহর পুতপবিত্র বান্দাদের অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের কাছ থেকে। তা না করলে মানুষ নিজের কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের প্রবঞ্চনায় পড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, অথচ সে মনে করবে সে সিরাতুল মুস্তাকিমে রয়েছে।
৩- শয়তান সার্বক্ষণিকভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখাই তার একমাত্র কাজ।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।