সূরা জুখরুফ : আয়াত ৬৩-৬৯ (পর্ব-১০)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এখন জানবো এই সূরার ৬৩ ও ৬৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ কি বলেছেন:
وَلَمَّا جَاءَ عِیسَى بِالْبَیِّنَاتِ قَالَ قَدْ جِئْتُکُمْ بِالْحِکْمَةِ وَلأبَیِّنَ لَکُمْ بَعْضَ الَّذِی تَخْتَلِفُونَ فِیهِ فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَطِیعُونِ ﴿٦٣﴾ إِنَّ اللَّهَ هُوَ رَبِّی وَرَبُّکُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُسْتَقِیمٌ ﴿٦٤﴾
“আর ঈসা যখন স্পষ্ট নিদর্শনসহ এলো তখন সে বলল: আমিতো তোমাদের জন্য প্রজ্ঞা এনেছি এবং তোমরা যেসব বিষয়ে মতভেদ করছ তা স্পষ্ট করে দেয়ার জন্য (এসেছি)। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর।” (৪৩:৬৩)
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর; এটাই সরল পথ।”(৪৩: ৬৪)
গত আসরে আমরা হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে খ্রিস্টানদের অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলাম যেখানে তারা আল্লাহর এই নবীকে তাঁর সন্তান গণ্য করে তার উপাসনা করত। এই দুই আয়াতে খ্রিস্টানদের সে দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখ্যান করে হযরত ঈসা (আ.)-এর দাওয়াতের বাণী তুলে ধরে বলা হচ্ছে: অন্য অনেক নবীর মতো হযরত ঈসাও জনগণের সামনে কিছু মুজেযা বা অলৌকিক নিদর্শন তুলে ধরে নিজের নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করেন। তিনি প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দেন। অর্থাৎ তিনি সত্যের বাণী যুক্তি দিয়ে বর্ণনা করেন যাতে সবাই বুঝতে ও গ্রহণ করতে পারে এবং সব ধরনের পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পায়।
স্বাভাবিকভাবেই মানুষ যেসব বিষয়ে মতভেদ করে তা দূর করে বিবাদ মিটিয়ে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞার মাধ্যমে দেয়া সম্ভব। মানুষ যাতে হযরত ঈসা (আ.)কে উপাস্য হিসেবে প্রচার করতে না পারে সেজন্য তিনি নিজেই বিষয়টি স্পষ্ট করে দেন। আল্লাহর এই নবী বলেন: নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এবং আমার উভয়েরই পালনকর্তা। তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট করে দেন যে, তোমাদের সঙ্গে আমার কোনো পার্থক্য নেই এবং আমাদের পালনকর্তা অভিন্ন। আমিও তোমাদের মতো তাঁর মুখাপেক্ষী এবং তিনি একাধারে স্রষ্টা, পালনকর্তা ও উত্তম পথ প্রদর্শনকারী। কাজেই তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করো, কারণ, তিনি ছাড়া আর কেউ মাবুদ হওয়ার যোগ্য নয়। হযরত ঈসা (আ.) নিজের বক্তব্যকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য আরো বলেন: সরল পথ হচ্ছে আল্লাহর বান্দেগির পথ এবং এই পথে কোনো ভ্রান্তি বা বক্রতা নেই।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ প্রজ্ঞা ও স্পষ্ট নিদর্শনসহ মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান জানাতেন যাতে মানুষ সবকিছু দেখে এবং বুঝে-শুনে আল্লাহর ওপর ঈমান আনে।
২- ধর্মীয় ও সামাজিক মতপার্থক্য নিরসনের সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে নবী-রাসূলগণের শিক্ষা।
৩- হযরত ঈসা (আ.)-এর দাওয়াতের মূলবাণী ছিল এক আল্লাহর ইবাদত করা। যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং পালন করছেন ইবাদত হতে হবে একমাত্র তাঁর। তিনি ছাড়া অন্য যে কারো ইবাদত হচ্ছে পথভ্রষ্টতা। কাজেই যে যত বড় নবীই হোক না কেন তার ইবাদত করা যাবে না; যদিও তার জন্ম অস্বাভাবিক নিয়মে হয়ে থাকে।
সূরা জুখরুফের ৬৫ থেকে ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَاخْتَلَفَ الأحْزَابُ مِنْ بَیْنِهِمْ فَوَیْلٌ لِلَّذِینَ ظَلَمُوا مِنْ عَذَابِ یَوْمٍ أَلِیمٍ ﴿٦٥﴾ هَلْ یَنْظُرُونَ إِلا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِیَهُمْ بَغْتَةً وَهُمْ لا یَشْعُرُونَ ﴿٦٦﴾ الأخِلاءُ یَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلا الْمُتَّقِینَ ﴿٦٧﴾
“কিন্তু তাদের মধ্যকার কতগুলি দল মতভেদ করেছিল। সুতরাং যারা জুলুম করেছে তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক দিনের আযাবের দুর্ভোগ!”(৪৩: ৬৫)
“তারা কি তাদের উপর অকস্মাৎ কিয়ামত এসে পড়ার অপেক্ষা করছে যা তারা টেরও পাবে না?”(৪৩: ৬৬)
“সেদিন বন্ধুরা হয়ে যাবে পরস্পরের শত্রু, তবে তার নয় যারা মুত্তাকি।”(৪৩: ৬৭)
হযরত ঈসা (আ.) বনি-ইসরাইল জাতির জন্য রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের একদল আল্লাহর এই নবীকে ‘মিথ্যাবাদী’ আখ্যায়িত করে তাঁর রিসালাত প্রত্যাখ্যান করে। আরেকদল তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এবং তাঁকে নবীর চেয়ে ঊর্ধ্বে উঠিয়ে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে দেয়। তারা ভাবতে থাকে হযরত ঈসা হচ্ছেন এমন এক খোদা যিনি আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং মানুষের রূপ ধারণ করেছেন। আবার কেউ কেউ তাঁকে তিন খোদার একজন বলে ঘোষণা করতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী দলই সংখ্যায় ভারী হয় এবং তারা ত্রিত্ববাদ প্রচার করে যা বর্তমানে খ্রিস্টানদের মৌলিক ধর্মবিশ্বাস।
এমন সময় বনি-ইসরাইল জাতি এই বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি করতে থাকে যখন হযরত ঈসা (আ.) নিজেকে আল্লাহর বান্দা হিসেবে তুলে ধরেন এবং জনগণকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানান। এ কারণে পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: যারা জুলুম করেছে ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের জন্য রয়েছে মহাদুর্ভোগ। তারা নবুওয়াতের মর্যাদার প্রতি জুলুম করেছে এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এরপর আল্লাহ প্রশ্ন করছেন: তারা রাসূলের প্রতি এ ধরনের মিথ্যা আরোপ করে কি পেতে চায়? তারা কি কিয়ামত দিবস ছাড়া আর কিছুর আশা করছে যা হঠাৎ করে তাদেরকে পাকড়াও করবে? মৃত্যু ও কিয়ামত অবধারিত বিষয় হলেও মানুষ সাধারণত সেজন্য প্রস্তুতি নেয় না; ফলে মালাকুল মউত বা মৃত্যুর ফেরেশতা হঠাৎ করে এসে গেলে তারা হতবিহ্বল হয়ে যায়।
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কিয়ামতের ভয়ঙ্কর দিবসের দু’টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটি হচ্ছে তা হঠাৎ করে এসে যাবে এবং দ্বিতীয়ত, মানুষ সে দিবস দেখতে পেয়ে হতচকিত হয়ে যাবে এবং সেজন্য তাদের কোনো প্রস্তুতি থাকবে না।
পরের আয়াতে কিয়ামতের আরো বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলা হচ্ছে: সেদিন ধর্মীয় কারণ ছাড়া অন্য কারণগুলোতে সৃষ্ট বন্ধন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। জুলুম, ফাসাদ ও গোনাহের পথে যেসব বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে সেসব বন্ধু পরস্পরের শত্রু হয়ে যাবে। প্রত্যেকে নিজের অসহায় অবস্থার জন্য অপরকে দায়ী করে বলবে: তুমি আমার সামনে পার্থিব জীবনের চাকচিক্যকে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছো এবং এ কারণে আজ কিয়ামতের দিন আমাকে অসহায়ভাবে জাহান্নামে যেতে হচ্ছে। পক্ষান্তরে যারা পৃথিবীতে আল্লাহকে ভালোবেসে ঐশী মূল্যবোধগুলোকে রক্ষা করার লক্ষ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে কিয়ামতের দিন তাদের বন্ধুত্ব অটল থাকবে। মুত্তাকি ব্যক্তিরা মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকালের জীবনকে লক্ষ্য করে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে বলে সেই অনন্তকালের জীবনেও তাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কিয়ামত এসে যাবে হঠাৎ করে। সেদিনের দিনক্ষণ এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই, এমনকি নবী-রাসূলগণও এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না।
২- আখেরাতকে সামনে রেখে যদি দুনিয়ায় বন্ধুত্ব স্থাপিত না হয় তাহলে সে বন্ধুত্ব কিয়ামতের দিন শত্রুতায় পর্যবসিত হবে।
৩- ঈমানদার ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থায়ী হয় অন্যদিকে পার্থিব স্বার্থে স্থাপিত বন্ধুত্ব হয় ক্ষণস্থায়ী এবং এ ধরনের বন্ধুত্বে আস্থা রাখা সম্ভব নয়।
সূরা জুখরুফের ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
یَا عِبَادِ لا خَوْفٌ عَلَیْکُمُ الْیَوْمَ وَلا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ ﴿٦٨﴾ الَّذِینَ آمَنُوا بِآیَاتِنَا وَکَانُوا مُسْلِمِینَ ﴿٦٩﴾
“হে আমার বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা দুঃখিতও হবে না।”(৪৩:৬৮)
“যারা আমার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলে এবং যারা ছিলে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)।”(৪৩:৬৯)
পার্থিব জগতে মুত্তাকি বা পরহেজগার ব্যক্তিরা বিশ্বাসগত দিক দিয়ে শক্ত ও কঠিন ঈমানের অধিকারী এবং ইবাদতের দিক দিয়েও তারা আল্লাহ তায়ালার আদেশ-নিষেধের সামনে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পনকারী। আল্লাহর আয়াতসমূহের সত্যতার ব্যাপারে তাদের অন্তরে যেমন বিন্দুমাত্র সংশয় নেই তেমনি তারা শয়তানের কুমন্ত্রণা বা অন্তরের কামনা-বাসনার কাছেও অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করেন না।
এ ধরনের মানুষের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ প্রদান করে বলা হচ্ছে: কিয়ামতের দিন তোমরা থাকবে ভয় ও শঙ্কার ঊর্ধ্বে। অতীত সম্পর্কে যেমন তোমাদেরকে চিন্তিত হতে হবে না তেমনি ভবিষ্যত নিয়েও থাকবে না কোনো উদ্বেগ। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন-মুত্তাকিদের জন্য এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কি হতে পারে? তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন বলে এর ফলাফল নিয়ে চিন্তিত নন। পার্থিব জীবনে ব্যর্থতা ও পরাজয়ে তারা হতাশ হন না বা ভেঙে পড়েন না। কারণ তারা জানেন, আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সঠিকভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করার কারণে পরকালে তাকে ভয় বা দুঃখের সম্মুখীন হতে হবে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- প্রকৃত শান্তি পেতে চাইলে এবং কিয়ামতের ভয়ঙ্কর দিবসে ভয় ও শঙ্কা থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে আল্লাহ তায়ালার বান্দেগি করতে হবে এবং তাঁর নির্দেশের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করতে হবে।
২- শুধুমাত্র ঈমান যথেষ্ট নয়। আমলও করতে হবে এবং তা হতে হবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।