সূরা জুখরুফ : আয়াত ৭০-৭৮ (পর্ব-১১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এখন জানবো এই সূরার ৭০ থেকে ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ কি বলেছেন:
ادْخُلُوا الْجَنَّةَ أَنْتُمْ وَأَزْوَاجُکُمْ تُحْبَرُونَ ﴿٧٠﴾ یُطَافُ عَلَیْهِمْ بِصِحَافٍ مِنْ ذَهَبٍ وَأَکْوَابٍ وَفِیهَا مَا تَشْتَهِیهِ الأنْفُسُ وَتَلَذُّ الأعْیُنُ وَأَنْتُمْ فِیهَا خَالِدُونَ ﴿٧١﴾ وَتِلْکَ الْجَنَّةُ الَّتِی أُورِثْتُمُوهَا بِمَا کُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٧٢﴾ لَکُمْ فِیهَا فَاکِهَةٌ کَثِیرَةٌ مِنْهَا تَأْکُلُونَ ﴿٧٣﴾
“তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগণ খুশি ও আনন্দচিত্তে জান্নাতে প্রবেশ করো।” (৪৩:৭০)
“স্বর্ণের থালা ও পানপাত্ৰ নিয়ে তাদেরকে প্ৰদক্ষিণ করা হবে [যাতে তারা নানারকম সুস্বাদু খাবার ও পানীয় খেতে পারে]; সেখানে মন যা চায় এবং যাতে নয়ন তৃপ্ত হয় তার সবই বিদ্যমান থাকবে। আর সেখানে তোমরা হবে চিরস্থায়ী।”(৪৩: ৭১)
“আর এটাই জান্নাত, তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করা হয়েছে তোমাদের [সৎ] কর্মের প্রতিদানস্বরূপ।” (৪৩:৭২)
“সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে প্রচুর ফলমূল, তা থেকে তোমরা আহার করবে।”(৪৩:৭৩)
গত আসরের শেষাংশে বলা হয়েছিল, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নেক বান্দাদেরকে এই সুসংবাদ দেন যে, কিয়ামতের দিন তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। এরপর এই চার আয়াতে জান্নাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে: পার্থিব জীবনে ঈমান রক্ষার কাজে যেসব দম্পতি সব ধরনের দুঃখ-কষ্ট পরস্পর ভাগাভাগি করে নিয়েছে পরকালে জান্নাতের সুখ ভোগের ক্ষেত্রেও তারা পরস্পরের সঙ্গী হবে এবং একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। তারা সেখানে সীমাহীন আনন্দ ও সুখের সাগরে ভাসবে এবং তাদের চেহারা দেখেই তাদের উৎফুল্ল চিত্তের কথা বোঝা যাবে।
দুনিয়ায় মুমিন ব্যক্তিরা তাদের ঈমান রক্ষা করার লক্ষ্যে যেসব চিত্তবিনোদন ও আনন্দ-উল্লাস থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত রেখেছিল আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাদেরকে সেসব বঞ্চনার কষ্ট ভুলিয়ে দেবেন। জান্নাতের সুদর্শন সেবকরা সবচেয়ে দামী ও সুন্দরতম পাত্রে অতি সুস্বাদু খাবার ও পানীয় দিয়ে মুমিন ব্যক্তিদের আপ্যায়ন করবে এবং জান্নাতিরা যা কিছু চাইবে তার সবকিছুরই ব্যবস্থা করে দেবে। আর এসব নেয়ামত কখনো ফুরিয়ে যাবে না। জান্নাতবাসীর কাছে এসব নেয়ামত কখনো একঘেঁয়ে মনে হবে না।
এরপর জান্নাতের আরো দু’টি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: মানুষের অন্তর যা কিছু কামনা করে এবং তাদের দৃষ্টিতে যা কিছু উপভোগ্য মনে হয় তার সবকিছুই জান্নাতে বিদ্যমান থাকবে। জান্নাতের নেয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে সুন্দর উপমা আর হতে পারে না।
এতসব নেয়ামত পাওয়ার পর জান্নাতবাসী যেন একথা মনে করতে না পারে যে, এতসব উপভোগ্য জিনিস আবার কখনো হাতছাড়া হয়ে যাবে না তো? সেজন্য আল্লাহ আয়াতের শেষাংশে একথাও বলে দিচ্ছেন যে, এসব নেয়ামতের মধ্যে তোমরা অনন্তকাল ডুবে থাকবে। এর পরের আয়াতে জান্নাতের এতসব নেয়ামত পাওয়ার কারণ বর্ণনা করে বলা হচ্ছে, পার্থিব জীবনে তোমরা যেসব সৎকাজ বা নেক আমল করেছিলে এসব নেয়ামত হচ্ছে সেসবের প্রতিদান। অর্থাৎ তোমাদের মুক্তির চাবিকাঠি হচ্ছে তোমাদের নেক আমল। শেষ আয়াতে জান্নাতি ফলের কথা বলা হয়েছে। জান্নাতের গাছগুলোতে সব সময় ফল ধরে থাকবে এবং সেখানকার অধিবাসীরা যখন খুশি এবং যে পরিমাণে খুশি এসব ফল খেতে পারবে।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ঈমানদার স্বামী বা স্ত্রী জান্নাতে তাদের ঈমানদার স্ত্রী বা স্বামীদের সঙ্গে থাকবে।
২- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যারা পার্থিব জীবনে হারাম ও অশ্লীল দৃশ্য উপভোগ থেকে নিজেদেরকে বিরত রেখেছে তারা জান্নাতে সুশ্রী সহধর্মিনীদের দর্শন করে নিজেদের চোখ জুড়াতে পারবে। আর সেদিনের সেই সুখের সঙ্গে পার্থিব জীবনের সুখের কোনো তুলনাই হয় না।
৩- পার্থিব জীবনের আনন্দ ও আরাম-আয়েশ অপূর্ণাঙ্গ ও ক্ষণস্থায়ী। একমাত্র জান্নাতে মানুষ পরিপূর্ণ সুখ ও আরাম-আয়েশ ভোগ করার সুযোগ পাবে।
৪- জান্নাতের এতসব নেয়ামত উপভোগ করতে চাইলে আমাদেরকে বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। নেক আমল ছাড়া জান্নাত পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছু নয়।
সূরা জুখরুফের ৭৪ থেকে ৭৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
إِنَّ الْمُجْرِمِینَ فِی عَذَابِ جَهَنَّمَ خَالِدُونَ ﴿٧٤﴾ لا یُفَتَّرُ عَنْهُمْ وَهُمْ فِیهِ مُبْلِسُونَ ﴿٧٥﴾ وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَکِنْ کَانُوا هُمُ الظَّالِمِینَ ﴿٧٦﴾
“নিশ্চয় অপরাধীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। ”(৪৩: ৭৪)
“ওদের [শাস্তি] লাঘব করা হবে না এবং ওরা তাতে (শাস্তি ভোগ করতে করতে) হতাশ হয়ে পড়বে।”(৪৩: ৭৫)
“আমি ওদের প্রতি জুলুম বা অন্যায় করিনি, বরং ওরা নিজেরাই ছিল জালিম। ”(৪৩: ৭৬)
পরকালে জান্নাতবাসীর অবস্থা বর্ণনা করার পর এই তিন আয়াতে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে অপরাধী ও পাপী ব্যক্তিদের অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। দুই দলের এই পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ যাতে সত্য ও সরল পথ বেছে নিতে পারে। এখানে বলা হচ্ছে: নেক আমলকারী ব্যক্তি যেমন জান্নাতে চিরকাল থাকবে তেমনি পাপী ব্যক্তিরাও জাহান্নামে অনন্তকাল শাস্তি পেতে থাকবে।
অবশ্য হাদিসে এসেছে, সব পাপী ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে না। সেইসব মানুষ জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে যারা পার্থিব জীবনে আরো হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকলেও খোদাদ্রোহিতা এবং জুলুম চালিয়ে যেত। অর্থাৎ এসব মানুষ দুনিয়ার জীবনে এত বেশি স্বেচ্ছাচারী ও অহংকার ছিল যে, তারা কখনো আল্লাহ, রাসূল, পরকাল ইত্যাদির কথা ভেবে দেখারই সুযোগ পায়নি। এ কারণে জাহান্নামে যাওয়ার পর আর কোনোদিন মুক্তি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে তারা হতাশ হয়ে পড়বে।
জাহান্নামের শাস্তি ভোগকারী ব্যক্তিদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা যে অন্যায় করেননি পরের আয়াতের সেকথা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই পরিণতির জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান না এনে এবং জুলুম করার মাধ্যমে জাহান্নামের আজাবে পতিত হওয়ার উপযুক্ত হয়েছে। পার্থিব জীবনেও আদালতে অপরাধীদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে। কোনো কোনো অপরাধ অতি অল্প সময়ের জন্য সংঘটিত হলেও সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি শাস্তি, এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পবিত্র কুরআনে সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা পাশাপাশি বর্ণনা করা হয়েছে যাতে মানুষ অহংকারী বা হতাশ হয়ে না পড়ে।
২- নেক আমলের মাধ্যমে মানুষ যেমন জান্নাতে প্রবেশ করার সুযোগ পায় তেমনি খারাপ কাজ মানুষকে জাহান্নামে টেনে নিয়ে যায়।
৩- আল্লাহ তায়ালা কারো প্রতি জুলুম করেন না বরং তিনি মন্দকর্মকারী জালিমদের শাস্তি দেন।
সূরা জুখরুফের ৭৭ ও ৭৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَنَادَوْا یَا مَالِکُ لِیَقْضِ عَلَیْنَا رَبُّکَ قَالَ إِنَّکُمْ مَاکِثُونَ ﴿٧٧﴾ لَقَدْ جِئْنَاکُمْ بِالْحَقِّ وَلَکِنَّ أَکْثَرَکُمْ لِلْحَقِّ کَارِهُونَ ﴿٧٨﴾
“ওরা চিৎকার করে বলবে: হে মালেক [ও জাহান্নামের অধিকর্তা]! তোমার প্রতিপালক আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিন [এবং আমাদেরকে মেরে ফেলুন]। সে বলবে, তোমরা তো [এখানে চিরকাল] অবস্থান করবে [এবং পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই]।”(৪৩:৭৭)
“আমি তো তোমাদের কাছে সত্য নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই ছিলে সত্যকে অপছন্দকারী।”(৪৩:৭৮)
অপরাধী ও জালিম ব্যক্তিদের জন্য জাহান্নামের আজাব এতটা ভয়াবহ হবে যে, তারা তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজবে এবং বুঝতে পারবে, মৃত্যু ছাড়া তাদের মুক্তির আর কোনো উপায় নেই। এ অবস্থায় তারা জাহান্নামের অধিকর্তা ফেরেশতা ‘মালেক’কে বলবে, সে যেন আল্লাহকে অনুরোধ করে তাদের মৃত্যুর ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু উত্তরে মালেক ফেরেশতা বলবে: জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় তোমাদের নেই বরং তোমাদেরকে এখানে চিরকাল শাস্তি ভোগ করতে হবে।
পার্থিব জগতের বাহ্যিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে পরিত্রাণ পেতে পারে যদিও তা ইসলামে কঠোরভাবে হারাম। কিন্তু পরকালে আত্মহত্যার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি ভয়ঙ্কর আগুনে জ্বলতে থাকা অবস্থায়ও তাদের মৃত্যু হবে না।
পরের আয়াতে গোনাহগার ব্যক্তিদের জাহান্নামে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে: তারা পৃথিবীতে সত্য শুনতে পছন্দ করত না। আল্লাহ ও পরকালের কথা উঠলেই তাদের মেজাজ বিগড়ে যেত। তারা সারাক্ষণ তাদের ইন্দ্রিয়পূজায় লিপ্ত ছিল। তারা যে শুধু সত্য প্রত্যাখ্যান করেছে তাই নয় বরং সত্য শুনতে এবং সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতেও রাজি হয়নি।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- দুনিয়ার জীবনে আমাদের কথা ও কাজের ব্যাপারে সাবধান হতে হবে যাতে পরকালে আমাদেরকে মৃত্যু কামনা করতে না হয়; যে কামনা কোনোদিন পূর্ণ হবে না।
২- আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সতর্ক করার পরই কেবল শাস্তি দেন। কাজেই জাহান্নামে কেবলমাত্র তারাই যাবে যারা সত্য উপলব্ধি করার পর বিদ্বেষবশত তার বিরোধিতা করে।
৩- সত্য মেনে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পনই হচ্ছে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার চাবিকাঠি। পক্ষান্তরে সত্যের বিরোধিতা উভয় জীবনে মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ বয়ে আনে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।