সূরা জুখরুফ : আয়াত ৭৯-৮৪ (পর্ব-১২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এখন জানবো এই সূরার ৭৯ থেকে ৮০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ কি বলেছেন:
أَمْ أَبْرَمُوا أَمْرًا فَإِنَّا مُبْرِمُونَ ﴿٧٩﴾ أَمْ یَحْسَبُونَ أَنَّا لا نَسْمَعُ سِرَّهُمْ وَنَجْوَاهُمْ بَلَى وَرُسُلُنَا لَدَیْهِمْ یَکْتُبُونَ ﴿٨٠﴾
“তারা বরং [সত্যের বিরোধিতা এবং সত্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে] চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং [তাদের ব্যাপারে] আমারও কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া আছে।” (৪৩:৭৯)
“তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও কানকথা শুনতে পাই না? অবশ্যই শুনতে পাই। আমার বার্তাবাহক [ফেরেশতারা] তাদের কাছে উপস্থিত রয়েছে এবং [সবকিছু] লিপিবদ্ধ করে।”(৪৩:৮০)
গত আসরের শেষাংশে কাফির ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে সত্য প্রত্যাখানের কথা বলা হয়েছিল। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: তারা শুধু সত্য প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং অস্ত্র ধরেছে। তারা সত্যকে দুর্বল করা এবং তাকে নিভিয়ে ফেলার লক্ষ্যে নানামুখী ষড়যন্ত্র এঁটেছে। সত্যকে ধ্বংস ও পরাজিত করতে তারা কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু তারা একথা জানত না যে, তাদের বিপরীতে রয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা; যেকোনো বিষয়ে তাঁর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। কাফির ও মুশরিকরা যা করতে চাইবে তার সবই বাস্তবায়িত হয়ে যাবে- বিষয়টি মোটেই এমন নয়।
খোদাদ্রোহী এসব ষড়যন্ত্রকারী মনে করে, তাদের গোপন আঁতাতের বৈঠকগুলি সম্পর্কে আল্লাহ কিছুই জানেন না, তিনি তাদেরকে দেখতে পান না এবং তাদের কথা শুনতে পান না! অথচ তারা গোপন বৈঠকে ফিসফিস করে অথবা কানে কানে যেসব কথা বলে আল্লাহ তায়ালা তাও শুনতে পান। কারণ, তাঁর কাছে প্রকাশ্য ও গোপন সব বিষয় একইরকম। এছাড়া, ঐশী ফেরেশতারাও সর্বত্র উপস্থিত রয়েছে যারা সারাক্ষণ মানুষের কথা ও কাজ, এমনকি তাদের গোপনতম বিষয়গুলিকে লিপিবদ্ধ করে এবং তাদের কাছে কোনো কিছুই গোপন থাকে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- যেকোনো সিদ্ধান্ত, যত কঠিন ও চূড়ান্তই হোক না কেন তা আল্লাহর অজ্ঞাতে থাকে না এবং তাঁর সম্মতি ছাড়া বাস্তবায়িত হয় না।
২- খোদাদ্রোহীরা ভাবে, আল্লাহ তাদের গোপন বিষয়গুলো জানেন না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ যা কিছু বলে ও করে তা সঙ্গে সঙ্গে লিপিবদ্ধ হয়ে যায় এবং কোনো কিছুই ফেরেশতাদের দৃষ্টি এড়ায় না।
সূরা জুখরুফের ৮১ থেকে ৮২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ إِنْ کَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ فَأَنَا أَوَّلُ الْعَابِدِینَ ﴿٨١﴾ سُبْحَانَ رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا یَصِفُونَ ﴿٨٢﴾
“[হে রাসূল আপনি তাদের] বলুন: দয়াময় আল্লাহর কোনো সন্তান থাকলে আমি হতাম [তার] উপাসকগণের অগ্রণী।”(৪৩: ৮১)
“তারা যা আরোপ করে তা হতে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অধিপতি এবং আরশের পালনকর্তা পবিত্র ও মহান।”(৪৩: ৮২)
এই সূরার প্রথমদিকে বলা হয়েছে, মক্কার মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যাসন্তান বলে মনে করত। পরবর্তীতে খ্রিস্টানদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, তারা হযরত ঈসা (আ.)কে আল্লাহর পুত্রসন্তান বলে ভাবত। এই দুই আয়াতে মুশরিকদের সেসব ভ্রান্ত বিশ্বাস খণ্ডন করে বলা হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালার যদি সন্তান থাকত তাহলে সেই সন্তানের ইবাদত করা বাধ্যতামূলক হতো এবং নবী-রাসূলগণ সবার আগে সে কাজ করতেন। অথচ, প্রথমত আল্লাহ তায়ালা কোনো স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করেননি; দ্বিতীয়ত, তিনি নিজেকে ছাড়া তাঁর কোনো সৃষ্টির ইবাদত করার নির্দেশ দেননি।
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, যে আল্লাহ আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আরশে আজিমের প্রতিপালক তার কোনো সন্তানের প্রয়োজন নেই। তিনি এক অসীম সত্ত্বা এবং গোটা সৃষ্টিজগতের ওপর তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে সন্তান তারই প্রয়োজন হয় যার বংশ রক্ষা করা দরকার; কিংবা যে বৃদ্ধ বয়সে অপরের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। এছাড়া, সন্তান নিতে হলে একটি দেহের প্রয়োজন এবং নির্দিষ্ট স্থান ও কালের মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে হয়। কিন্তু যে আল্লাহ গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং এসব সৃষ্টি পরিচালনা করছেন তার এসব কিছুর প্রয়োজন নেই। কোনো কাজেই তার সন্তান বা অন্য কারো সাহায্য গ্রহণ করতে হয় না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বিরোধীদের সঙ্গে বিতর্কের সময় প্রথমে তাদের বক্তব্যকে সঠিক বলে ধরে নিয়ে তার পরিণতির কথা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। এর ফলে তারা নিজেরাই তাদের বক্তব্যের অসারতার প্রমাণ পাবে।
২- মানুষের যেসব ত্রুটি কিংবা প্রয়োজন রয়েছে তা থেকে আল্লাহ তায়ালা সম্পূর্ণ পবিত্র। কাজেই আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়ে তাঁকে কখনো মানুষের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। যদি তা করা হয় তাহলে তা হবে চরম বিভ্রান্তি কারণ, আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা চলে না। তিনি অদ্বিতীয় ও একক সত্ত্বা।
৩- আসমানসমূহ ও জমিনের সবকিছু আল্লাহর নির্দেশে পরিচালিত হয় এবং এগুলো সব তাঁর ইচ্ছার মুখাপেক্ষী।
সূরা জুখরুফের ৮৩ ও ৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَذَرْهُمْ یَخُوضُوا وَیَلْعَبُوا حَتَّى یُلاقُوا یَوْمَهُمُ الَّذِی یُوعَدُونَ ﴿٨٣﴾ وَهُوَ الَّذِی فِی السَّمَاءِ إِلَهٌ وَفِی الأرْضِ إِلَهٌ وَهُوَ الْحَکِیمُ الْعَلِیمُ ﴿٨٤﴾
“অতএব আপনি তাদেরকে ছেড়ে দিন তারা মগ্ন থাকুক বেহুদা কথায় এবং মত্ত থাকুক খেল-তামাশায় যে দিনের ওয়াদা দেয়া হয়েছে তা দেখতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত।”(৪৩:৮৩)
“আর তিনিই সত্য ইলাহ আসমানে এবং তিনিই সত্য ইলাহ যমীনে[ও]। আর তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।”(৪৩:৮৪)
নবী-রাসূলগণ মানবজাতিকে হেদায়েত করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁরা মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নানাভাবে তাদেরকে সত্য পথে হেদায়েত করার চেষ্টা করতেন। এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: মানুষের এই কল্যাণকামিতা ও সহানুভূতির একটি সীমা থাকে। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে সত্য গ্রহণ করতে না চায় ততক্ষণ তার পক্ষে হেদায়েত পাওয়া সম্ভব হয় না। আর এ অবস্থায় তাকে হেদায়েত হতে বাধ্য করাও যায় না। তাদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিতে হবে যাতে তারা তাদের পথভ্রষ্টতার পরিণতি দেখতে পায়। হয়তো পার্থিব জীবনেই কোনো কঠিন পরিণতি দেখার পর তারা সঠিক পথে ফিরে আসবে। আবার এমনও হতে পারে যে, সারাজীবন তারা ভ্রান্ত পথে অটল থেকেও কোনো খারাপ পরিণতির শিকার হবে না বরং কিয়ামতের দিন নিজেদের মন্দ ও নোংরা কাজের পরিণতি দেখতে পাবে।
পরের আয়াতে আল্লাহ যে মানুষের ঈমান আনার মুখাপেক্ষী নন সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে: মানুষ যেন না ভাবে যে, আল্লাহ তাদের ইবাদতের মুখাপেক্ষী এবং তারা ইবাদত না করলে আল্লাহর মর্যাদা হ্রাস পাবে। প্রকৃতপক্ষে তিনি আসমানসূহ ও জমীনের সৃষ্টিকর্তা এবং অস্তিত্বে থাকা সবকিছুর পালনকর্তা। অন্য কথায় যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং পালন করছেন তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। কাজেই ফেরেশতা, মূর্তি, চাঁদ, সূর্য বা তারকা- কেউই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য হতে পারে না। এগুলোর সবকিছুই আল্লাহর সৃষ্টি এবং সর্বোতভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ সবকিছুর খবর রাখেন এবং নিজের অসীম প্রজ্ঞা ও বুৎপত্তি দিয়ে বিশ্বজগত পরিচালনা করেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণ মানুষকে দ্বীনের পথে দাওয়াত দিতে এসেছেন, কাউকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে কিংবা মানুষকে অনুনয়-বিনয় করতে নয়।
২- মানুষের সামনে সত্য তুলে ধরার পর তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। বরং সত্য পথ গ্রহণ কিংবা বিভ্রান্তির জীবনে অটল থাকার ব্যাপারে তাকে তার নিজের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
৩- আল্লাহ তায়ালা কোনো কাজেই কোনো মানুষের মুখপেক্ষী নন। আর তাদের ইবাদতের মুখাপেক্ষী হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। যখন মানবজাতি ছিল না তখনও তিনি ইলাহ ছিলেন এবং যখন আমরা দুনিয়া থেকে চলে যাব তখনও তিনি ইলাহ-ই থাকবেন।
৪- তিনিই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য যার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অসীম।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।