সূরা জুখরুফ : আয়াত ৮৫-৮৯ (পর্ব-১৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জুখরুফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার সর্বশেষ পর্ব। পবিত্র কুরআনের ৪৩তম এই সূরায় ৮৯টি আয়াত রয়েছে। এখন জানবো এই সূরার ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ কি বলেছেন:
وَتَبَارَکَ الَّذِی لَهُ مُلْکُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَا بَیْنَهُمَا وَعِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَإِلَیْهِ تُرْجَعُونَ ﴿٨٥﴾
“আর তিনি বরকতময়, যার কর্তৃত্বে রয়েছে আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সবকিছু; আর কিয়ামতের জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।”(৪৩:৮৫)
গত আসরে আমরা বলেছিলাম, আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন বলে ইবাদতে তাঁর সমকক্ষ কেউ হতে পারে না। আসমান সমূহের ফেরেশতা ও জমিনের মানুষ সবার একমাত্র মাবুদ তিনি এবং আমাদেরকে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে।
এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: আল্লাহর এই ইবাদতের কারণ হচ্ছে গোটা বিশ্বজগত তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আসমানসমূহ ও জমিন এবং এর মধ্যবর্তী স্থানে যা কিছু আছে তার সবকিছু তাঁর আদেশ মেনে চলে এবং তিনি ছাড়া বিশ্বজগতের ওপর আর কারো কর্তৃত্ব নেই। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তু ও এগুলো পরিচালনার নিয়মকানুন তিনি সৃষ্টি করেছেন।
শুধুমাত্র এই পার্থিব জগত নয় সেইসঙ্গে কিয়ামত দিবসের মালিকও আল্লাহ তায়ালা। কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে তার দিনক্ষণ একমাত্র তিনিই জানেন। এই আয়াতে আরো বলা হচ্ছে: মৃত্যুর পর তোমাদের সবাইকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং তাঁর হাতেই তোমাদের ভাগ্য নির্ভর করছে। কাজেই তোমাদের যে কেউ দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ চাইবে তাকে আল্লাহর দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করতে হবে। যেসব কাজ করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা করতে হবে এবং যেসব কাজে তিনি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হন সেসব পরিহার করতে হবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১- বিশ্বজগতের শুরু ও সমাপ্তিতে এবং কিয়ামত দিবসে আমাদের ভাগ্য আল্লাহ তায়ালার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
২- কিয়ামত দিবসের জ্ঞান আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নেই।
সূরা জুখরুফের ৮৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلا یَمْلِکُ الَّذِینَ یَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ الشَّفَاعَةَ إِلا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ یَعْلَمُونَ ﴿٨٦﴾
“আর তিনি ছাড়া যাদেরকে তারা আহবান করে [ও উপাসনা করে] শাফায়াত বা সুপারিশ করার কোনো অধিকার তাদের নেই; তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়।”(৪৩: ৮৬)
মুশরিকদের শিরক করার অন্যতম কারণ হলো তারা ধারনা করে, এমন কিছু বস্তু বা মানুষ আছে যারা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য শাফায়াত বা সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখে এবং তারা তাদের জন্য আল্লাহর রহমত এনে দিতে পারে। এ কারণে তারা সেসব বস্তু বা ব্যক্তির কাছে ধর্না দেয় এবং তাদের ইবাদত করে।
এই আয়াত বলা হচ্ছে: আল্লাহর দরবারে শাফাতের ব্যবস্থা থাকবে। তবে তোমরা যাদের কথা ধারণা করছো তাদের শাফায়াত করার কোনো ক্ষমতা থাকবে না। কিয়ামতের সেই কঠিন দিনে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করবেন তাকে শাফায়াতের ক্ষমতা প্রদান করবেন। প্রকৃতপক্ষে তারাই শাফায়াতের ক্ষমতা অর্জন করবেন যারা পার্থিব জীবনে সত্যপথে অটল ছিলেন এবং মানুষের জন্য এই পথের দিশারীতে পরিণত হয়েছিলেন।
যারা আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ মেনে নিয়েছেন তারা সত্যের সামনে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করেছেন এবং তারা শুধুমাত্র সেই পথে চলেন যে পথ মহান আল্লাহ মানব জাতির সৌভাগ্য অর্জনের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ ধরনের উন্নত গুণাবলীসম্পন্ন মানুষেরা শাফায়াতকারী হওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং তারা এটাও জানেন কাদের জন্য তাদেরকে শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া হবে। তারা আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় তাদের জন্য শাফায়াত করবেন যারা শাফায়াত পাওয়ার উপযুক্ত।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- তওবার মাধ্যমে যেমন আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা যায় তেমনি প্রত্যাবর্তনের আরেকটি পথ হচ্ছে শাফায়াত, অবশ্য এটি হতে হবে আল্লাহর বিশেষ বান্দা বা ওলীদের মাধ্যমে।
২- যারা আল্লাহর পথে চলেন তাদের উচিত অন্যদেরকেও একই পথে চলতে সাহায্য করা এবং এই পথে নিয়ে আসা। আর এটিই হচ্ছে প্রকৃত শাফায়াত।
সূরা জুখরুফের ৮৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَهُمْ لَیَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى یُؤْفَکُونَ ﴿٨٧﴾
“আর যদি আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। অতঃপর তারা কীভাবে পথভ্রষ্টতার দিকে ফিরে যাচ্ছে?”(৪৩:৮৭)
আগের আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্য বস্তু ও ব্যক্তিদের কাছে শাফায়াত চাওয়ার শিরকি রীতি সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই আয়াতে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে মুশরিকদেরকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: তোমরা আল্লাহকে তোমাদের নিজেদের ও বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও কিভাবে গয়রুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাও এবং তাদের উপাসনা করো? অথচ উপাসনা পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনি যিনি গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করছেন। তোমরা এ কেমন পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত রয়েছ? বিশেষত্বহীন কিছু মানুষ ও বস্তুর সামনে নিজেরদের মাথানত করে দিচ্ছে এবং ভাবছ এরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য সুপারিশ করবে?
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মুশরিকরা পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে মানে। কিন্তু তাদের মূল সমস্যা তারা ইবাদত করে অন্য কিছুর এবং বিশ্বজগত পরিচালনায়ও আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার বানায়।
২- সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। এ তিনটির কোনো একটিতেও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করা যাবে না।
সূরা জুখরুফের ৮৮ ও ৮৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَقِیلِهِ یَا رَبِّ إِنَّ هَؤُلاءِ قَوْمٌ لا یُؤْمِنُونَ ﴿٨٨﴾ فَاصْفَحْ عَنْهُمْ وَقُلْ سَلامٌ فَسَوْفَ یَعْلَمُونَ ﴿٨٩﴾
“আর আমার রাসূলের বক্তব্য হচ্ছে এই: হে আমার রব! এই সম্প্রদায়তো ঈমান আনবে না। ” (৪৩:৮৮)
“কাজেই আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং বলুন, সালাম। অতঃপর তারা শীঘ্রই জানতে পারবে। ”(৪৩:৮৯)
এই দুই আয়াতের মাধ্যমে সূরা জুখরুফের সমাপ্তি টেনেছেন আল্লাহ তায়ালা। এখানে তৌহিদ ও শিরক সংক্রান্ত আলোচনার উপসংহারে বলা হচ্ছে: মুশরিকদেরকে তৌহিদের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আল্লাহর রাসূল (সা.) দিনরাত পরিশ্রম করার পরও কিছু মানুষ ঈমান আনেনি এবং তাদের মধ্যে ঈমানে দিকে প্রত্যাবর্তনের কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। তারা সত্যপথ সঠিকভাবে উপলব্ধি করা সত্ত্বেও অহংকার ও বিদ্বেষবশতঃ তা গ্রহণ করতে নারাজ। তারা পার্থিব জগতের ক্ষণিকের ইন্দ্রীয়পূজা ও ভোগবিলাস ত্যাগ করতে পারে না বলে সত্য গ্রহণ করতে রাজি হয় না।
এ কারণে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলেন: যখন তাদের কানে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া হয়ে গেছে তখন আর আপনার কোনো দায়িত্ব নেই। এখন আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং তাদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিন। কারণ তাদেরকে পীড়াপীড়ি করলে তারা ভাববে, তাদের ঈমান আনার ওপর আপনার কোনো স্বার্থ জড়িয়ে আছে অথবা আপনি তাদেরকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে চান। তার চেয়ে আপনি বরং তাদের কাছ থেকে বিদায় নিন এবং তারা যেভাবে চলতে চায় চলতে দিন। এভাবে তাদেরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়ার পরও আয়াতের শেষাংশে অর্থপূর্ণ হুমকি দিয়ে মুশরিকদের সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে: শিগগিরই তারা তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেখতে পাবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ধর্মীয় নেতা ও দাওয়াতের কাজে জড়িতরা যেন কখনোই এ আশা না করেন যে, তাদের আহ্বান শুনে সবাই ঈমানের পথে ছুটে আসবে এবং সত্য গ্রহণ করবে।
২- সত্যের দাওয়াত তুলে ধরার পর কাউকে বাধ্য করা বা অনুনয় বিনয় করার দরকার নেই। বরং তাদেরকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সত্য গ্রহণ বা বর্জন করার স্বাধীনতা দিতে হবে যাতে তারা স্বাধীনভাবে যেকোনো একটি পথ বেছে নিতে পারে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।