ইরাক -আফগানিস্তান
ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের অর্জন শূন্য: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন
আফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন অভিযানের অর্জন শূন্য। কেন তারা আফগানিস্তানে অভিযান চালিয়েছে সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। ইরাকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে অভিযান চালিয়েছে। দেশ দুটির মারাত্মক ক্ষতি করেছে কিন্তু তাদের অর্জন শূন্য। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি আরও বলেন, আমেরিকা বর্তমানে বিশ্বের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আস্থার জায়গা হারিয়েছে। আগামীতে তারা বিশ্বের কোনো কোনো দেশের সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সেই দেশ চীন বা এশিয়ার অন্য কোনো দেশ হতে পারে। তবে আমেরিকার শক্তি এখন অনেক কমে গেছে বিশ্বের কাছে।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব, ড.এম সাখাওয়াত হোসেন, ইরাকে মার্কিন সরকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছে। একইভাবে আফগানিস্তান থেকে তারা সেনা প্রত্যাহার করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- এই দুই দেশে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে আমেরিকা কি অর্জন করে গেল?
ড.এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন, আফগানিস্তান ও ইরাক-এই দুই দেশ থেকে আমেরিকা শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছে। তবে দেশ দুটোকে তছনছ করে দিয়ে গেছে।
প্রথমে আফগানিস্তানের কথা বলি, আমেরিকার পলিসি মেকাররা এখনও পর্যন্ত স্পস্ট করে বলতে পারেনি তারা কেন আফগানিস্তানে এসেছিল! তারা পরিস্কার করে বলতে পারছে না কোন অবজেকটিভে তারা এখানে এসেছিল। এত অস্ত্র, এত সৈন্য এবং এত অর্থ ব্যয় করে সেখানে কেন এসেছিল এবং এখন তারা ফিরে যাচ্ছে কি অর্জন করে-এর কোনো ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও দিতে পারছে না। গত বিশ বছরে আমেরিকায় যতগুলো প্রেসিডেন্ট ছিল তারাও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। একমাত্র তারা যেটা ব্যাখ্যা করেছে বা করছে সেটি হচ্ছে- ওসামা বিন লাদেনকে মারতে পেরেছে এবং আল কায়েদাকে অনেকটা ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। এটুকু ছাড়া আফগানিস্তানে গত ২০ বছরে তাদের কোনো অর্জন আমি দেখছি না। তবে তারা দেশটিকে বিভক্ত করে দিয়েছে। পরনির্ভর করে দিয়েছে। আমি বলব আফগানিস্তানে আমেরিকার কৌশলগত পরাজয় হয়েছে। আমেরিকা আফগানিস্তানে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন পয়সা খরচ করেছে। আর এই খরচের বিনিময়ে আমেরিকার অর্জনের পরিমাণ তাদের খাতায় শূন্য।
রেডিও তেহরান: আপনি যদি একটু ইরাক সম্পর্কে বলেন।
ড.এম সাখাওয়াতা হোসেন: যে অজুহাতে তারা ইরাকে ঢুকেছিল সেটি মিথ্যা একটি অভিযোগ ও অজুহাত। এইমলেস একটি অজুহাত। সরাসরি মিথ্যা কথা বলে তারা ইরাকে ঢুকেছিল। ইরাককে একটি আন্তঃসেকটরিয়ান ডিভাইডের মধ্যে ফেলে রেখে গেছে। সেখানে শিয়া-সুন্নি-কুর্দি এই তিন বিভাজনের মধ্যে ফেলে একটি দুর্বল দেশে পরিণত করে আমেরিকা সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। মারাত্মক অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে ইরাকের। এখানে হয়তো তাদের ব্যবহারিক কিছু অর্জন তাদের আছে। তারা সাদ্দামকে ঝুলিয়েছে। আমার যেটা মনে হচ্ছে- ইরাকে তাদের আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে চেক দেয়ো; ইরানকে কোণঠাসা করা। আর যদি সেটাই তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তারা সেটা পারেনি। ইরাকে তাদের ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। সেনা মারা গেছে। এখনও তাদের উপর আক্রমণ হচ্ছে। সেখান থেকে তাদের আর পাওয়ার কিছু নেই। ওভারঅল মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় যেটা করে গেছে সেরকম লক্ষ্যহীন অভিযান আমেরিকার ইতিহাসে আর নেই।
রেডিও তেহরান: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আপনি বললেন- আফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন অর্জন শূন্য। তো আপনি জানেন যে খুব কাছাকাছি সময়ে আমেরিকা আফগানিস্তান এবং ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। দীর্ঘ সময় এই যুদ্ধ তারা চালিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কি কি প্রভাব পড়েছে বলে আপনার মনে হয়?
ড.এম সাখাওয়াত হোসেন: দেখুন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা যে গোটা বিশ্বে বিশাল একটা প্রভাব তৈরি করেছিল। তাদের তখন লক্ষ্য ছিল কমিউনিজমকে ঠেকানো। তাতে তারা সফল হয়নি। পরবর্তী পর্যায়েও কমিউনিস্ট ঠেকানোর নাম করে বিভিন্ন দেশকে একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়। সেই পরিস্থিতি স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর ইসলাম ফোবিয়ার নামে তারা একইধরনের কাজ করেছে। কিন্তু আমেরিকা এটা করতে গিয়ে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্ব স্ট্রাটিজিতে এবং রাজনীতিতে তারা আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিকভাবে আমেরিকার যে একচ্ছত্র আধিপত্য, প্রভাব কিংবা বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা তৈরি হয়েছিল সেই প্রভাব অনেকখানি এখন কমে যাবে। তারা চায়নাকে নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরির চেষ্টা করছে সেটা বিশ্বের মানুষ খুব একটা বিশ্বাস করবে বলে আমার মনে হয় না।
রেডিও তেহরান: আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেও ইরাক থেকে আমেরিকা তাদের সেনা কিন্তু প্রত্যাহার করে নিচ্ছে না বরং সামরিক উপদেষ্টা, প্রশিক্ষক এরকম বিভিন্ন নামে এসব সেনাকে ইরাকি রেখে দেয়া হবে। এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
ড.এম সাখাওয়াত হোসেন: এটার দুটো কারণ আছে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত আমরা সবাই জানি ইসরাইলকে এ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার শক্তিটা ছিল আমেরিকার। এখন ইসরাইল বহুলাংশে আমেরিকার সেই শক্তির উপর নির্ভর করছে না। কারণ তারা বর্তমানে জোর জবরদস্তি করে ফিলিস্তিনের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তারা টেকনোলজিতে বলা চলে আমেরিকার প্রায় সমকক্ষ হয়ে গেছে।
রেডিও তেহরান: ইরাকের প্রতিরোধকামী সংগঠনগুলো মার্কিন সেনা রাখার বিরোধিতা করছে এবং তারা বলছে ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করার জন্যই আমেরিকা এই কৌশল অবলম্বন করেছে। কতটা যুক্তিযুক্ত এই বক্তব্য?
ড.এম সাখাওয়াত হোসেন: আমার কাছে একেবারে সরাসরি মনে হয় না ইসরাইলকে সাপোর্ট করার জন্য কিছু উপদেষ্টা ইরাকে রেখে যাচ্ছে। উপদেষ্টা এখানে না রাখলেও আমরা জানি প্রত্যেকটি দেশে যেখানে তাদের দূতাবাস এবং কূটনীতিক আছে- সেখানে এমনিতেও অনেক উপদেষ্টারা থাকে। কিছু দেখা যায় কিছু দেখা যায় না। কূটনীতির আড়ালে অনেক কিছুই থাকতে পারে। তবে ঘোষণা দিয়ে কিছু সেনা উপদেষ্টা হিসেবে রেখে যাওয়ার বিষয়টি আমি মনে করি যে- আমেরিকানদের মনস্তাত্বিক একটা বিষয়। তারা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। আমেরিকানরা তাদের প্রশাসনকে প্রশ্ন করছে কি হলো ইরাক ও আফগানিস্তানে? দুই দশক ধরে আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় যুদ্ধ করেছি! সেই জায়গায় তারা আমেরিকানদের একথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে আমরা সেখানে ওদের সাথে একটা চুক্তি করে উপদেষ্টা রেখে এসেছি। আমরা সেরকম বানিয়ে দিয়ে এসেছি যাতে তারা তাদের নিজেদের দেশ নিজেরা পরিচালিত করতে পারে। আমরা যেটাকে বলি স্ক্রিনসেভার। অর্থাৎ একটি ছবি তারা সেখানে রেখে যাচ্ছে। আমেরিকান কলোনিয়াল যে মনোভাব সেটা তাদের জন্য স্যুট করেনি। সম্মান রক্ষার একটি কৌশল তারা তৈরি করেছে। তারা তাদের জনগণকে এটা বুঝাচ্ছে যে- তারা ইরাককেও ছেড়ে যায় নি; আফগানিস্তানকেও ছেড়ে যায় নি। আমরা নজর রাখছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে আমেরিকার শক্তি অনেক কমে গেছে। আমি মনে করি আমেরিকা আগামীতে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে অন্যান্য দেশের দ্বারা। সেই চ্যালেঞ্জ কেমন হবে সেটা এখনই বলা যাবে না। আমেরিকার বিরুদ্ধে সেই চ্যালেঞ্জের শক্তিধর দেশটি চায়না হবে নাকি অন্য কোনো দেশ হবে সেকথা এখন বলা যাচ্ছে না।
রেডিও তেহরান: জনাব ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, আপনি চমৎকার করে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং সেখানে আমেরিকার অর্জন নিয়ে বিশ্লেষণ করলেন। সবশেষে আপনি আমেরিকাকে আগামী দিনে মস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। আগামী সেই দিনগুলোতে বিশ্ব রাজনীতি কোথায় যাবে সে সম্পর্কে অন্য কোনো বৈঠকে কথা বলব। তো এতক্ষণ রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ড.এম সাখাওয়াত হোসেন: ধন্যবাদ আপনাকেও।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২