আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্ব থেকে সূরা জাসিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু করব। এবার এই সূরার ১ থেকে ৩৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

حم ﴿١﴾ تَنْزِیلُ الْکِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِیزِ الْحَکِیمِ ﴿٢﴾ إِنَّ فِی السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ لآیَاتٍ لِلْمُؤْمِنِینَ ﴿٣﴾

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”

“হা-মিম।”(৪৫:১)

“[এই] কিতাব নাজিল হয়েছে মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে।”(৪৫:২)

“নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনে মুমিনদের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।”(৪৫:৩)

সূরা জাসিয়া মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং অন্যান্য মাক্কী সূরার মতো এই সূরায়ও তাওহিদ বা একত্ববাদ, পথভ্রষ্টদের প্রতি সতর্কবার্তা এবং মানুষের পরকালীন জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

এই সূরা শুরু হয়েছে হুরুফে মুকাত্তায়াত- ‘হা-মিম’ দিয়ে। এর পরের আয়াতে পবিত্র কুরআন নাজিল সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে বলে এই হুরুফ দিয়ে কুরআনের অলৌকিকত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, এই আলিফ-বা-তা-সা অক্ষরগুলো দিয়ে কুরআনের আয়াতগুলো সাজানো হলেও কোনো মানুষের পক্ষে এরকম একটি সূরা বা একটি আয়াত রচনা করা সম্ভব নয়।

পরের আয়াতে কুরআন নাজিলের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহর দু’টি গুণবাচক নাম অর্থাৎ ইজ্জত বা সম্মান ও হিকমত বা প্রজ্ঞার কথা তুলে ধরা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে বলছেন, তোমরাও সম্মানিত জীবনযাপন করবে এবং কোনো অবস্থায় জিল্লতি বা অবমাননাকর জীবনের মুখোমুখি হতে হয় এমন কোনো কাজ করবে না। সেইসঙ্গে তোমরা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে নিজেদের জীবন গঠন করবে এবং অনর্থক ও বাজে কাজ করা থেকে বিরত থাকবে।

এর পরের আয়াতে সৃষ্টিজগতে আল্লাহ তায়ালার মাহাত্ম্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে বলা হচ্ছে: এই কুরআন সেই সত্ত্বার পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে যিনি আসমানসূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। তিনি কুরআনে যেসব আদেশ নিষেধ করেছেন তা মানুষ ও বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।  কাজেই একজন ঈমানদার ব্যক্তি শুধু ঐশী কিতাবের আয়াতগুলোর দিকেই দৃষ্টি দেয় না, সেইসঙ্গে গভীর মনযোগের সঙ্গে আসমানসমূহ ও জমিন অবলোকন করে যাতে এই প্রকৃতিতে আল্লাহর নিদর্শন দেখা যায় এবং এর মাধ্যমে নিজের ঈমানকে মজবুত ও শক্তিশালী করা যায়।

আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে এবং যেভাবে এই বিশাল সৃষ্টিজগতকে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে তার প্রতিটি বিষয় আল্লাহর অগণিত নিদর্শনের একেকটি দৃষ্টান্ত। এই ভূপৃষ্ঠ বা পৃথিবী অতি সূক্ষ্ম নিয়ম মেনে প্রতি মুহূর্তে নিজের অক্ষের ওপর এবং সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে ঘুরছে। একইসঙ্গে বিশাল ছায়াপথের ভেতর সৌরজগত পরিবারের সঙ্গে থেকে অনির্দিষ্ট লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। অথচ এত ছোটাছুটি সত্ত্বেও ভূপৃষ্ঠকে এত বেশি শান্ত ও নীরব করে রাখা হয়েছে যে, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী তার উপর স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে। এছাড়া, এই ভূপৃষ্ঠে শত শত কোটি মানুষের থাকা-খাওয়ার জন্য সব রকম জীবনোপকরণ রেখে দেয়া হয়েছে। পাহাড়-পবর্তন এবং সাগর-মহাসাগরও আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন। এ সব কিছু নিয়ে চিন্তা করলে মানুষ মাত্রই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে। তবে মুমিন মুসলমান কখনোই আল্লাহর এসব নিদর্শনের ব্যাপারে উদাসীন নয় বরং তারা সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান আরো শক্তিশালী হয়।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে পবিত্র কুরআন নাজিল হয়েছে যাতে মানুষ তা অনুসরণ করে সৌভাগ্য লাভ করতে পারে।

২- বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনা একই উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই দুইয়ের মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় রয়েছে।

৩- আল্লাহর কিতাবের আয়াত এবং আল্লাহর সৃষ্টিজগত উভয় স্থানে ঈমানদার ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে।

সূরা জাসিয়ার ৪ থেকে ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَفِی خَلْقِکُمْ وَمَا یَبُثُّ مِنْ دَابَّةٍ آیَاتٌ لِقَوْمٍ یُوقِنُونَ ﴿٤﴾ وَاخْتِلافِ اللَّیْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ رِزْقٍ فَأَحْیَا بِهِ الأرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَتَصْرِیفِ الرِّیَاحِ آیَاتٌ لِقَوْمٍ یَعْقِلُونَ ﴿٥﴾ تِلْکَ آیَاتُ اللَّهِ نَتْلُوهَا عَلَیْکَ بِالْحَقِّ فَبِأَیِّ حَدِیثٍ بَعْدَ اللَّهِ وَآیَاتِهِ یُؤْمِنُونَ ﴿٦﴾

“তোমাদের সৃষ্টিতে আর [ভূপৃষ্ঠে] প্রাণীকুল ছড়িয়ে দেয়ার মাঝে [আল্লাহর ক্ষমতার] নিদর্শন আছে নিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য।”(৪৫:৪)

“আর রাত ও দিনের পরিবর্তন এবং আল্লাহ্‌ আকাশ হতে যে রিযিক বর্ষণ করেন, অতঃপর তিনি তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাতে এবং বায়ুর পরিবর্তনে অনেক নিদর্শন রয়েছে, এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।”(৪৫:৫)

“এগুলি আল্লাহর আয়াত, যা আমি আপনার নিকট যথাযথভাবে আবৃত্তি করছি।  সুতরাং [তারা যদি এসব আয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে তবে] আল্লাহর [বাণী ও] আয়াতের পরিবর্তে তারা আর কোন্ বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করবে?”(৪৫:৬)

সৃষ্টিজগতে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনের প্রতি ইঙ্গিত করার পর এই তিন আয়াতের শুরুতে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে, তোমরা সৃষ্টিজগতে আল্লাহর মাহাত্ম্য দেখার জন্য কেন তোমাদের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছ না? এই পৃথিবীতে যে অসংখ্য জীব-জন্তু তোমাদের চারপাশে বসবাস করছে সেগুলোর প্রতি মনযোগ দিচ্ছ না কেন? অথচ এগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিলে ও এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে এক আল্লাহর প্রতি তোমাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হতো। 

একইভাবে বাতাসের চলাচল, বৃষ্টিবর্ষণ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করলে আমরা একথা উপলব্ধি করতে পারি যে, বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা গোটা সৃষ্টিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী প্রাণীকূলের সব প্রাকৃতিক চাহিদা পূরণ হয়ে যায় এবং সবাই বেঁচে থাকতে পারে।  

এতসব নিদর্শনের প্রতি যদি কেউ ভ্রুক্ষেপ না করে এবং যা কিছু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর নাজিল হয়েছে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে ও ঈমান না আনে তাহলে সে দায় একান্তভাবেই তার নিজের। এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে জাহান্নামই হবে তার একমাত্র ঠিকানা।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- ঐশী বাণী আমাদেরকে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করে। একমাত্র চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমরা জেনেবুঝে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে এবং নিশ্চিত বিশ্বাসে উপনীত হতে পারি।

২- আমরা যেন মেঘ, বৃষ্টি, বাতাস, তুষারপাত ইত্যাদিকে সাধারণ ঘটনা মনে না করি। এসব প্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহ সুনির্দিষ্ট নিয়মে সংঘটিত না হলে পৃথিবীতে মহা বিপর্যয় দেখা দেবে এবং মানুষসহ অন্যান্য জীবনজন্তু না খেয়ে মারা যাবে।

৩- আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাব নাজিল করে মানুষের প্রতি নিজের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। এই কিতাব পাওয়ার পরও যদি কেউ ঈমান না আনে তাহলে সেজন্য সে কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না।

সূরা জাসিয়া’র ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَیْلٌ لِکُلِّ أَفَّاکٍ أَثِیمٍ ﴿٧﴾ یَسْمَعُ آیَاتِ اللَّهِ تُتْلَى عَلَیْهِ ثُمَّ یُصِرُّ مُسْتَکْبِرًا کَأَنْ لَمْ یَسْمَعْهَا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِیمٍ ﴿٨﴾

 “ধ্বংস প্রত্যেক মিথ্যাবাদী পাপাচারীর জন্য।”(৪৫:৭)

“যে তার সামনে আল্লাহর আয়াতের আবৃত্তি করা হলে তা শোনে অথচ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে [নিজের ভ্রান্ত মতবাদে] অটল থাকে; যেন সে তা শোনেইনি।  সুতরাং ওকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও।”(৪৫:৮)

আগের আয়াতগুলোতে বিশ্বজগতে আল্লাহ তায়ালার কিছু নির্দশন এবং পবিত্র কুরআন নাজিল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: তারাই আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও আসামনি কিতাবের প্রতি ঈমান আনে না যারা অহংকার ও মনের চাহিদা অনুযায়ী জীবন গড়ার কারণে পাপাচার ও জুলুমে লিপ্ত। তাদের অন্তর সত্য গ্রহণ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই তাদের সামনে যতই কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা হোক না কেন তারা তা শুনতে বা চিন্তা করতে রাজি নয়। স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ তায়ালার সামনে অহংকার প্রদর্শন ও নানা ধরনের পাপকাজে লিপ্ত থাকার কারণে তারা পার্থিব জীবন ও পরকালে তাদের পাপের শাস্তি পাবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহর বাণী সব মানুষের কানে পৌঁছে দিতে হবে। এমনকি এ কাজে চরম পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিও যেন বাদ না যায়। তাহলেই তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন সম্পন্ন হবে।

২- অহংকার একটি খারাপ গুণ। সেই অহংকার যদি আল্লাহর সামনে করা হয় তাহলে তার মাত্রা আরো বেড়ে যায় এবং জেনেবুঝে সেই অহংকারে অটল থাকার অপরাধ আরো অনেক অনেকগুণ বেশি।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ