সূরা জাসিয়া : আয়াত ৯-১৪ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জাসিয়া নিয়ে আলোচনা। এই সূরার ১ থেকে ৩৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৯ থেকে ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِذَا عَلِمَ مِنْ آیَاتِنَا شَیْئًا اتَّخَذَهَا هُزُوًا أُولَئِکَ لَهُمْ عَذَابٌ مُهِینٌ ﴿٩﴾ مِنْ وَرَائِهِمْ جَهَنَّمُ وَلا یُغْنِی عَنْهُمْ مَا کَسَبُوا شَیْئًا وَلا مَا اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِیَاءَ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِیمٌ ﴿١٠﴾ هَذَا هُدًى وَالَّذِینَ کَفَرُوا بِآیَاتِ رَبِّهِمْ لَهُمْ عَذَابٌ مِنْ رِجْزٍ أَلِیمٌ ﴿١١﴾
“যখন আমার কোন আয়াত সম্পর্কে সে অবগত হয়, তখন তা নিয়ে পরিহাস করে। ওদের জন্যই রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।”(৪৫:৯)
“তাদের সামনে রয়েছে জাহান্নাম; তাদের কৃতকর্ম ও তারা যা কিছু সঞ্চয় করেছে এবং আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে অভিভাবক স্থির করেছে তাদের কিছুই তাদের কাজে আসবে না। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।”(৪৫:১০)
“এই [কুরআন] হিদায়াতের উৎস; আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে, তাদের জন্য রয়েছে খুবই কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”(৪৫:১১)
গত আসরে তাদের কথা আলোচিত হয়েছিল যারা আল্লাহর আয়াত শোনা ও উপলব্ধি করার পর অহংকার ও গোয়ার্তুমির কারণে তা গ্রহণ করেনি। এরপর আজকের এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: তারা কুরআনের আয়াত উপলব্ধি করার পর তা কেবল প্রত্যাখ্যানই করেনি সেইসঙ্গে আয়াতগুলোকে হাসিঠাট্টার পাত্র বানিয়েছে। তারা আল্লাহর রাসূল (সা.) ও মুমিন ব্যক্তিদেরকে উপহাস করেছে। আল্লাহ তায়ালাও এসব মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে অপমান-অপদস্থ করবেন। তারা পার্থিব জীবনে যত সম্পদ জমা করেছে এবং যেসব মানুষকে নিজেদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী বানিয়েছে তাদের কেউই কিয়ামতের দিন কাফিরদের কোনো কাজে আসবে না।
তারা কিয়ামতের দিন নিজেদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থা উপলব্ধি করবে এবং আল্লাহর ভয়াবহ আজাবের সামনে নিজেদেরকে চরম অসহায় দেখতে পাবে। এরপর বলা হচ্ছে, এই কুরআন হিদায়াতের উৎস। এই মহাগ্রন্থ মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করে এবং মানুষের চলার সুন্দর ও সঠিকতম পথ বাতলে দেয়। যারা আল্লাহর পথে চলতে চায় তাদেরকে নিখুঁতভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কিন্তু যারা কুরআনের আয়াত অস্বীকার করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন ও ভয়াবহ আজাব।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বান্দার গোনাহের ধরন অনুযায়ী তার শাস্তি নির্ধারিত হবে। এ কারণে ঠাট্টা করার শাস্তি হবে অপমান ও লাঞ্ছনা।
২- কাফিররা পার্থিব জগতে সম্পদ, ক্ষমতা ও বন্ধুদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু পরকালে এগুলোর কোনোটিই কাজে আসবে না।
৩- আল্লাহর হিদায়াতকে যে অস্বীকার করে সে পাপের পথে ডুবে যায় এবং পরকালে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
সূরা জাসিয়ার ১২ থেকে ১৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
اللَّهُ الَّذِی سَخَّرَ لَکُمُ الْبَحْرَ لِتَجْرِیَ الْفُلْکُ فِیهِ بِأَمْرِهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّکُمْ تَشْکُرُونَ ﴿١٢﴾ وَسَخَّرَ لَکُمْ مَا فِی السَّمَاوَاتِ وَمَا فِی الأرْضِ جَمِیعًا مِنْهُ إِنَّ فِی ذَلِکَ لآیَاتٍ لِقَوْمٍ یَتَفَکَّرُونَ ﴿١٣﴾
“তিনিই আল্লাহ, যিনি সাগরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যেন তাঁর আদেশে তাতে নৌযানসমূহ চলাচল করতে পারে। আর যেন তোমরা তাঁর অনুগ্রহ [অর্থাৎ রিজিক] অন্বেষণ করতে পার এবং যেন তোমরা (তাঁর প্রতি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”(৪৫:১২)
“আর আসমানসমূহ ও যমীনের সমস্ত কিছুকে তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন; এসব কিছু তার পক্ষ হতে। নিশ্চয় এতে অনেক নিদর্শনাবলী রয়েছে, এমন সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।”(৪৫:১৩)
এই দুই আয়াতে বিশ্বজগতে মহান আল্লাহর একত্ববাদের আরো কিছু উদাহরণ তুলে ধরে বলা হচ্ছে: তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে জাহাজে চড়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত করো। আল্লাহ তায়ালাই পানির মধ্যে এমন গুণ দিয়ে দিয়েছেন যাতে বিশাল বিশাল জাহাজ হাজার হাজার টন ওজন নিয়ে সাগরের পানির উপর দিয়ে চলাচল করতে পারে এবং ডুবে যায় না। এছাড়া, জাহাজ চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য সাগরে যে বাতাস প্রবাহিত হয় তাও আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বে গাড়ি, ট্রেন ও বিমানের মতো অত্যাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পণ্য আনা-নেয়ার কাজে এখনও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় জাহাজ। আর এসব জাহাজ চলাচল করে সমুদ্রের এমন পথ ধরে যা তৈরি বা সংরক্ষণের জন্য মানুষকে কোনো কষ্ট করতে হয় না। শুধুমাত্র সাগর নয় সেইসঙ্গে আকাশ ও ভূপৃষ্ঠে অবস্থানকারী সূর্য, চন্দ্র, বাতাস, বৃষ্টি, খনিজ সম্পদ, জঙ্গল, মরুভূমি, পাহাড় ইত্যাদি সবকিছু মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এতসব নিয়ামত মানুষের অধীন করে দেয়ার মধ্যে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই আল্লাহর আয়াতের নিদর্শন রয়েছে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালা গোটা সৃষ্টিজগতকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু মানুষ এজন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা পর্যন্ত প্রকাশ করে না।
২- জীবিকা অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাতে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। এই ধর্ম হালাল উপার্জনের মাধ্যমে জাগতিক জীবনে স্বচ্ছলতা অর্জন করতে নিষেধ করেনি।
৩- সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন ঘটনাবলীর দিকে তাকালে আমরা আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারি এবং আমাদের মধ্যে ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়।
সূরা জাসিয়া’র ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
قُلْ لِلَّذِینَ آمَنُوا یَغْفِرُوا لِلَّذِینَ لا یَرْجُونَ أَیَّامَ اللَّهِ لِیَجْزِیَ قَوْمًا بِمَا کَانُوا یَکْسِبُونَ ﴿١٤﴾
“[হে নবী!] যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে বলুন, তারা যেন ক্ষমা করে ওদেরকে, যারা আল্লাহর দিনগুলোর প্রত্যাশা করে না। যাতে আল্লাহ প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিতে পারেন।”(৪৫: ১৪)
আল্লাহর আয়াতের বিপরীতে কাফিরদের উদ্ধত আচরণ এবং বিভ্রান্তিতে ডুবে থাকার জন্য তাদের আপ্রাণ চেষ্টা সম্পর্কে এই আয়াতে মুমিনদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: যারা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করে তাদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিতে হবে যাতে তিনি তাদের কৃতকর্মের শাস্তি দিতে পারেন। অবশ্য যারা অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে শিরক ও কুফরে লিপ্ত হয়েছে তাদের সঙ্গে ক্ষমা ও সহনশীল আচরণ করতে হবে। তাদের সঙ্গে ক্ষমাশীল আচরণ করলে তারা উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে উঠে সত্য গ্রহণ করতেও পারে। কিন্তু যারা অহংকার ও গোঁড়ামির কারণে সত্য গ্রহণ করতে রাজি হয়নি তাদের সঙ্গে সংঘাত পরহার করার অর্থ হচ্ছে, তাদেরকে উপেক্ষা করা এবং তাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়া।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলা হলো:
১- কাফিরদের প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে বলা হয়েছে। কখনো তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং কখনো তাদেরকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিতে হবে যাতে তিনি তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারেন।
২- আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার দেবেন। আর আমরা সেই কৃতকর্মের জন্য পুরস্কারের আশা করতে পারি যা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে এবং যা নিয়মিত পালন করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।