সূরা জাসিয়া : আয়াত ১৫-২০ (পর্ব-৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জাসিয়া নিয়ে আলোচনা। এবার এ সূরার ১৫ থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَاءَ فَعَلَیْهَا ثُمَّ إِلَى رَبِّکُمْ تُرْجَعُونَ ﴿١٥﴾
“যে সৎকাজ করে, সে নিজ কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ কাজ করলে তার কুফল সেই ভোগ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে।”(৪৫:১৫)
গত আসরে কিয়ামত অস্বীকারকারীদের পরিণতি বর্ণনা করার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা একথা ভেবো না যে, তোমাদের ঈমান বা কুফর, তোমাদের আনুগত্য বা নাফরমানি আল্লাহর কোনো উপকার বা অপকারে আসে। যে কেউ কোনো কাজ করবে তার প্রতিফল সে নিজেই ভোগ করবে এবং কিয়ামতের দিন সে প্রতিফল তাকে প্রদান করা হবে। বিষয়টি অনেকটা একজন স্কুল শিক্ষকের মতো যিনি নিজ শিক্ষার্থীদের বলেন: তোমরা লেখাপড়া করো বা না করো তাতে আমার কোনো লাভ বা ক্ষতি হবে না বরং এর উপকার বা অপকার তোমাদের ওপরই বর্তাবে।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- মানুষের পুরস্কার ও শাস্তি তার নিজের ভালো বা মন্দ কাজের ওপর নির্ভরশীল। সব মানুষের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার এই আইন সমানভাবে প্রযোজ্য।
২- আল্লাহ তায়ালা মানুষের মুখাপেক্ষী নন বরং মানুষকে সৌভাগ্যশালী করার জন্যই তিনি পৃথিবীতে ঐশী শিক্ষা পাঠিয়েছেন।
সূরা জাসিয়ার ১৬ থেকে ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَلَقَدْ آتَیْنَا بَنِی إِسْرَائِیلَ الْکِتَابَ وَالْحُکْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّیِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى الْعَالَمِینَ ﴿١٦﴾ وَآتَیْنَاهُمْ بَیِّنَاتٍ مِنَ الأمْرِ فَمَا اخْتَلَفُوا إِلا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْیًا بَیْنَهُمْ إِنَّ رَبَّکَ یَقْضِی بَیْنَهُمْ یَوْمَ الْقِیَامَةِ فِیمَا کَانُوا فِیهِ یَخْتَلِفُونَ ﴿١٧﴾
“আর আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাব, শাসনক্ষমতা ও নবুওয়াত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে রিযিক প্রদান করেছিলাম উত্তম বস্তু হতে, আর [সে যুগে] তাদেরকে গোটা বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম।”(৪৫:১৬)
“আর আমি তাদেরকে [দ্বীনের] যাবতীয় বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দান করেছিলাম। তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরও তারা [শুধুমাত্র] পরস্পর ঈর্ষা ও বিদ্বেষবসতঃ মতবিরোধ করেছিল। তারা যে বিষয়ে মতবিরোধ করত, নিশ্চয় আপনার রব কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সে বিষয়ে ফয়সালা করে দেবেন।”(৪৫:১৭)
এই দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা অতীতে বনি ইসরাইল জাতির প্রতি নিজ অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যাতে মুসলিম উম্মাহ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। প্রথমে আসমানি কিতাব, শাসনক্ষমতা ও নবুওয়্যাতপ্রাপ্তির কথা উল্লেখ করে তারপর উত্তম রিজিকের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন: এতসব নেয়ামত পাওয়ার ফলে তারা সে যুগের সব মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ও বিদ্বেষী মানসিকতার কারণে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ে। আসমানি কিতাবের শিক্ষা সামনে থাকার কারণে তাদের সামনে সত্য ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও পারস্পরিক বিদ্বেষের কারণে তারা মতবিরোধ চালিয়ে যায়। এর পরিণতিতে তারা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয় এবং তাদের শাসনক্ষমতার পতন ঘটে।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- আমরা যদি বস্তুগত ও আত্মিক নেয়ামতকে আল্লাহ-প্রদত্ত মনে করি এবং সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করি তাহলে এই পৃথিবীতেই আমাদের পক্ষেও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা সম্ভব।
২- ইসলামে নবীর জন্য শাসনক্ষমতা পরিচালনায় দোষের কিছু নেই। তবে ক্ষমতা পরিচালনার নীতি হতে হবে দ্বীনি শিক্ষা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে।
৩- আল্লাহ তায়ালা সত্য উপলব্ধি করার জন্য মানুষের কাছে আসমানি কিতাব ও নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। কাজেই কিয়ামতের দিন কাফিররা আল্লাহর নাফরমানি করার পক্ষে কোনো যুক্তি দেখাতে পারবে না।
৪- সত্যের জ্ঞান স্পষ্ট হয়ে যাওয়াই যথেষ্ট নয়। বহু মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করা সত্ত্বেও গোঁড়ামি, ঔদ্ধত্ব বা বিদ্বেষের কারণে তা গ্রহণ করেনি বরং সমাজে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে।
সূরা জাসিয়া’র ১৮ থেকে ২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
ثُمَّ جَعَلْنَاکَ عَلَى شَرِیعَةٍ مِنَ الأمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِینَ لا یَعْلَمُونَ ﴿١٨﴾ إِنَّهُمْ لَنْ یُغْنُوا عَنْکَ مِنَ اللَّهِ شَیْئًا وَإِنَّ الظَّالِمِینَ بَعْضُهُمْ أَوْلِیَاءُ بَعْضٍ وَاللَّهُ وَلِیُّ الْمُتَّقِینَ ﴿١٩﴾ هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ یُوقِنُونَ ﴿٢٠﴾
“[হে রাসূল!] তারপর আমি আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি দ্বীনের [বিশেষ ও পূর্ণাঙ্গ] বিধানের উপর; কাজেই আপনি তার অনুসরণ করুন এবং যারা জানে না আপনি তাদের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করবেন না।”(৪৫: ১৮)
“কারণ তারা কখনোই আল্লাহ্র মোকাবেলায় আপনার কোন উপকার [বা আপনাকে সমর্থন] করতে পারবে না; এবং নিশ্চয় জালিমরা একে অন্যের বন্ধু ও সহযোগী; আর আল্লাহ বন্ধু মুত্তাকিদের।”(৪৫:১৯)
“এই [কুরআন] মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হেদায়াত ও রহমতস্বরূপ।”(৪৫:২০)
বনি-ইসরাইল জাতির ঘটনা বর্ণনা করার পর এই তিন আয়াতে বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে আল্লাহ বলছেন: আমি আপনাকেও শরিয়ত বা দ্বীনের সুস্পষ্ট বিধিবিধান দান করেছি যাতে আপনি তার ভিত্তিতে মানুষকে একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানাতে পারেন। অবশ্য কাফির ও মুশরিকরা এ কাজে আপনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং আপনার দ্বীনের প্রসার রোধ করার জন্য নানা পরিকল্পনা উপস্থাপন করবে। কিন্তু আপনি আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কখনোই তাদের সঙ্গে আপোষ করবেন না।
হে রাসূল! আপনি সত্যের পথে দৃঢ়সংকল্প ও অটল থাকুন এবং সত্য ধর্মকে অনুসরণ করুন। আপনি শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালন করুন এবং কাফির ও মুশরিকদের দাবি-দাওয়াকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করবেন না। কারণ, মহান আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকেন। আর জালিম প্রকৃতির কাফিররা তাদের মতো লোকদেরই সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হয়। তারা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে কিংবা আল্লাহর শাস্তি থেকে কাউকে বাঁচাতে পারে না।
হে রাসূল! আপনার প্রতি যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তা সব মানুষকে হেদায়াত দান করার জন্য যথেষ্ট। এই মহাগ্রন্থ সকলের অন্তদৃষ্টি জাগিয়ে দিতে ও তাদের সঠিক পথে চলার জন্য আলোকবর্তিকা হতে সক্ষম। যে কেউ নিশ্চিত বিশ্বাসী হতে চায় তাকে এই কুরআন পথ দেখায় এবং আল্লাহর বিশেষ রহমতের ছায়াতলে স্থান করে দেয়।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষকে হেদায়াত দান করার জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে ধর্মীয় বিধানসহ বহু নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। এসব বিধিবিধানের মৌলিক বক্তব্য ছিল অভিন্ন। ইসলাম হচ্ছে অতীতের সেসব বিধানের পূর্ণাঙ্গ রূপ যা বিশ্বনবী (সা.)-এর মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে।
২- যে কেউ আল্লাহর নির্দেশ পালন করে না সে নিজের বা অন্যের খেয়াল-খুশি অনুসরণ করতে বাধ্য। আর খেয়াল-খুশির অনুসরণ মানেই হচ্ছে সরল পথ থেকে বিচ্যুতি।
৩- দ্বীনের অনুসরণ করতে হবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে। আর তা করতে পারলেই হেদায়েতের এমন উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব যেখান থেকে একজন ঈমানদার ব্যক্তিকে টলানো সম্ভব নয়।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।