আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জাসিয়া নিয়ে আলোচনা। এবার এ সূরার ২১ থেকে ২৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

أَمْ حَسِبَ الَّذِینَ اجْتَرَحُوا السَّیِّئَاتِ أَنْ نَجْعَلَهُمْ کَالَّذِینَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَحْیَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا یَحْکُمُونَ ﴿٢١﴾ وَخَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ بِالْحَقِّ وَلِتُجْزَى کُلُّ نَفْسٍ بِمَا کَسَبَتْ وَهُمْ لا یُظْلَمُونَ ﴿٢٢﴾ 

“যারা অন্যায় কাজ করে তারা কি এ কথা ভেবে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে ঈমান গ্রহণকারী সৎকর্মশীলদেরকে সমান গণ্য করব যার ফলে তাদের উভয় দলের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? কতই না মন্দ তাদের ধারনা!”(৪৫:২১)

“আর আল্লাহ যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; যাতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অর্জন অনুযায়ী প্রতিফল দেওয়া যায়। আর তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।”(৪৫:২২)

গত কয়েক আসরে পরকালে মুমিন ও কাফির ব্যক্তিদের পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই আয়াতে এই দুই দলের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, কেউ কি একথা আশা করে যে, আল্লাহ তায়ালা পুন্যবান ও পাপী ব্যাক্তিদের সঙ্গে সমান আচরণ করুন? সমাজে যে লোকটি মানুষের ওপর জুলুম ও অন্যায় করে আর যে লোকটি সারাক্ষণ নিজেকে পরোপকারে নিয়োজিত রাখে তাদের দু’জনকে কি সমান প্রতিদান দেয়া হয়? কখনোই না। কাজেই নিঃসন্দেহে মুমিন ও কাফির ব্যাক্তির জীবন ও মৃত্যু সমান হবে না।  মুমিন ও নেক আমলকারী ব্যক্তির অন্তর প্রশান্ত হয়‌; ফলে জীবনের কঠিন বিপদ ও দুর্দিনে তারা বিচলিত হয়ে পড়ে না। তারা সব সময় আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে বলে তারা সাধারণত ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকে।

সূরা আনআমের ৮২ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে: “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুম [ও শির্ক] দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত।” অন্যদিকে যাদের ঈমান নেই কিংবা শির্কমিশ্রিত ঈমান নিয়ে নানারকম অপকর্ম করে নিজেদের জীবনকে কলুষিত করেছে তারা সারাক্ষণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে জীবন কাটায়। তারা যদি অঢেল ধন-সম্পদের মধ্যে ডুবেও থাকে তারপরও ‘কখন না জানি এসব হাতছাড়া হয়ে যায়’ এই আশঙ্কায় তটস্থ থাকে। তারা নিজেদের ভবিষ্যতকে অন্ধকার দেখতে পায় এবং মৃত্যুকে ধ্বংস বলে মনে করে।

এদের প্রথম দলের অন্তর হেয়ায়েতের আলোতে সমুজ্জ্বল থাকে এবং তারা জীবনের উন্নত লক্ষ্যপানে ধাবিত হন। কিন্তু দ্বিতীয় দলের জীবনের কোনো লক্ষ্য থাকে না এবং তারা অমানিশার অন্ধকারে হাবুডুবু খায়।

মৃত্যুর মুহূর্তে যখন মানুষ চিরস্থায়ী জীবনের প্রবেশদ্বারে অবস্থান করে তখনও এই দুই দলের অবস্থান থাকে বিপরীতমুখী। ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মানুষগুলোকে মৃত্যুর সময় জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়। কিন্তু ঈমানহীন পাপী ব্যক্তিদের বলা হয়, তোমরা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করো।

আয়াতের আরেকটি আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, এই পৃথিবী ও এর আসমানসমূহকে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সৃষ্টি করা হয়েছে। শুধু মানুষ নয় গোটা বিশ্বজগতের সবকিছুকে যথার্থভাবে যার যার স্থানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। কাজেই আল্লাহ তায়ালা যেমন কারো প্রতি জুলুম করেন না তেমনি মানুষকে তার কৃতকর্মের ধরন অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার প্রদান করেন।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যেন খারাপ ধারনা পোষণ না করি। তিনি আমাদের কর্মের ভিত্তিতে আমাদেরকে শাস্তি বা পুরস্কার দেবেন। আমাদের ভ্রান্ত আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নয়।

২- মানুষের জীবন, মৃত্যু ও পারলৌকিক জীবনের সুখ বা দুঃখ নির্ভর করছে তা ঈমান ও কর্মের ওপর।

৩- সত্য ও ন্যায়ের ওপর বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে। কাজেই আল্লাহ তায়ালা মানুষের সঙ্গেও আচরণ করবেন ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে।

সূরা জাসিয়ার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

أَفَرَأَیْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ یَهْدِیهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلا تَذَکَّرُونَ ﴿٢٣﴾

“আপনি কি লক্ষ্য করেছেন তাকে, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজের মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তাকে [সঠিক পথ প্রদর্শনের পর] বিভ্রান্ত করেছেন এবং ওর কর্ণ ও হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন এবং ওর চোখের ওপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে হেদায়েত করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?”(৪৫:২৩)

এই আয়াতে গোনাহ ও পাপকাজের উৎসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: পাপী ব্যক্তিরা তাদের মনের খেয়াল-খুশীকে সবকিছুর মানদণ্ড বানিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মনের আকাঙ্ক্ষাই তাদের মাবুদে পরিণত হয়েছে। সেই মাবুদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের জীবন পরিচালিত হয়। আর মনের খেয়াল-খুশী মানুষকে ক্ষণস্থায়ী ইন্দ্রীয়লিপ্সার দিকে ধাবিত করবে এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের মানুষ নিজেদের ওপর এতটা অবিচার করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের চোখ ও কানকে সত্য দেখা ও শোনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দেন। ফলে তারা তাদের ইন্দ্রীয়পূজা ও স্বার্থ ছাড়া আর কিছু দেখতে বা শুনতে পায় না। এ ধরনের মানুষের বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান কোনো কাজে আসে না।  ইন্দ্রীয়পূজারি ব্যক্তি যত বড় জ্ঞানীই হোক না কেন পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- শুধুমাত্র মূর্তি, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদিই মুশরিকদের উপাস্য নয়। বহু মানুষ আছে যারা তাদের খেয়াল-খুশীকে নিজেদের উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং ইন্দ্রীয়পূজাই তাদের একমাত্র ধর্ম।

২-  ইন্দ্রীয়পূজারি জ্ঞানী ব্যক্তির উদাহরণ ওই চিকিৎসকের মতো যে ধুমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো জানা সত্ত্বেও ধুমপান করে।

৩- ইন্দ্রীয়পূজা হচ্ছে এমন চশমার মতো যা চোখে পরলে মানুষ সত্যকে চিনতে ও সত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ কারণে এ ধরনের মানুষ ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হয়।

সূরা জাসিয়া’র ২৪ থেকে ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقَالُوا مَا هِیَ إِلا حَیَاتُنَا الدُّنْیَا نَمُوتُ وَنَحْیَا وَمَا یُهْلِکُنَا إِلا الدَّهْرُ وَمَا لَهُمْ بِذَلِکَ مِنْ عِلْمٍ إِنْ هُمْ إِلا یَظُنُّونَ ﴿٢٤﴾ وَإِذَا تُتْلَى عَلَیْهِمْ آیَاتُنَا بَیِّنَاتٍ مَا کَانَ حُجَّتَهُمْ إِلا أَنْ قَالُوا ائْتُوا بِآبَائِنَا إِنْ کُنْتُمْ صَادِقِینَ ﴿٢٥﴾

“আর ওরা বলে, ‘পার্থিব জীবন ছাড়া আমাদের আর কোনো জীবন নেই, এখানেই আমরা মরি ও বাঁচি; একমাত্র মহাকালই আমাদেরকে ধ্বংস করে।’ বস্তুতঃ এ ব্যাপারে ওদের কোন জ্ঞান নেই, ওরা তো কেবল ধারণা করে মাত্র।”(৪৫:২৪)

“আর তাদের কাছে যখন [পরকাল সম্পর্কে] আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয় তখন তাদের কোন যুক্তি থাকে না শুধু এ কথা ছাড়া যে, তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকলে আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে [জীবিত করে আমাদের কাছে] নিয়ে এস।”(৪৫:২৫)

আগের আয়াতে খেয়াল-খুশির অনুসরণ ও ইন্দ্রীয়পূজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর এই দুই আয়াতে মানুষের খেয়াল-খুশির উদাহরণ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে: যারা ইন্দ্রীয়পূজায় লিপ্ত তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে অস্বীকার করে। তারা বলে, ‘আমরা মরে যাওয়ার পর আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না; কাজেই কৃতকর্মের হিসাব নিকাশ দেয়ারও কোনো প্রশ্ন থাকবে না। একদিন এই পৃথিবীতে এসেছি এবং একদিন চলে যাব। এর বাইরে আর কোনো জীবন নেই যা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।’ পরকালকে অস্বীকার করার পেছনে তাদের কোনো যুক্তি নেই; তারা শুধুমাত্র ধারনাপ্রসূত কথাবার্তা বলে। তারা ঈমানদারদেকে বলে: যদি মৃত মানুষের জীবিত হওয়ার ঘটনা সত্য হয় তাহলে আমাদের মৃত পূর্বপুরুষদের জীবিত করে দেখাও। তারা এমন সময় এই যুক্তিহীন কথা বলে যখন আল্লাহ তায়ালা প্রতিনিয়ত প্রাণহীন বস্তু থেকে প্রাণ সৃষ্টি করে দেখাচ্ছেন। আদি মানব হযরত আদম (আ.)কে তিনি প্রাণহীন মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া, এখনও যেসব মানব-সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয় তাদেরকেও আল্লাহ প্রাণহীন বস্তু থেকেই সৃষ্টি করে দেখাচ্ছেন।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- ইন্দ্রীয়পূজারি মানুষেরা তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে পাপকাজ অব্যাহত রাখার জন্য পরকালকে অস্বীকার করে।

২- পরকালে অস্বীকারকারীদের কোনো যুক্তি নেই। তারা শুধু ধারনা ও কল্পনাপ্রসূত কথা বলে।

৩- আল্লাহকে অস্বীকারকারীরা তাঁর ওপর ঈমান আনার জন্য যেমন আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিল তেমনি পরকালে অস্বীকারকারীরা তাদের পূর্বপুরুষদের জীবিত করে আনার আহ্বান জানায়। তারা যা চোখে দেখে না তা বিশ্বাস করতে চায় না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ