সূরা জাসিয়া : আয়াত ২৬-৩২ (পর্ব-৫)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জাসিয়া নিয়ে আলোচনা। এবার এ সূরার ২৬ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قُلِ اللَّهُ یُحْیِیکُمْ ثُمَّ یُمِیتُکُمْ ثُمَّ یَجْمَعُکُمْ إِلَى یَوْمِ الْقِیَامَةِ لا رَیْبَ فِیهِ وَلَکِنَّ أَکْثَرَ النَّاسِ لا یَعْلَمُونَ ﴿٢٦﴾ وَلِلَّهِ مُلْکُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَیَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ یَوْمَئِذٍ یَخْسَرُ الْمُبْطِلُونَ ﴿٢٧﴾
“বলুন, আল্লাহই তোমাদেরকে জীবন দান করেন তারপর তোমাদের মৃত্যু ঘটান। তারপর তিনি তোমাদেরকে কিয়ামতের দিন; যে দিনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই [তোমাদের সবাইকে] একত্র করবেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তা জানে না।”(৪৫:২৬)
“আর আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব আল্লাহরই; এবং যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন বাতিলের অনুসারীরা হবে ক্ষতিগ্রস্ত।”(৪৫:২৭)
গত আসরে পরকালকে অস্বীকারকারীদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল যেখানে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জীবিত করে দেয়ার দাবি তুলেছিল। এই দুই আয়াতে সেই দাবির জবাবে বলা হচ্ছে: তোমরা যে এখন জীবিত অবস্থায় কথা বলছ, তোমাদেরকে কে সৃষ্টি করেছেন ও জীবন দিয়েছেন? তোমরা কি নিজেদের সৃষ্টিকর্তাকেও অস্বীকার করবে? যদি তোমরা একথা বিশ্বাস করে থাকো যে, কেউ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তাহলে একথা কেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে, তিনিই তোমাদেরকে আবার জীবিত করতে পারবেন? কেন তোমরা চিন্তা ও গবেষণা করার পরিবর্তে চোখ বন্ধ রেখে অস্বীকার করার পন্থা অবলম্বন করেছ?
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, যদি তোমাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাপারে আল্লাহর ক্ষমতায় সন্দেহ থাকে তাহলে আসমানসমূহ ও জমিনের দিকে দৃষ্টি দাও। যিনি এত বিশাল বিশ্বজগত সৃষ্টি ও পরিচালনা করছেন তার পক্ষে তোমাদেরকে আরেকবার সৃষ্টি করা মোটেও কঠিন কাজ নয়। কাজেই, সাবধান! সত্যের পরিবর্তে মিথ্যার অনুসরণ করো না। যদি তা করো তাহলে কিয়ামতের দিন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, মিথ্যা বা বাতিলের অনুসরণ করলে জীবনের মূল্যবান সময় হাতছাড়া হয়ে যাবে এবং পরকালের জন্য কোনো পুঁজিই তোমরা সঞ্চয় করতে পারবে না।
মানুষের আয়ু, বিচারবুদ্ধি, মেধা ও দক্ষতা হচ্ছে তার পার্থিব সম্পদ এবং এগুলোকে কাজে লাগিয়ে ঈমান গ্রহণ ও নেক আমল বা সৎকাজ করতে হবে। কিন্তু বাতিলপন্থিরা পার্থিব জীবনে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থাকে বলে তারা ঈমান বা নেক আমল ছাড়াই কিয়ামত দিবসে উত্থিত হয়। সেদিন তাদের উপলব্ধি তাদের কোনো উপকারে আসবে না।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- পৃথিবীতে মানুষের প্রথম জীবনই হচ্ছে পুনরুত্থান দিবসে তার পুনর্জন্মের প্রমাণ।
২- মানুষ সৃষ্টির নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার পরিবর্তে সবকিছু নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করতে চায়।
৩- যারা কিয়ামত দিবসকে অস্বীকার করে তারা ওই দিবসে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে কিন্তু সেদিনের উপলব্ধি কোনো কাজে আসবে না।
সূরা জাসিয়ার ২৮ ও ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَتَرَى کُلَّ أُمَّةٍ جَاثِیَةً کُلُّ أُمَّةٍ تُدْعَى إِلَى کِتَابِهَا الْیَوْمَ تُجْزَوْنَ مَا کُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٢٨﴾ هَذَا کِتَابُنَا یَنْطِقُ عَلَیْکُمْ بِالْحَقِّ إِنَّا کُنَّا نَسْتَنْسِخُ مَا کُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ﴿٢٩﴾
“আর [সেদিন] প্রত্যেক জাতিকে দেখবেন ভয়ে নতজানু অবস্থায়, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার আমলনামা দেখতে আহবান করা হবে এবং [তাদেরকে বলা হবে], ‘তোমরা যা করতে, আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে।”(৪৫:২৮)
“এই হলো আমার কিতাব, যা তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে যথার্থভাবে। নিশ্চয় তোমরা যা আমল করতে আমি তা-ই লিখে রাখতাম।”(৪৫:২৯)
এই দুই আয়াতে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সেদিন সব মানুষ ভয় ও উৎকণ্ঠায় নতজানু হয়ে নিজেদের ভাগ্যের ফয়সালা জানার অপেক্ষায় থাকবে। প্রত্যেক জাতিকে তার আমলনামা দেখতে আহ্বান করা হবে। মানুষের জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট ফেরেশতারা তার প্রতিটি কৃতকর্ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। এই আমলনামা এজন্য দেখানো হবে যে, কেউ যাতে বলতে না পারে তাকে অযথা শাস্তি বা পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। এ সময় আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাদেরকে উদ্দেশ করে বলা হবে, এই হচ্ছে আমার কিতাব যা যথার্থভাবে তোমাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে এবং তোমাদের কৃতকর্ম প্রকাশ করে দিচ্ছে। পৃথিবীতে তোমরা যা খুশি তাই করতে এবং কখনো একথা বিশ্বাস করোনি যে, তোমাদের কৃতকর্ম কেউ লিখে রাখছে। কিন্তু আমি ফেরেশতাদের সে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলাম।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- বিশ্বজগত সত্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় এবং এর সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও বিধি-বিধান রয়েছে। এখানে মানুষের প্রতিটি কর্মের রেকর্ড রাখা হচ্ছে।
২- কিয়ামতের দিন মানুষের শাস্তি ও পুরস্কারের ভিত্তি হবে তার বদ বা নেক আমল।
৩- প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা আমলনামা রয়েছে। যারা একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে তারা খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে।
সূরা জাসিয়া’র ৩০ থেকে ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَأَمَّا الَّذِینَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَیُدْخِلُهُمْ رَبُّهُمْ فِی رَحْمَتِهِ ذَلِکَ هُوَ الْفَوْزُ الْمُبِینُ ﴿٣٠﴾ وَأَمَّا الَّذِینَ کَفَرُوا أَفَلَمْ تَکُنْ آیَاتِی تُتْلَى عَلَیْکُمْ فَاسْتَکْبَرْتُمْ وَکُنْتُمْ قَوْمًا مُجْرِمِینَ ﴿٣١﴾
“অতঃপর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে পরিণামে তাদের রব তাদেরকে প্রবেশ করাবেন স্বীয় রহমতে। এটাই সুস্পষ্ট সাফল্য।”(৪৫:৩০)
“আর যারা কুফরী করেছে [তাদেরকে বলা হবে], তোমাদের কাছে কি আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়নি? কিন্তু তোমরা অহংকার করেছিলে এবং তোমরা ছিলে এক পাপী [ও অপরাধী] সম্প্রদায়।” (৪৫:৩১)
আল্লাহর আদালতের বিচার শেষে মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হবে যাদের প্রত্যেকে তাদের কর্ম অনুযায়ী প্রতিফল পাবে। এই দুই দলের একদল হবে নেক আমলকারী ঈমানদার সম্প্রদায় এবং অপর দল হবে ফাসিক-কাফির সম্প্রদায়। ঈমানদার ব্যক্তিরা আল্লাহ তায়ালার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করবে যা হবে সুস্পষ্ট সাফল্য। কিন্তু কাফিরদেরকে সেদিন ভর্ৎসনা করে বলা হবে, তোমাদের সামনে আমার আয়াত পাঠ করা সত্ত্বেও অহংকারবশে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলে। এসব মানুষ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। এ ধরনের মানুষ সত্য গ্রহণ করার পরিবর্তে আল্লাহর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দম্ভ ও অহংকার করেছিল। আর তাদের আমলনামা রয়েছে পাপ ও অপরাধে পরিপূর্ণ।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- ঈমান ও আমল পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত; কাজেই এর যেকোনো একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি মানুষকে সাফল্য এনে দিতে পারবে না। ঈমানের সঙ্গে নেক আমল যুক্ত হলে ব্যক্তি ও সমাজ সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
২- এই আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী, কাফিরদের কুফরের মূলে রয়েছে ঔদ্ধত্ব ও অহংকার।
সূরা জাসিয়া’র ৩২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَإِذَا قِیلَ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ لا رَیْبَ فِیهَا قُلْتُمْ مَا نَدْرِی مَا السَّاعَةُ إِنْ نَظُنُّ إِلا ظَنًّا وَمَا نَحْنُ بِمُسْتَیْقِنِینَ ﴿٣٢﴾
“আর যখন বলা হতো: নিঃসন্দেহে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য ও কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলতে, ‘আমরা জানি না কিয়ামত কি? আমরা [এ বিষয়ে] ধারণা করি মাত্র এবং আমরা নিশ্চিত নই’।”(৪৫:৩২)
কাফিরদের ঔদ্ধত্বের প্রমাণ হিসেবে এই আয়াতে তাদেরকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: যখনই ঈমানদার ব্যক্তিরা তোমাদেরকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার কথা বলত তখন তোমরা সে কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ বা তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পরিবর্তে বলতে: আরে দূর হও! কিয়ামত আবার কি জিনিস? কে তা দেখেছে যে তাকে বিশ্বাস করতে হবে? তোমরা মুমিনরা যা বলছো সেগুলো আমাদের কাছে কল্পনা বা ধারণাপ্রসূত কথাবার্তা বলেই মনে হয়। আমরা কিয়ামত সম্পর্কে স্থির বিশ্বাসে আসতে পারিনি।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই ব্যক্তিদেরকেই যদি বলা হতো: তোমাদের বাড়ির কাছে আগুন লেগেছে এবং যেকোনো সময় তোমাদের ঘরে আগুন লেগে যেতে পারে তখন কিন্তু তারা তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভাতে ছোটাছুটি শুরু করে দিত। কিন্তু কিয়ামতের ব্যাপারে তারা ‘হয়তো হতে পারে’ এমন সম্ভাবনাও বিবেচনা করতে রাজি নয়।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- সব মানুষের কাছে আল্লাহর দাওয়াতের বাণী পৌঁছে দেয়া ঈমানদার ব্যক্তিদের কর্তব্য; যদিও অনেকে তা গ্রহণ করবে না।
২- কিয়ামত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপিত না হলেও কেউ যদি বিষয়টিকে সম্ভাবনা হিসেবেও মেনে নেয় তাহলেও সে গুনাহের কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।