আগস্ট ০২, ২০২১ ১৭:৪১ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জাসিয়া শেষ পর্ব নিয়ে আলোচনা। এবার এ সূরার ৩৩ থেকে ৩৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 وَبَدَا لَهُمْ سَیِّئَاتُ مَا عَمِلُوا وَحَاقَ بِهِمْ مَا کَانُوا بِهِ یَسْتَهْزِئُونَ ﴿٣٣﴾

“আর তাদের মন্দ কাজগুলোর কুফল তাদের কাছে প্রকাশিত হবে এবং যা নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করবে।”(৪৫:৩৩)

গত আসরে কিয়ামত অস্বীকারকারী কাফিরদের বক্তব্য বর্ণনা করা হয়েছে। তারা উপহাস করে বলত: কিয়ামত কি সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই এবং আমরা তা নিয়ে চিন্তাও করতে চাই না। তাদের সে বক্তব্যের জবাবে আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন তাদের হাতে তাদের আমলনামা প্রদান করা হবে। তারা দেখবে তাদের সব কৃতকর্ম তাতে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং কোনোকিছুই অস্বীকার করার উপায় নেই। সেদিন তাদের অপকর্মগুলো তাদের চোখের সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠবে এবং তারা যে কিয়ামতকে অস্বীকার করত তা তাদের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে উপলব্ধি করবে। তারা বুঝতে পারবে আজ আর পালিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- কিয়ামত হচ্ছে মানুষের কৃতকর্ম প্রকাশ ও আল্লাহর হাতে পাকড়াও হওয়ার দিন।

২- আমরা যেন কোনো অবস্থায় আল্লাহ তায়ালার হুকুম ও বিধি-বিধানকে উপহাস না করি। কারণ, এটি এমন এক ধৃষ্টতা যার কারণে কিয়ামতের দিন ভয়ানক শাস্তি পেতে হবে।

সূরা জাসিয়ার ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَقِیلَ الْیَوْمَ نَنْسَاکُمْ کَمَا نَسِیتُمْ لِقَاءَ یَوْمِکُمْ هَذَا وَمَأْوَاکُمُ النَّارُ وَمَا لَکُمْ مِنْ نَاصِرِینَ ﴿٣٤﴾

"আর ওদেরকে বলা হবে, ‘আজ আমি তোমাদেরকে ভুলে যাব যেমন তোমরা আজকের সাক্ষাতের কথা ভুলে গিয়েছিলে। আর তোমাদের আশ্রয়স্থল হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।”(৪৫:৩৪)

মানুষ স্বাভাবিকভাবে যেসব কথা ভুলে যায় আল্লাহ তায়ালা সেজন্য মানুষকে শাস্তি দেন না। কারণ, মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছে এমনভাবে যে, সে কিছু কথা, কিছু স্মৃতি ভুলে যাবে। রোজা রাখার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করে ফেললে যেমন শাস্তি নেই তেমনি নামাজ আদায়ের কথা ভুলে গেলেও আল্লাহ পাকড়াও করবেন না। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর আদেশের প্রতি অবহেলা করার কারণে নামাজ পড়তে দেরি করে বা নামাজ আদায় করতে ভুলে যায় সেটি হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কারণ, এখানে স্বাভাবিক নিয়মে সে ভুলে যায়নি বরং ইচ্ছা করেই ভুলে থাকার ভান করেছে।

একইভাবে কিছু মানুষ ঘোষণা দিয়ে কিয়ামতকে অস্বীকার করে এবং তাদের এ সিদ্ধান্তের ওপর অটল থাকে। আরেকদল মানুষ কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস করলেও তাদের কাজেকর্মে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। তারা এমনভাবে পাপকাজে লিপ্ত থাকে যেন, কিয়ামত দিবসকে তারা ভুলে গেছে। এখানে এই দুই দলই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ এদেরকে উদ্দেশ করে বলবেন: তোমরা যেমন পৃথিবীতে আজকের দিনের সাক্ষাতের কথা ভুলে গিয়েছিলে আজ তেমনি আমিও তোমাদের ভুলে যাব। অর্থাৎ তোমাদের প্রতি কোনো দয়া প্রদর্শন করব না এবং তোমরা জাহান্নামের নিক্ষিপ্ত হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- পার্থিব জীবনে বিশ্বাস বা আচরণে যারা কিয়ামত দিবসকে ভুলে যাবে কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর দয়া থেকে বঞ্চিত হবে এবং জাহান্নামের কঠিন আজাবে নিক্ষিপ্ত হবে।

২- মুখে ঈমান আনাই যথেষ্ট নয়। মুমিন ব্যক্তিকে প্রতিটি কথা ও কাজে কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা মাথায় রাখতে হবে।

সূরা জাসিয়া’র ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 ذَلِکُمْ بِأَنَّکُمُ اتَّخَذْتُمْ آیَاتِ اللَّهِ هُزُوًا وَغَرَّتْکُمُ الْحَیَاةُ الدُّنْیَا فَالْیَوْمَ لا یُخْرَجُونَ مِنْهَا وَلا هُمْ یُسْتَعْتَبُونَ ﴿٣٥﴾

“এটা এজন্য যে, তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে বিদ্রূপ করেছিলে এবং পার্থিব জীবন তোমাদেরকে প্রতারিত করেছিল। সুতরাং আজ যেমন ওদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে না তেমনি তাদের ওজর-আপত্তিও গ্রহণযোগ্য হবে না।”(৪৫:৩৫)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দু’টি মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে আল্লাহর আয়াতসমূহ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে পার্থিব জীবনের ধোঁকায় পড়া। প্রকৃতপক্ষে পার্থিব জীবনের প্রতি অতিরিক্ত মায়ার কারণে মানুষ মৃত্যু পরবর্তী জীবন ও কিয়ামতের আদালতের কথা ভুলে যায়। এর ফলে সে নিশ্চিন্ত মনে পাপকাজ ও ইন্দ্রীয়পূজায় লিপ্ত হতে পারে। এ ধরনের মানুষকে কেউ জাহান্নামের শাস্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিলে উপহাস করে বলে: মৃত্যু পরবর্তী জীবন যে সত্যি সেকথা তোমাদেরকে কে বলল যে তা দিয়ে তোমরা আমাদেরকে ভয় দেখাতে চাও? কিসের জান্নাত? কিসের জাহান্নাম? এগুলো সব ধোঁকাবাজি। এদের ভাবখানা এমন যে, নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূন্য থাক!                         

নিঃসন্দেহে এ ধরনের চিন্তাচেতনার অধিকারী মানুষ কখনোই অনুতপ্ত হয় না এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে না। এরকম ধৃষ্টতাপূর্ণ জীবনযাপনের মধ্যেই তাদের মৃত্যু হয়। কিয়ামতের দিন তাদের অনুশোচনা কোনো কাজে আসবে না বরং তারা জাহান্নামের কঠিন শাস্তিতে নিপতিত হবে।

এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- কিয়ামতের দিন মানুষের চরম ভোগান্তির উৎসে রয়েছে পার্থিব জীবনে সম্পদ, ক্ষমতা ও ইন্দ্রীয়সুখের প্রতি তীব্র আকর্ষণ।

২- মহান আল্লাহ তার সকল বান্দার প্রতি সতর্ক করার দায়িত্ব পালন করেছেন যাতে কিয়ামতের দিন তারা একথা বলতে না পারে যে, ‘আমরা জানতাম না।’

সূরা জাসিয়া’র ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

 فَلِلَّهِ الْحَمْدُ رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَرَبِّ الأرْضِ رَبِّ الْعَالَمِینَ ﴿٣٦﴾ وَلَهُ الْکِبْرِیَاءُ فِی السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَهُوَ الْعَزِیزُ الْحَکِیمُ ﴿٣٧﴾

“সকল প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আকাশমন্ডলীর প্রতিপালক, পৃথিবীর প্রতিপালক এবং বিশ্বজগতের প্রতিপালক।”(৪৪:৩৬)

“আর আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যাবতীয় গৌরব-গরিমা [একমাত্র] তাঁর এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”(৪৪:৩৭)

সূরা জাসিয়ার এই শেষ দুই আয়াতে সৃষ্টিজগতে মহান আল্লাহর সুউচ্চ অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: বিশাল আসমানসমূহ ও এই গোটা সৃষ্টিজগত একমাত্র আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। একইভাবে এই ভূপৃষ্ঠে মানুষহ অন্যান্য জীবজন্তুর চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করছেন মহান স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি মহাশক্তি ও মহাপরাক্রমের পাশাপাশি চিরশাশ্বত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে সৃষ্টিজগত পরিচালনা করেন। কাজেই আমাদের উচিত তাঁকে সঠিকভাবে চেনা এবং বিশ্বজগত পরিচালনায় তাঁর অবস্থান ও ভূমিকা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া। আর সে জ্ঞান অর্জন করতে পারলেই আমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার নাগপাশে জড়াতে এবং তাঁর প্রশংসায় মস্তক অবনত করতে পারব। সকল কল্যাণের উৎস তিনি এবং সকল প্রশংসা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়। পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার মহত্ব বিশাল আসমানসমূহ ও জমিনের সকল স্থানে দৃশ্যমান ও স্পষ্ট এবং পরাক্রম ও প্রজ্ঞার মালিক কেবল তিনিই।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টি এক আল্লাহর মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এক্ষেত্রে আসমান, জমিন ও অন্যান্য বস্তুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

২- ক্ষমতা ও পরাক্রম তখনই সঠিকভাবে কাজে আসে যখন তার সঙ্গে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমন্বয় সাধিত হয়।

৩- আল্লাহ তায়ালাকে সঠিকভাবে চেনার সঙ্গে তাঁর ইবাদতের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।  তাঁকে সঠিকভাবে চিনতে না পারলে ইবাদতে মনযোগী হওয়া কঠিন।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ