আগস্ট ১০, ২০২১ ১৮:১৬ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে কারবালার শাশ্বত বিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

গত পর্বের এক পর্যায়ে আমরা বলেছিলাম মহররম ও কারবালার মহাবিপ্লবকে বুঝতে হলে সব কিছুর আগে ভালোভাবে জানতে হবে প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলামের মূল কাণ্ডারিদের প্রকৃত মর্যাদা এবং বিশেষভাবে হযরত ইমাম হুসাইন (আ)’র প্রকৃত পরিচয় ও মর্যাদার স্বরূপ। একইসঙ্গে বুঝতে হবে প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলামের বিপরীত পথে চলা পশু-শক্তির মূল কুচক্রী ও তাদের কারসাজিগুলোকেও। প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলাম ও এর মূল কাণ্ডারিদের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকার কারণে আজও অনেক সাধারণ মুসলমানের মধ্যে কারবালা বিপ্লবের মহত্ত্ব ও শিক্ষা সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তি ও এমনকি খুব বিপজ্জনক চিন্তাধারাও বজায় রয়েছে। খোদাদ্রোহী জালিম উমাইয়া গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী গোত্রবাদী রাজনৈতিক ধারাগুলোর ভুল চিন্তাধারা এবং কায়েমি স্বার্থবাদী প্রচারণার কারণে অনেক অসচেতন সাধারণ মুসলমান মনে করেন যে, কারবালার ট্র্যাজেডি মহান আল্লাহরই পরিকল্পিত ইচ্ছার প্রকাশ। তাই মুয়াবিয়াপন্থী আর ইয়াজিদি-গোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মুসলিম রাজশক্তি ও স্বৈরতান্ত্রিক ধারার সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য মুসলমানদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। তা ছাড়া আল্লাহ নিজে চাইলেই তো এতসব নৃশংসতা ঠেকাতেই পারতেন।     

এ ধরনের চিন্তাধারা একদিকে যেমন অজ্ঞতাপ্রসূত ও অন্যদিকে ইসলামের শত্রু  বা মুনাফিক গোষ্ঠীর লালিত প্রচারণারই প্রভাব মাত্র। ফলে এইসব বিভ্রান্ত মুসলমান ভাবেন যে মুসলমানদের রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় যদি কোনো জালিম, খোদাদ্রোহী ও স্বৈরতান্ত্রিক ও চরিত্রহীন ব্যক্তিও ক্ষমতাসীন হয় তাহলে তার আনুগত্য করা বৈধ এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। আর ওই যুগেও ইমাম হুসাইনের উচিত হয়নি ইয়াজিদি  স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামা! (নাউজুবিল্লাহ) মুসলিম বিশ্বের অনেক অংশেই আজো এই বাক্যটি একটি শিরোধার্য নীতি হিসেবে বিবেচিত হয় যে রাজা-বাদশাহরা হচ্ছেন আল্লাহর ছায়া! তাই তাদের দোষত্রুটি থাকলেও তা বলতে নেই ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে নেই। এভাবে তারা ইয়াজিদ ও মুয়াবিয়ার মত মহাবিচ্যুত ও কুলাঙ্গারদেরকেও গ্রহণযোগ্য নেতা বলে বিবেচনা করেন! আর মুসলমানদের মধ্যে যদি আজও এমনসব বিপজ্জনক ধারণা বদ্ধমূল হয়ে থাকে তাহলে তাদের মধ্যে সত্যিকারের ইসলাম তথা মুক্তিকামী প্রকৃত ইসলাম, ন্যায়বিচারকামী ইসলাম তথা মুহাম্মাদি ইসলাম বাস্তবায়ন খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ফলে বুশ-ব্লেয়ার, ট্রাম্প, শ্যারণ ও নেতানিয়াহুর মত আধুনিক যুগের ফেরাউন আর নমরুদদের সব গণহত্যা ও অপরাধকেও বৈধতা দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না!

আর এরই প্রেক্ষাপটে এটা জরুরি যে প্রত্যেক মুসলামের উচিত প্রকৃত ইসলামের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি ইমাম হুসাইনের পরিচয় ভালোভাবে জানা এবং তার কারবালা মহাবিপ্লবের গুরুত্বকেও বোঝার চেষ্টা করা।

চতুর্থ হিজরির ৩ শাবান মদীনা মুনাওয়ারায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দুহিতা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর কোলে জন্মগ্রহণ করে এক পুত্রসন্তান। যাঁর জন্ম কেবল বিস্ময়কর ও অসাধারণই ছিল না, তাঁর গোটা জীবনকাল ও গৌরবময় শাহাদাত ছিল অশেষ রহস্যে পরিপূর্ণ। তাঁর মাতা যদি সক্ষম হতেন তাহলে তাঁকে দুধ পান করাতেন। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর নানা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জিহ্বা ও আঙ্গুল চুষেই পরিতৃপ্ত হতেন, শান্ত হয়ে যেতেন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ইমাম হুসাইনকে কাঁধে বসাতেন এবং বলতেন : ‘এ বালক ও তার ভাই দুনিয়ায় আমার দু’টি সুগন্ধি ফুল (রায়হান)।’ তিনি বারবার বলতেন : ‘হুসাইন আমা থেকে, আর আমি হুসাইন থেকে।’ আরও বলতেন : ‘এরা দু’ভাই আমার আহলে বাইতের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।’ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁদের সম্পর্কে বলতেন : ‘হাসান ও হুসাইন বেহেশতের যুবকদের নেতা।’

ইমাম হুসাইন (আ.) ইসলামের মহাবিদ্যালয়ে অর্থাৎ যে গৃহে জিবরীল (আ.) আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হতেন সেখানেই মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কোলে এবং হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের সান্নিধ্যে ও মা ফাতেমা যাহ্‌রার পবিত্র আঁচলের ছায়াতলে বড় হন। তাঁর শিক্ষার উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হন এ বিশ্ববিদ্যালয়েই। তাঁরই সহপাঠীবৃন্দ,যেমন হযরত সালমান ফারসি, হযরত মিকদাদ, হযরত আবু যার, হযরত ইবনে আব্বাস প্রমুখ তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন, কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে তাঁর চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন। যেমনটা আমরা জানি যে, ইবনে আব্বাস তাঁর নেতৃত্বে চলাকে নিজের জন্য গৌরবের কারণ বলে মনে করতেন এবং এ বিষয়টিকে নিজের জন্য সৌভাগ্য বলে ভাবতেন।

মহানবীর (সা) সাহাবি আবু হুরায়রা ইমাম হুসাইনের পবিত্র পদধূলি নিজের জামা দিয়ে মুছেছেন এবং এ কাজের জন্য গর্বও করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন : ‘আমি স্বচক্ষে দেখেছি যে, হুসাইন তার দু’পা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বুকের ওপরে রেখেছিল। আর রাসূল তাঁর জিহ্বায় চুমু দিচ্ছিলেন ও বলছিলেন : (اللهم احبه فانی احبه) ‘হে আল্লাহ্‌! একে তুমি ভালোবাস। কেননা, আমিও একে ভালোবাসি।’

ইমাম হুসাইন (আ.) প্রথম খলিফা আবু বকরের খেলাফতকালে যদিও মাত্র দশ বছরের এক বালক ছিলেন, তদুপরি বুজুর্গ সাহাবীবৃন্দের ফতোয়া ও জ্ঞান শিক্ষার আসরে অংশগ্রহণ করতেন। সাহাবীরা তাঁকে নিজেদের জায়গায় এনে বসাতেন এবং তাঁর প্রতি এতটা শ্রদ্ধা প্রকাশ করতেন যা আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর কিম্বা আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরের প্রতি করতেন না। ইমাম হুসাইন (আ.) এমন এক ঘরে বেড়ে ওঠেন যে ঘরের অধিবাসীরা তথা আহলে বাইত তাঁদের সর্বস্ব ধর্মের পথে উৎসর্গ করতেন এবং এ পথে তাঁদের কোন রকম কার্পণ্য বা ভণ্ডামি ছিল না।

ইবনে আসাকির তাঁর তারীখে কাবীর গ্রন্থে, আহমাদ ইবনে সুলায়মান তাঁর ইকদুল লিয়ালী গ্রন্থে, মুবাররাদ তাঁর কিতাবে কামিল-এ, ফখরুদ্দীন রাযী তাঁর তাফসীরে و علم آدم الاسماء -এবং আদমকে শিক্ষা দিলেন নামসমূহ-এ আয়াতের ব্যাখ্যায়, মুহসিনুল হুসাইনী তাঁর লাওয়ায়িজুল আশজান গ্রন্থে, ইবনে কুতাইবা তাঁর উয়ুনুল আখবার গ্রন্থে, ইয়াকুত মুস্তাওসী তাঁর আল-জাওয়ায়িব গ্রন্থে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বদান্যতা ও দানশীলতার শত শত কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যেগুলো আগেকার দিনে মানুষের মুখে মুখে উদাহরণ হিসাবে উচ্চারিত হত। ইমাম হুসাইন (আ.) পূর্ণতা ও পবিত্রতার এমন চরম শিখরে পৌঁছেছিলেন যে, মুবাহালার সেই অগ্নি পরীক্ষায় খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তিনি দ্যুতিময় চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিশ্বের সব ঐতিহাসিকের অকপট স্বীকারোক্তি মোতাবেক ইমাম হুসাইন (আ.) জ্ঞান, সংযমশীলতা, সত্যনিষ্ঠতা, সাহসিকতা,পরোপকার, দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে মুসলমানদের মাঝে ছিলেন হুজ্জাত বা আদর্শ। সবার আশ্রয়স্থলও ছিলেন তিনি। যেমনটা ‘আল হাসান ওয়াল হুসাইন’ গ্রন্থে লেখা হয়েছে : ‘সবদিক বিচারে তিনি তাঁর নানা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে সবচেয়ে বেশি সদৃশ ছিলেন।’

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে অনেক প্রসিদ্ধ দোয়া, অগণিত কারামাত ও অলৌকিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ফলে তিনি অশেষ ও অফুরন্ত প্রশংসায় অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। মনে হয় ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর নিজের পরিচয় তাঁর শাহাদাতের পূর্ব মুহূর্তে এ একটি বাক্যের মাধ্যমেই সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন : ‘হে আল্লাহ্‌! তুমি জান যে, এরপর জমিনের বুকে তোমার নবী-দুহিতার কোন পুত্রই আর রইল না।’#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/ মো.আবুসাঈদ/০২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ