আগস্ট ১২, ২০২১ ১৭:০৪ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে কারবালার শাশ্বত বিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার তৃতীয় পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

কারবালার শাশ্বত বিপ্লবের ঘটনা-প্রবাহ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য অনুধাবন   নিয়ে নানা বিভ্রান্তি দেখা যায়। এর কয়েকটি কারণ হচ্ছে কায়েমি স্বার্থবাদীদের অপব্যাখ্যা, ধুম্রজাল ও বেদাআত বা কুপ্রথা প্রতিরোধের নামে কারবালার বিপ্লবী চেতনাগুলো প্রতিরোধের চেষ্টার পাশাপাশি সরলমনা মুসলমানদের অজ্ঞতা, সরলতা এবং  ইসলামের সঠিক ও বিপ্লবী ধারা থেকে দূরে থাকা। বিষাদ-সিন্ধু জাতীয় কোনো কোনো সাহিত্য-কর্মে কারবালার শাশ্বত বিপ্লবকে মহান ইসলামের বৈপ্লবিক নীতিমালা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা হিসেবে না দেখিয়ে একে দেখানো হয়েছে নারী-ঘটিত জাগতিক প্রেম নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থেকে উৎসারিত মর্মান্তিক ঘটনা-প্রবাহ হিসেবে!

কারবালার মহাবিপ্লবের অদৃষ্টবাদী ব্যাখ্যাও অনেকে প্রচার করেন অজ্ঞতার কারণে অথবা জালিম গোষ্ঠীগুলোর অশুভ উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা দেয়ার উদ্দেশ্যে। অদৃষ্টবাদীদের কেউ কেউ বলেন, মহান আল্লাহ তো জানতেন এমনটা হবেই তাহলে তিনি কেনো ইয়াজিদি জুলুম ঠেকানোর ব্যবস্থা নিলেন না অথবা কেনো ইয়াজিদ বাহিনীর ওপর আযাব নাজিল করলেন না!?। অথবা এভাবেও বলেন যে ভাগ্যের লিখন যায় না খণ্ডন!

আসলে শিক্ষক যখন জানেন যে পড়াশুনায় অমনোযোগী ও অলস ছাত্ররা পরীক্ষায় খারাপ ফল করবে এবং তার হুঁশিয়ারিকেও গুরুত্ব না দিয়ে এ ধরনের কোনো কোনো ছাত্র পরীক্ষায় ফেল করবে ও শেষ পর্যন্ত যখন তারা যখন খারাপ ফল করেই বসে   সে জন্য যেমন শিক্ষকের ভবিষ্যদ্বাণীর জ্ঞানকে যেমন দায়ী করা যায় না তেমনি জালিমদের জুলুমের জন্যও সব বিষয়ে জ্ঞানী মহান আল্লাহর ভবিষ্যত সম্পর্কিত জ্ঞান থাকাকে দায়ি করা যায় না। অন্যদিকে মহান আল্লাহ মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করবেন বলে কুরআনেই উল্লেখ করেছেন। তাই কারবালার মহাপরীক্ষায় যারা ফেল করেছেন তার জন্য মহান আল্লাহ দায়ী নন। অন্যদিকে ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর নিবেদিত-প্রাণ যে সঙ্গীরা অনন্য কৃতিত্বের সঙ্গে মহান আল্লাহর এই মহাপরীক্ষায় পাস করেছেন তাও জোর করে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাস করিয়ে দেয়া বা ঘটনাক্রমে তথা ভাগ্যের জোরে পাস করে ফেলার মত বিষয়ও ছিল না। সত্যের পক্ষে সব সময়ই বেশি মানুষ পাওয়া যায় না, বরং সত্যের তথা ঈমানের কঠিন পরীক্ষায় কখনও কখনও মাত্র মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষই অবিচল থাকতে পারে। অনেক নবী-রাসুলের জীবনীতে দেখা যায় যে তারা শত শত বছর ধরে সত্যের পক্ষে প্রচার কাজ চালিয়েও মাত্র হাতে গোনা কয়েকজনকে সমর্থক করতে পেরেছেন!

পবিত্র মহরমের শোকানুষ্ঠান

মহানবী (সা)সহ অতীতের সব নবী-রাসুল জানতেন যে কারবালা নামক ঈমানের মহাপরীক্ষাস্থলে ইসলামকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবেন ইমাম হুসাইন (আ) ও নবীপরিবারের অনেক সদস্যসহ একদল নিবেদিত প্রাণ খাঁটি মুসলমান।  তাঁরা ইমাম হুসাইনের জন্য আগাম কান্নাও করেছেন বলে বর্ণনা রয়েছে।  আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলীও জানতেন যে কারবালায় একদিন কি কি ঘটবে। একবার তিনি যখন (৩৬ হিজরির শাওয়াল মাসে) বিদ্রোহী মুয়াবিয়াকে দমনের জন্য ইরাকের কারবালা হয়ে সিরিয়ার দিকে যাচ্ছিলেন তখন তিনি কারবালার ময়দানে যাত্রা বিরতি করে স্পষ্টভাবেই কয়েকজন সঙ্গীকে দেখিয়ে বলে দেন যে: এখানেই আমার হুসাইনকে শহীদ করা হবে! এখান থেকে একদল বিভ্রান্ত মুসলমান হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে সরাসরি জাহান্নামে যাবে ও অন্য অল্প এক দল মুসলমান হুসাইনের সঙ্গী হয়ে শাহাদাত বরণ করে সরাসরি বেহেশতে যাবে। ওই যে ওই স্থানটাতে হুসাইনের কাফেলার মাল-সামান নামানো হবে ও ওই স্থানটাতে সফরের পশু তথা উট-ঘোড়াদের পানি দেয়া হবে! কারবালার ঘটনার প্রায় ২৫ বছর আগে  হযরত আলীর এই সফরের একজন সঙ্গী বা সহযোদ্ধা ওই স্থানে হযরত আলীর কান্নার ঘটনাও উল্লেখ করে বলেছিলেন আমরাও সেদিন খুব কেঁদেছিলাম!

কিন্তু পরিহাসের বিষয় হল আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলীর ওই ভবিষ্যদ্বাণীর সাক্ষী সেই ব্যক্তিটি তথা সেদিনের সেই সফরসঙ্গী, ইমাম হুসাইনের পক্ষে আগাম কান্নাকারী ও পরে সিফফিনের যুদ্ধে আলীর পক্ষে লড়াই করা ওই ব্যক্তি ইয়াজিদ বাহিনীর সদস্য হয়ে ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কারবালায় এসেছিল! ঘটনাক্রমে তার স্মৃতিতে প্রায় দুই যুগ আগের  হযরত আলীর সেই কথাগুলো স্মরণে আসে।  স্মরণে আসার পরপরই সে ইয়াজিদ বাহিনীর প্রতি ঘৃণাভরা মন নিয়ে তাদের শিবির ত্যাগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে ইমাম হুসাইনের শিবিরে গিয়ে ইমামের সঙ্গে দেখা করেন ও সব ঘটনা খুলে বলেন। ইমাম তখন বলেন যে তুমি কি এখন আমাদের দলে না ওই দলে আছ? সে বলল: কোনো দলেই না! আমি ভয় পাচ্ছি যে ইয়াজিদ বাহিনী বা ক্ষমতাসীন সরকারের লোকেরা আমার পরিবারকে কষ্ট দেবে বা আমার ঘড়বাড়ি দখল করবে! এভাবেই ওই ব্যক্তি সরাসরি বেহেশতে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করে! ইমাম তাকে বলেন যে আমি কারবালায় সম্ভাব্য যুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানানোর আগেই তুমি এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যাও নইলে তুমি আমায় সাহায্য না করার অপরাধে জাহান্নামে যাবে। লোকটি মহররমের প্রথম দিকেই ওই অঞ্চল ছেড়ে নিজ বাড়ির দিকে চলে যায়!

কারবালার মহাবিপ্লবের  ঘটনায় এভাবেই অনেকে ভয়ের কারণে, পরিবার ও ধন-সম্পদ আর দু-দিনের পার্থিব জীবনের প্রতি অতিরিক্ত মায়ার কারণে সত্যের শিবিরে যুক্ত হতে পারেনি। ওই মহাপরীক্ষায় অনেকেই তাই পাস করতে পারেননি। আর অনেকে ইমামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরাসরি জাহান্নাম কিনে নিয়েছিল। অন্যদিকে ইমাম, নবী-পরিবার ও ইমামের সঙ্গীরা সত্য আর বাস্তবতাকে বুঝতে পেরে বাহ্যিক পরাজয় ও শাহাদাতকে নিশ্চিত জেনেও সব প্রলোভন ও ভয় কাটিয়ে সরাসরি বেহেশেতে যাবার সুযোগ লুফে নিয়েছিল। আর অনন্য বীরত্ব ও ত্যাগের জন্য তাদের নামও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে গেছে হুসাইনি সেনা হিসেবে। আর যারা প্রবল অনুরাগ সত্ত্বেও অনিবার্য ও অপ্রতিরোধ বাধার কারণে ইমামের শিবিরে যোগ দিতে পারেনি তাদেরকেও মহান আল্লাহ ইমামের সঙ্গী হিসেবে কবুল করবেন। আর বর্তমান যুগেও যারা ইমামের অনুরাগী ও প্রকৃত বিপ্লবী ইসলামের অনুরাগী হিসেবে সব ময়দানে সক্রিয় থাকবেন তারাও ইমামের সঙ্গী হওয়ার মর্যাদা পাবেন এবং ভীরু, কাপুরুষ ও জালিম শক্তিগুলোর সঙ্গে আপোষকারীরা আল্লাহর কাছে ইয়াজিদি শক্তির অনুচর হিসেবেই বিবেচিত হবেন। #

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/ মো.আবুসাঈদ/০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ