আগস্ট ১৩, ২০২১ ১৬:২০ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে কারবালার শাশ্বত বিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার চতুর্থ পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

কারবালার শাশ্বত মহাবিপ্লবের ঘটনা-প্রবাহের ব্যাখ্যা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে নানা মহলে প্রচলিত বিভ্রান্তির কয়েকটি কারণ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি গত পর্বে। মহান আল্লাহ কেনো ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর সহযোগীদেরকে ইয়াজিদি গোষ্ঠীর নৃশংসতম ও চরম পাশবিক জুলুমের শিকার হতে দিলেন তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন এবং এর মাধ্যমে তারা এটা বোঝাতে চান যে মহান আল্লাহই এমন সব ঘটনার জন্য দায়ী, ইসলামের পথ থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত ইয়াজিদ-মুয়াবিয়ার উমাইয়া গোষ্ঠী দায়ী নয়! -আসলে মহান আল্লাহ'র গায়েবি মদদ কখন নাজিল হবে তা নির্ভর করে থাকে  ঘটনা-প্রবাহের প্রকৃতি ও পরিস্থিতির আলোকে যা মানুষের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণকর সেই কল্যাণের বিষয়টি ঘটতে দেয়ার ওপর। তাই সব সময়ই যে মহান আল্লাহর প্রিয় ওলি বা নবী-রাসুল ও ইমাম বা মুমিনরা বাহ্যিক বিজয় অর্জন করেন তা নয়। এক পক্ষের পাপের পেয়ালা পূর্ণ হতে দিতে ও অন্য পক্ষের ধৈর্য ও ঈমানের পরীক্ষা পরিপূর্ণ করার সুযোগ দিতে অনেক সময় আল্লাহর প্রিয় ওলি বা নবী-রাসুল ও ইমাম বা মুমিনরা ব্যাপক ও অসাধারণ কষ্টের শিকার হয়ে থাকেন। এ কারণেই মহান আল্লাহ সব সময় তাঁর প্রিয় ওলিকে বা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বিরাজমান নবী-রাসুল বা ইমামকে হযরত ইব্রাহিমের মত আগুনে প্রজ্জ্বলিত হওয়া থেকে রক্ষা করার মত সহায়তার গায়েবি পদক্ষেপ বা বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের নৃশংস নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার মত বাহ্যিক সুরক্ষার পদক্ষেপ নেন না। ফলে দেখা যায় বনি ইসরাইলের অনেক নবী নিজ জাতির হাতে শহীদ হয়েছেন।  নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছেন মহান নবী হযরত ইয়াহিয়া-আ ও তাঁর পিতা হযরত জাকারিয়া-আ। এর মানে এই নয় যে মহান আল্লাহই তাঁদের ওপর ওইসব জুলুমের জন্য দায়ী। তাই এইসব ঘটনা ঘটতে দেয়া ছিল সত্যের ও অসত্যের শিবিরের অনুসারী সবার জন্যই পরীক্ষা।

আর বাহ্যিক পরাজয় মানেই সব সময় পরাজয় নয়। অন্যদিকে বাহ্যিক জয় মানেই সব সময় বিজয় নয়। তৎকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে  ইমাম হুসাইনের মহাবিপ্লবের প্রকৃত বিজয়ের জন্য দরকার ছিল তাঁর ও তার মুষ্টিমেয় সঙ্গীদের শাহাদাত লাভের। আর যদি জনগণ ব্যাপক মাত্রায় ইমামের বিপ্লবে শরিক হত তাহলে একইসঙ্গে বাহ্যিক বিজয়ও অর্জন করত সত্যের পক্ষ। সেদিন ইমাম হুসাইন যদি ইয়াজিদি জুলুম ও শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতেন তাহলে ইসলামের নীতিমালা ভূলুণ্ঠিত হত ও ইসলাম হয়ে পড়ত জালিম শাসকদের শোষণের অতি সহজ হাতিয়ার। আর সবাই বলতো মহানবীর নাতিই তো জুলুমের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি বরং নীরব থেকে জালিম ও খোদাদ্রোহী শাসনকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। ইমাম হুসাইনের পক্ষে যেমন আপোষকামী হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না খোদায়ি অঙ্গীকারবদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার কারণে তেমনি জালিম ইয়াজিদি চক্রের পক্ষেও ইমামের প্রতিরোধ বা বিদ্রোহ মেনে নিয়ে তাদের দীর্ঘকালের বিলাসী সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে নড়বড়ে হতে দেয়ার সুযোগ ছিল না দুনিয়া- বিলাসী, লোভী ও খোদাদ্রোহী জালিম শাসকদের স্বাভাবিক রীতির আলোকেই।

ইমাম হুসাইনের বিপ্লবের মাধ্যমে একদিকে ইসলামের সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের নীতি যেমন সুরক্ষা পেয়েছে এবং এই মহান লক্ষ্যের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের সংস্কৃতিও যেমন গড়ে উঠেছে তেমনি জালিম উমাইয়া রাজতান্ত্রিক গোষ্ঠীর ভিত্তিও নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল। একইসঙ্গে পবিত্র কুরআনের এই বাণীও অত্যন্ত জীবন্ত ও বাস্তব হয়ে দেখা দেয় যে, যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তারা মৃত নয় বরং তারা জীবিত। আজ বিশ্বের বুকে ইমাম হুসাইনের মত বেশি জীবন্ত, বেশি আলোচিত ও সম্মানিত ব্যক্তি আর ক'জন আছেন? অন্যদিকে সেদিনের অসম যুদ্ধে বাহ্যিকভাবে বিজয়ী ইয়াজিদের মত ধিক্কৃত, নিন্দিত ও কলঙ্কিত ও পরাজিত ব্যক্তি আর কেউ কি আছে? ইমাম হুসাইনের জন্য এ পর্যন্ত বিশ্বের যত মানুষ অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন ও এমনকি যত অমুসলিমও বেদনাহত হয়েছেন সেইসব অশ্রুকে জমা করা হলে তা হবে একটি বড় সাগরের সমান।

কারবালার মহাবিপ্লব সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে এটাও বলা হয় যে ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর বড় ভাই ইমাম হাসান (আ)'র মতই কেনো কথিত আপোষের নীতি গ্রহণ করেননি?  বাস্তবতা হল ইমাম হাসান কখনও মুয়াবিয়াকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। তিনি বিদ্রোহী ও বিচ্যুত শাসক  মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর পিতা আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর জিহাদকে অব্যাহত ও গতিশীল রাখতে খেলাফত লাভের পরই সেনাদের বেতন একশ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে  তাঁর পক্ষে ইমাম হুসাইনের মুষ্টিমেয় সহযোগীর মত নিবেদিতপ্রাণ ও নীতিতে অবিচল সেনা বা সমর্থক বলতেও কেউ অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর প্রধান সেনাপতিই গোপনে মুয়াবিয়ার সঙ্গে আপোষ করে অর্থের বিনিময়ে ইমাম হাসানকে মুয়াবিয়ার হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছিল।

 অন্যদিকে সাধারণ জনগণও আর যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে চায়নি। ওদিকে রোমান সাম্রাজ্য ওঁত পেতে ছিল মুসলমানদের মধ্যে কোনো কঠিন  ঘরোয়া দ্বন্দ্বের অপেক্ষায় যাতে ইসলামী সাম্রাজ্যে হামলা চালিয়ে মুসলমানদের রাষ্ট্র-ব্যবস্থা ও ধর্মের বারোটা বাজিয়ে দেয়া যায়। এ অবস্থায় জনগণের জিহাদ-বিুমখতা দেখে ইমাম হাসান যুদ্ধ-বিরতি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হন।  আর মুয়াবিয়া একজন বিচ্যুত, অর্থ ও ক্ষমতালোভী এবং কপট ধর্মাচারী শাসক হওয়া সত্ত্বেও ইয়াজিদের মত প্রকাশ্যেই মদপান ও ব্যভিচারের মত প্রকাশ্য নানা পাপে জড়িত হত না। বরং ইসলামের নাম ও শ্লোগান ব্যবহার করেই সে সব কিছু করত। ফলে বিভ্রান্ত এক বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে মুয়াবিয়ার আসল চেহারা স্পষ্ট করার জন্যও  মুয়াবিয়ার সেই যুদ্ধ-বিরতির প্রস্তাবে সায় দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু ইমাম হুসাইনের সময়কার ইয়াজিদি শাসনের প্রকৃতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে প্রকাশ্যেই ব্যভিচার, জুয়া ও মদপানের মত গর্হিত কাজে নিয়মিত ব্যস্ত থেকে প্রকাশ্যেই ইসলামের বারোটা বাজানোর ও ইসলাম অবমাননার ষোলোকলা পূর্ণ করার কাজে মশগুল ছিল। তাই তার সঙ্গে এক মুহূর্তের জন্যও আপোষ করার কোনো সুযোগ ছিল  না ইমাম হুসাইনের মত একজন পবিত্র ও খোদায়ি নেতৃত্বের মর্যাদাধারী এবং বেহেশতি যুবকদের অন্যতম সর্দার হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত ব্যক্তিত্বের কাছে। #

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/ মো.আবুসাঈদ/০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ