আগস্ট ১৬, ২০২১ ১৯:৪৬ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে কারবালার শাশ্বত বিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার সপ্তম পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।

কারবালা বিপ্লবের ঘটনা-প্রবাহ, শিক্ষা ও তাৎপর্য নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী অনেকেই বলেন যে মহানবীর (সা) আহলে বাইতের অনুসারী হওয়ার দাবিদার কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা ও অসহযোগিতার কারণেই কারবালার শোকাবহ ট্র্যাজেডি ঘটেছিল এবং কুফায় হযরত  আলীর শিয়া বা আলীর সমর্থক গোষ্ঠীর অনেকেই ইমাম হুসাইনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় ও অনেকে সময়মত এই মহান ইমামের সহযোগিতায় এগিয়ে না আসায় ওই মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছিল। এভাবে কেউ কেউ কারবালায় নবী-পরিবারের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও পাশবিকতার জন্য কেবল একটি বিশেষ সম্প্রদায়কেই দায়ী করেন বা দোষ দেন। তারা আরও বলেন, ওইসব অপরাধবোধের কারণেই তারা পরবর্তীকালে আশুরার ঘটনা উপলক্ষে তীব্র শোক প্রকাশ বা মাতম করে থাকেন।

বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এইসব ব্যক্তি কুফার শিয়া মুসলমানদের বাইরে অন্য মুসলমানদের মধ্যে যে কোনো দোষ দেখতে পান না তা একদিকে যেমন অনিরপেক্ষ ও অযৌক্তিক মতামতের প্রকাশ তেমনি তা কারবালার মহাবিপ্লবের শিক্ষা সংরক্ষণেরও পরিপন্থী। এই শ্রেণীর বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকে তো খোদ ইমাম হুসাইনকেই দোষ দিয়ে বলেন, তিনি কেনো বিখ্যাত সাহাবিদের মতামত বা সতর্কবাণী উপেক্ষা করে কুফার দিকে রওনা হয়েছিলেন ? সাহাবারা সবাই তো আর ভুল করেননি নিশ্চয়ই।

শেষোক্ত এই মতামতও অযৌক্তিক এই কারণে যে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সাহাবিদেরকে ত্রুটিমুক্ত ও পাপমুক্ত থাকার গ্যারান্টি দেননি, কিন্তু মহানবীর আহলে বাইত যে ভুল-ত্রুটি ও পাপের উর্ধ্বে থাকবেন তার গ্যারান্টি দিয়েছেন সুরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে। আর বেশিরভাগ মানুষ যেদিকে থাকবেন সেইদিকেই যে সত্য থাকবে তার গ্যারান্টিও কুরআনে দেয়া হয়নি। বরং পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে বেশিরভাগ মানুষই অকৃতজ্ঞ ও তারা চিন্তাশীল বা দূরদর্শী নয়। এটা ঠিক যে ইমাম হুসাইনের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ও তাঁর  অতি ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ কুফাবাসীদের দোদুল্যমান চরিত্রের আলোকে সেখানে না যেতে ইমামকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম যে কেবল কুফাবাসীদের দাওয়াত বা বাহ্যিক সমর্থনের ওপর ভরসা করেই কুফার দিকে রওনা দিয়েছিলেন তা নয়। কারণ তাঁর জন্য মদিনা ও শান্তির শহর মক্কাও নিরাপদ ছিল না। হজের সময় ইয়াজিদের গুপ্ত ঘাতকরা ইমাম হুসাইনকে গোপনে হত্যার চেষ্টা করবেন এটা জেনেই তিনি হজের কাজ শেষ না করেই বা হজে যুক্ত না হয়েই কুফার দিকে রওনা দেন, যদিও তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে কুফাও তাঁর জন্য নিরাপদ নয়।  পবিত্র মক্কা ও মদিনায় অশান্তি সৃষ্টি হোক বা তিনি সেখানে গুপ্ত ঘাতকদের হাতে নিহত হবেন এটা ইমামের প্রত্যাশা বা ইচ্ছা ছিল না। কারণ তাতে কারবালার বিপ্লবের মত আবেদনমূলক কিছু থাকতো না। ইমামের নিহত হওয়াকে তখন দুর্ঘটনা বলে প্রচার করত ক্ষমতাসীন ইয়াজিদি গোষ্ঠী।

আসলে মহান আল্লাহ ইমাম হুসাইনকে ইসলামকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই শহীদ হতে দেখতে চেয়েছিলেন। আর এটা মদিনায় তিনি নানাজীর কবর জিয়ারতের সময় স্বপ্নযোগে নানার কাছ থেকেই জানতে পারেন। আর তিনি যদি কুফার দিকেও না যেতেন তাহলে কুফাবাসীসহ অন্যরা তখন বলত কুফাবাসীরা ইয়াজিদি জুলুমের বিরুদ্ধে বিপ্লব ও আন্দোলনের দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও ইমাম হুসাইনে জীবন ও পরিবার পরিজনের মায়ায় সংগ্রামের পথ থেকে দূরে থেকেছেন এবং ইতিহাসও তাঁকে তখন ভীরু বা কাপুরুষ বলে সমালোচনা করত।

আর কারবালার ঘটনার জন্য শোক প্রকাশের নির্দেশ দিয়ে গেছেন স্বয়ং ইমাম হুসাইন-আ। ইমামের বোন হযরত জাইনাব ও পুত্র জাইনুল আবেদিনই তা বাস্তবায়ন শুরু করেন যাতে কারবালার ঘটনাকেও নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে না পারে ইয়াজিদের খোদাদ্রোহী প্রশাসন এবং জনগণ সত্যকে জেনে ইমামের আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষা নিয়ে শাহাদাতের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। যুগে যুগে নবী-রাসুলরাও যখন ইমাম হুসাইনের জন্য কেঁদেছেন তখন এই শোককে শক্তিতে পরিণত করার সংস্কৃতি যে মহান আল্লাহরই কাম্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মহানবী (সা) ইয়াজিদকে আগাম অভিশাপ দিয়ে গেছেন এবং কিয়ামতের দিন তাকে শাফায়াত করবেন না বলে বলে নির্ভরযোগ্য  ইসলামী বর্ণনা রয়েছে। আর ওই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় ইমামের হত্যার জন্য ইয়াজিদ ও তাঁর দলবলই দোষী।

আল-হাফেয আবু বকর আল-বাগদাদী প্রণীত তারিখ আল বাগদাদ নামক বইয়ে এসেছে: জাবির বিন আব্দুল্লাহ্ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,“আমি মহানবীকে শিশু ইমাম হুসাইনের ঊরুদ্বয় ফাঁক করে চুম্বন করতে দেখলাম। এ সময় তিনি বলেছিলেন : হে হুসাইন! তোমার হত্যাকারীর ওপর অভিশাপ বর্ষিত হোক!’’ জাবির বলেন,“আমি এ কথা শুনে বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! কে হুসাইনকে হত্যা করবে? মহানবী বললেন : আমার উম্মতের মধ্যে থেকে আমার বংশধরদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী এমন এক ব্যক্তিই হবে আমার হুসাইনের হত্যাকারী। আমি কিয়ামত দিবসে তার জন্য শাফায়াত করব না।’’

হযরত মায়ায (রা.) বলেন,“মহানবী (সা.) বলেছেন : ইয়াযীদের অমঙ্গল হোক!... যে মাটিতে ইমাম হুসাইন নিহত হবে সে মাটির কিছু অংশ আমার কাছে আনা হয়েছিল।”

আসলে ইসলামের শত্রুরা ও ভোগবাদী তাগুতি শক্তি চায়না যে মুসলমানরা কারবালা বিপ্লবের শিক্ষা থেকে উৎসারিত শহীদী চেতনার বিকাশ ঘটুক যাতে তাদের রাজত্ব ও শোষণ টিকে থাকে। আর এ কারণেই তারা ইমাম হুসাইনের ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাতের ঘটনার জন্য শোক প্রকাশের বিরোধী।

উল্লেখ্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ইমাম হুসাইনকে কুফায় যেতে নিষেধ করেছিলেন স্রেফ ব্যক্তিগত ভালবাসার কারণে তারা ইমামের আন্দোলনের অত্যন্ত উচ্চ মানের অতি মহান লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। এইসব ব্যক্তির মধ্যে ইমামের একজন সৎ ভাইও ছিলেন। অন্যদিকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর এ বিষয়ে ইমামকে কিছুই বলেননি। মনে করা হয় তিনি চাইতেন যে ইমাম নিহত হোক এবং এরপর কখনও ইয়াজদের পতন ঘটলে তিনি নিজেই মুসলমানদের খলিফা হওয়ার চেষ্টা করবেন। আর এ কারণে তিনি ইয়াজিদের সহযোগী ও কারবালার খুনিদের হত্যার মহানায়ক মুখতারের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনেরও বিরুদ্ধে একটি নিজস্ব ধারার রাজনৈতিক গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/ মো.আবুসাঈদ/০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।