সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২১ ১৮:২১ Asia/Dhaka

বলা হয়ে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধার দেশ। অনেকে মজা করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে কোন্‌ কোন্‌ ক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও যে সুযোগটির বিষয়ে একদম বিতর্ক নেই তাহলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের গুলি চালানোর অবাধ সুযোগ দিয়ে রেখেছে।

অন্যভাবে বলা যায় গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যার অবাধ সুযোগ রয়েছে আমেরিকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টার বা সিডিসি'র পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গড়ে ৩১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন মারা গেছেন কমপক্ষে ১০০ জন। অন্যান্য পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতিদিন ২১টি শিশু এবং কিশোরকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। মার্কিন গণমাধ্যমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকায় শিশুমৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এছাড়া সেদেশে অস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যার ঘটনাও অনেক বেড়ে গেছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ জন কোজি বলেছেন, মার্কিন নাগরিকদের জন্য এখন নিজ দেশে বসবাস করাটা আফগান যুদ্ধে যাওয়ার চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আমেরিকানরা  সহিংসতা চালিয়ে আনন্দ পায়। রোমানরা আগে সংঘাত ও হত্যা দেখতে কলোসিয়াম বা  গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধের ময়দানে যেতেন এবং হত্যা-নৃশংসতা উপভোগ করতেন। কিন্তু এখন মার্কিন নাগরিকদেরকে ঐটুকু কষ্টও করতে হয় না। মার্কিন নাগরিকরা তাদের ঘরের জানালা খুললেই হত্যার দৃশ্য দেখতে পান।  ২০১৭ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০০ জনের হাতে গড়ে ১২০টির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। অর্থাৎ আমেরিকায় মানুষের ঘরে ঘরে যে অস্ত্র রয়েছে তা তাদের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। আসলে আমেরিকায় পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হত্যাকাণ্ড কোথায় ঘটবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে বন্দুক সহিংসতা নেই। আপনি রেস্টুরেন্টে যাবেন সেখানেও যেকোনো সময় গুলির ঘটনা ঘটে যেতে পারে। গির্জাতেও ঘটতে পারে হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা। আর স্কুল ও কলেজেতো অহরহ ঘটছেই। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে গুলির ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর। স্কুলে বন্দুক সহিংসতাসহ নানা কারণে সেখানে গুলিতে শিশু মৃত্যুর হার অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, সেদেশে প্রতিবছর বন্দুকের গুলিতে এক হাজার তিনশ' শিশু নিহত হয়। প্রতি বছর গুলিতে আহত হয় পাঁচ হাজার আটশ' শিশু। দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছে, আমেরিকায় স্কুলে গুলির ঘটনা ঠেকাতে লাখো ডলার খরচ করা হয়েছে। নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনওআরসি সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৪ শতাংশ বাবা-মা মনে করেন ১৯৯৯ সালের তুলনায় এখন স্কুলগুলোতে সহিংসতা আরও বেড়েছে।  ১৯৯৯ সালের প্রসঙ্গ এসেছে কারণ ঐ বছর কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের কলম্বাইন হাই স্কুলে গুলিতে  ১২ শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষক নিহত হন। ১৭ ও ১৮ বছর বয়সী দুই তরুণ ঐ নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটায়। এরপর দুই তরুণই আত্মহত্যা করে। এই ঘটনায় আরও প্রায় ২১ জন আহত হয়।

কলম্বাইনের হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। এই ঘটনা বিস্মযকর এজন্য যে দুই যুবক দীর্ঘ দিন ধরে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। পুলিশ বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে তারা শহরের কয়েকটি স্থানে হাতে বানানো বোমাও পেতে রেখেছিল। ঐ ঘটনা এতটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল যে, এ নিয়ে দুটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তা সহিংসতা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারেনি। ঘটনার ২০ বছর পর ২০১৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৯৯ সালে কলোরাডোতে কলম্বাইন হাই স্কুলে গণহত্যার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০ বছরে দুই লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী স্কুলে বন্দুক সহিংসতার শিকার হয়েছে। আমেরিকার অনেক গবেষক মনে করেন, মার্কিন স্কুল ও কলেজে সহিংসতা দেশটির গোটা সমাজের সার্বিক সহিংসতার একটি প্রতিচ্ছবি। এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সমাজের অন্যান্য ঘটনার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমেরিকায় প্রতিদিন গুলিতে বহু মানুষের মৃত্যুর পরও কেন এখনও অবাধে অস্ত্র কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করা হয়নি? কেন অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আইন করা যায়নি? আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে প্রভাবশালী লবি হচ্ছে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ। এটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বহন অধিকারের প্রধান মুখপাত্র সংগঠন। এই সংগঠন অস্ত্র বহনের অবাধ সুযোগ অক্ষুন্ন রাখতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ও প্রভাব কাজে লাগায়। মার্কিন নির্বাচনে যারাই প্রার্থী হন তাদেরকেই নির্বাচনী প্রচারের জন্য অর্থ সহায়তা দেয় এই সংগঠন। এ কারণে মার্কিন নেতারা নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও সংসদে গিয়ে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন পাসের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। এছাড়া আমেরিকার অস্ত্র নির্মাণ ও রপ্তানি শিল্প হচ্ছে সেদেশের অর্থনীতির একটি মূল উৎস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হালকা অস্ত্রের বাণিজ্যে আর্থিক লেনদেন ঘটে প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সরকার প্রতিবছর এই খাত থেকে ট্যাক্স পায় ৫৮০ কোটি ডলার। এ কারণে ব্যাপক হত্যা-নৃশংসতার পরও এই খাতের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। 

আমেরিকায় যেকোনো গুলির ঘটনার পর অবিশ্বাস্যভাবে অস্ত্র নির্মাণ কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লাস ভেগাসে গুলির ঘটনার পর পুঁজিপতিরা, অস্ত্র কোম্পানিগুলোর শেয়ার কেনা বাড়িয়ে দেন। তারা আগেই বুঝতে পারেন এত বড় নৃশংসতার পর অস্ত্রের ব্যবসা আরও জমজমাট হয়ে উঠবে। লাস ভেগাসের ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন ৫৯ জন। এরপর অস্ত্র কোম্পানি স্টর্ম ও রুগারের শেয়ারের মূল্য তিন শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া আমেরিকান আউটডোর কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে পাঁচ শতাংশ। ভিস্তা আউটডোর কোম্পানির শেয়ারের দাম দুই শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আমেরিকায় সব সময় এ ধরণের ঘটনার পর মানুষ অস্ত্র কেনা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে অস্ত্র কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। আগ্নেয়াস্ত্র কেনা-বেচা ও বহনের অবাধ স্বাধীনতার সঙ্গে সরাসরি মার্কিন অর্থনীতি ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে আমেরিকা। এ কারণে মার্কিন সরকারের কাছে সব সময় অস্ত্র নির্মাণ কোম্পানির মালিক ও শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবাধে অস্ত্র বহনের পক্ষের সংগঠন ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন বা এনআরএ সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ক্ষমতায় আনতেও  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে ট্রাম্প সব সময় এই সংগঠনের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার দপ্তরকে এই সমিতির পক্ষ থেকে অর্থ দেওয়া হয়েছিল বলে মার্কিন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এ কারণে ফ্লোরিডায় গুলির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে এক বৈঠকে ট্রাম্প ওই সংগঠনের সদস্যদেরকে প্রকৃত দেশপ্রেমী ও বন্ধু বলে উল্লেখ করেন।# 

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ