সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১ ১৭:৪৮ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ৩য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। আরব উপত্যকায় আদ জাতির বসবাসের স্থান বালুকাময় মরুভূমি ছিল বলে এই জনপদকে আহকাফ বলা হতো। এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে ইনশাআল্লাহ আদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হবে। আজ আমরা এই সূরার ১১ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا لَوْ كَانَ خَيْرًا مَا سَبَقُونَا إِلَيْهِ وَإِذْ لَمْ يَهْتَدُوا بِهِ فَسَيَقُولُونَ هَذَا إِفْكٌ قَدِيمٌ ﴿۱۱﴾

“আর কাফেররা মুমিনদের সম্পর্কে বলে: ‘যদি [এই ধর্ম] ভালো হত তবে [তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে] তারা আমাদের থেকে অগ্রগামী হতে পারত না। আর যখন তারা এর দ্বারা হেদায়াত প্রাপ্ত হয়নি, তখন তারা অচিরেই বলবে, এটা তো এক পুরাতন মিথ্যা’।” (৪৬:১১)

আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর প্রথমে মক্কার দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণির মানুষ ইসলাম গ্রহণ করায় কুরায়েশ অধিপতিরা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানায়। তারা বলে, এরা তো সব অভাবী আর খেতে না পাওয়া লোকজন। যদি এই ধর্ম সঠিক হতো তাহলে আমরা যারা বেশি বুদ্ধিমান ও ধনে-জ্ঞানে বড় তারাই এই ধর্মে ঈমান আনতাম। 
কাফের নেতারা অতিরিক্ত অহঙ্কার ও দম্ভের কারণে এ ধরনের যুক্তিহীন কথা বলে বেড়াচ্ছিল। তাদের অন্তর যদি দম্ভ ও অহংকারের কারণে কালিমালিপ্ত না হতো, যদি তারা সম্পদ ও ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে না যেত এবং দরিদ্র মানুষদের মতো সত্য অনুসন্ধানী ও সত্যপীপাসু হতো তাহলে তারাও ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় পেত। 
এ কারণে আয়াতের পরের অংশে বলা হচ্ছে, তারা যেহেতু কুরআনের হেদায়েতের বাণী গ্রহণ করেনি তাই তারা ঈমানদারদের সম্পর্কেও একই কথা ভাবতে থাকে। তারা বলেন, শিগগিরই ঈমানদাররা একথা বলবে যে, কুরআন আল্লাহর বাণী নয় এবং অন্যান্য রূপকথার মতো বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত বক্তব্য মাত্র। তারা নিজেদের ঈমান না আনার অজুহাত হিসেবে আল্লাহর কালামের প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে। 
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কাফেররা নিজেদেরকে মুসলমানদের চেয়ে চতুর ও বুদ্ধিমান মনে করে এবং তারা ভাবে, ইসলামের চেয়ে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস শ্রেয়। 
২- অহংকারী ব্যক্তি নিজের বুদ্ধিকেই ভালোমন্দের মাপকাঠি বলে মনে করে। সে যা পছন্দ করে না, অন্যরা তা পছন্দ করলে সে সবাইকে বোকা মনে করে, অথচ বাস্তবে সে নিজেই বোকা।

সূরা আহকাফের ১২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَمِنْ قَبْلِهِ كِتَابُ مُوسَى إِمَامًا وَرَحْمَةً وَهَذَا كِتَابٌ مُصَدِّقٌ لِسَانًا عَرَبِيًّا لِيُنْذِرَ الَّذِينَ ظَلَمُوا وَبُشْرَى لِلْمُحْسِنِينَ ﴿۱۲﴾

“আর এর আগে ছিল মূসার কিতাব পথ প্রদর্শক ও রহমতস্বরূপ। আর এই কুরআন (তার) সত্যায়নকারী কিতাব, আরবী ভাষায়, যালিমদেরকে সতর্ক করার এবং সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দেয়ার জন্য। ” (৪৬:১২)

পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মক্কার মুশরিকদের মিথ্যা অপবাদের জবাব দিতে গিয়ে এই আয়াতে বলা হচ্ছে: এই কিতাবের সত্যতার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে এই যে, ইসলামের নবীর নাম ও তাঁকে চেনার নিদর্শনগুলো ইহুদিদের কিতাব তাওরাতে উল্লেখ রয়েছে। তাওয়াতের আয়াতের শিক্ষার সঙ্গেও কুরআনের শিক্ষার সামঞ্জস্য রয়েছে এবং এই দুই কিতাব পরস্পরের সত্যায়নকারী। এ থেকে একথা সহজেই অনুমেয় যে, দু’টি কিতাব একই উৎস থেকে নাজিল করা হয়েছে।

পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, তাওরাত হিব্রু ভাষায় এবং কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছে। কিন্তু দু’টি কিতাবেই মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা হয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ পালনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে দু’টি কিতাবই জালিমদেরকে সতর্ক করেছে এবং সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে মহা পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- সৃষ্টির শুরু থেকে যুগে যুগে মানবজাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তায়ালা আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। এসব কিতাবের শিক্ষা পরস্পরের পরিপূরক এবং এগুলোতে পরস্পরবিরোধী কোনো কথাবার্তা নেই।

২- আসমানি কিতাব হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার রহমতের নিদর্শন। তিনি মানুষকে ভালোবেসে তাদের মুক্তির উপায় বাতলে দিতে এসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন।

সূরা আহকাফের ১৩ ও ১৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ﴿۱۳﴾ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ﴿۱۴﴾

“নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ’ অতঃপর [এই বিশ্বাসে] অবিচলিত থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”(৪৬: ১৩)

“তারাই জান্নাতের অধিবাসী, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, তারা যা আমল করত তার পুরস্কার-স্বরূপ।”  (৪৬:১৪)

এই দুই আয়াতে প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিদের পরিচয় তুলে ধরে বলা হচ্ছে: একত্ববাদে বিশ্বাসীরা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ এবং তারা এই পথে অটল ও অবিচল থাকে। স্বাভাবিকভাবেই শুধু মনে মনে বিশ্বাস কিংবা মুখে কালিমা উচ্চারণই আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং বাস্তবে মহান আল্লাহ আমাদের কাছে যা কিছু চেয়েছেন তা করতে হবে এবং এই সৎকর্মে অটল থাকতে হবে। আল্লাহর বিধিনিষেধগুলিও মেনে চলতে হবে। আমাদের মনের মতো হলে আল্লাহর বিধান মানব আর না হলে মানব না- এমন ঈমানের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যখন অশ্লীলতা ও অপকর্ম করার সব সুযোগ সহজপ্রাপ্য তখন অবিচল চিত্ত ছাড়া আল্লাহর প্রতি ঈমান ধরে রাখা সম্ভব নয়।

অবশ্য মহান আল্লাহও দুনিয়া ও আখিরাতে মুমিন বান্দাদেরকে পুরস্কার দেন এবং পার্থিব জীবনেই তাদেরকে নিশ্চিন্ত ও নির্বিঘ্ন জীবন দান করেন। এ ধরনের মানুষের যেমন ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে উদ্বেগ নেই তেমনি অতীতের কোনো ঘটনা নিয়েও তারা অনুতপ্ত নন।  পাশাপাশি তাদের জন্য পরকালে রয়েছে চিরকালীন সুখের আবাস জান্নাত। সেখানে তারা আল্লাহর দেয়া অবারিত নেয়ামতসমূহ ভোগ করবেন।  

পক্ষান্তরে পৃথিবীতে অসংখ্য ধনাঢ্য ও ক্ষমতাধর মানুষ রয়েছে যারা শারিরীকভাবে সুস্থ থাকলেও প্রচণ্ড মানসিক অশান্তিতে ভোগে। তাদেরকে একটুখানি ঘুমানোর জন্য নানা ধরনের ওষুধ ও বেদনানাশক এমনকি মাদকদ্রব্য ব্যবহার করতে বাধ্য হয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- শুধুমাত্র মুখে ঈমান আনা যথেষ্ট নয় বরং সঙ্গে সৎকাজ লাগবে এবং ঈমানের পথে অটল থাকতে হবে।

২- আল্লাহর প্রতি যার ঈমান আছে সে অন্য কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা শক্তিকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না।

৩- যারা গুনাহের কাজ করে তারাই অতীতের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। কিন্তু যারা সারাক্ষণ ঈমানের পথে অবিচল থাকেন তাদেরকে অতীত নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা করতে হয় না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ