অক্টোবর ০৫, ২০২১ ০১:৫৩ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি, জাতীয় সরকার গঠন এসব বিষয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলেছেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

তিনি বলেন, দেশে বর্তমানে চলছে এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই শতাংশের দ্বন্দ্ব। কিন্তু সেটি এক শতাংশের অভ্যন্তরীণ ভাগ-বাটোয়ারার কারণে মৌলিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসছে না। অন্য কোনো ভিশন নয়; কেবল মাত্র মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ এ ফিরে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

আমাদের দেশ থেকে এখন রাজনীতি প্রায় নির্বাসিত করে রেখেছে ক্ষমতাসীনরা বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট এই রাজনীতিবিদ।

তিনি আরও বলেছেন, যদি ফেরেশতাদের দিয়েও নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় তারপরও বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। কেননা গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাটা এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে সেখানে কোনোভাবেই জনমতের প্রতিফলন নিশ্চিত করা তো দূরের কথা নির্বাচনের প্রতিচ্ছবিও যে দেখা যাবে তারও কোনো সুযোগ নেই।

বিদগ্ধ এই রাজনীতিবিদ বলেন,বর্তমান কাঠামোর মধ্যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আমাদের পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে পুরো ঢেলে সাজাতে হবে।

আমাদের ইতিহাস ঠিক এরকম- আমরা বীরের জাতি এবং আমরা বিজয় লাভ করি কিন্তু আমরা দুর্ভাগা জাতি কারণ বিজয় লাভ করেও আমরা সেই বিজয় ধরে রাখতে পারিনা। এরশাদের পতনের পর আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা গণতন্ত্র কায়েম করতে পারব কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা খুবই করুণ অবস্থার ভেতরে আছি। আমাদের অবস্থা সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা!ফলে শুধুমাত্র কিভাবে নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ হবে মাত্র এই একটা ইস্যুর মধ্যে দিয়ে নির্বাচন নয়; সামগ্রিকভাবে একটি সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবা প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনার না গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ঢেলে সাজাতে হবে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন,ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৩০ এসব দিয়ে কিছুই হবে না। আমাদের ভিশন মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ এর ভিত্তিতে দেশকে আবার সঠিক ট্রাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তার ভিত্তিতেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, তৈরি ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, গতপর্বের আলোচনার শেষে আপনি বলেছিলেন দেশ থেকে রাজনীতি প্রায় নির্বাসিত করে রেখেছে দেশের ক্ষমতাসীনরা। কথা বলেছিলেন নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন নিয়ে। আরও বলেছিলেন দেশের নির্বাচন তামাশায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনের কথাও বলেছিলেন আপনি। তো আজ আপনার কাছে শুরুতে জানতে চাইব,হঠাৎ করে দেশে জাতীয় সরকার গঠনের কথা উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। ডাক্তার জাফরুল্লাহ জাতীয় সরকার' গঠনের কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। তো জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়ে আপনি কি বলবেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনি খুবই চমৎকার একটি প্রশ্ন করেছেন। এখন জাতীয় সরকারের প্রশ্ন অনেকেই তুলছেন। আর প্রশ্নটা এভাবেই করছে যে লুটপাটটা  কেবলমাত্র একদলীয়ভাবে হবে কেন? আমরা লুটপাটটা ভাগবাটোয়ারা করে খাই। সত্যঘটনা বলি, যখন ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের মধ্যে মারামারি হয় এবং পরে ফয়সালা হয়ে যায় সেরাটনে বসে পান করতে করতে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় এরকম- ঠিকআছে কাল থেকে আর গোলাগুলি হবে না। সিক্সটি ফোরটি ভাগাভাগি হবে। আমি মনে করে জাতীয় সমস্ত শক্তি সবকিছুকে মোবিলাইজ করা উচিত। যদি আমরা উদ্ধার পেতে চাই। কিন্তু সেই শক্তিকে একত্রিত করে একটি জায়গায় নিয়ে আসার জন্য একটা মূলভিত্তি থাকতে হবে। ইতিহাসের খাতা থেকে বলতে পারি বাঙালী জাতি সর্বশ্রেষ্ট ঐক্যে পৌঁছেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তি যুদ্ধের ভেতর দিয়ে। সেই সুদৃঢ় ঐক্য এর পর আর কোনো সময় হয়নি। আমি একজন ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলতে পারি প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তি যদি সৎ হয় এবং আন্তরিকভাবে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চায় তাহলে বলতে ফিরে আস ভিশন মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ এ। ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৩০ এসব দিয়ে কিছুই হবে না। আমাদের ভিশন মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ এর ভিত্তিতে দেশকে আবার সঠিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তার ভিত্তিতেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

রেডিও তেহরান: জনাব সেলিম, আপনি বললেন দেশের সমস্ত শক্তিকে একটি দর্শনের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে সেটি হচ্ছে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের দর্শন। তো বর্তমান যে সরকার ক্ষমতায় অর্থাৎ আওয়ামী লীগ তারা তো ১৯৭১ সালের মুল শক্তি। তারা কি জাতীয় সরকারের এই ধারণা মেনে নেবে বলে আপনার মনে হয়?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দেখুন, আমি মনে করি একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকবে কি থাকবে না! কেবল মুখে বললে তো হবে না!সমাজতন্ত্র মানতে হবে। মুক্তবাজার নীতি এবং সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরতা পরিত্যাগ করতে হবে। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের দেশে কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না তা হবে না- এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই আমরা লড়াই করেছি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং দেশ স্বাধীন করেছি। সেই নীতিতে আমাদের ফিরে আসতে হবে। রাজনৈতিক ভাবনা যার যার রাষ্ট্র সবার, নাগরিক হিসেবে সকলের সমান অধিকার ও মর্যাদা থাকবে। দেশকে প্রকৃতঅর্থে নিজের পায়ের উপর দাঁড় করাতে হবে।

রেডিও তেহরান: জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আপনি বলছিলেন জাতীয় ঐক্যের জায়গায় আসতে হবে ৭১ এর চেতনাকে ধারণ করে। আর সেই জায়গায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আসবে কি না সেটি একটি বড় প্রশ্ন? তো সে প্রসঙ্গ ধরেই সবশেষে জানাতে চাইব এ ব্যাপারে সবার এক হওয়ার সম্ভাবনার জায়গাটা কতটুকু আপনি দেখছেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: দেখুন ঐক্যের দুরকম ইন্টারপ্রিটেশন থাকতে পারে। একটা হলো আওয়ামী লীগ আর বিএনপির ভেতর যে বিরোধ তারা নিষ্পত্তি করতে পারে লুটপাটের ভাগবাটোরায়ার মাধ্যমে যেকোনো একটা রেশিওতে বা যেকোনো ফমূলাতে। তবে লুটপাটকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্যই চলতে থাকবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এখনও ধারণ করি। আমি মনে করি যতদিন আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বর্তমান সাম্রাজ্যবাদ সমর্থিত উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিউ লিবারেল পলিসিতে বিশ্বাস করে দেশকে পরিচালনা করছে বা করতে চায়,এই নীতিতে বহাল থেকে তাদের সাথে কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্য কোনো সময় হতে পারে না। আর দ্বিতীয় ঐক্যটা হলো জনগণের স্বার্থ নিয়ে একবার যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তার যে ফসল তার ওপর ভিত্তি করে যদি আমরা যদি আবার একত্রিত হতে পারি।

তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে দুটো সমাজ হয়ে গেছে। একদিকে নিরানব্বই শতাংশ শোষিত নির্যাতিত সাধারণ মেহনতি ও মধ্যবিত্ত মানুষ অন্যদিকে এক শতাংশ লুটেরা শ্রেণি। আজকে বাংলাদেশে এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই শতাংশ এই দ্বন্দ্বই হচ্ছে প্রধান দ্বন্দ্ব। আবার এই দ্বন্দ্বকে আড়াল করার জন্য আবার দেখি এক শতাংশের অভ্যন্তরে লুটপাটের ভাগবাটোরায়া নিয়ে আবার দ্বন্দ্ব। যে কারণে এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই শতাংশের যে মৌলিক দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দ্বটা প্রকাশিত হচ্ছে না। তবে মানুষের ভেতরে সেই উপলব্ধি আছে। সরকার পরিবর্তন তো বটেই একইসাথে শাসক শ্রেণি এবং শাসন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসতে হবে।

জ্বি, আপনি বললেন সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষে নির্বাচনের জন্য গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর নির্ভরতা বন্ধ করতে হবে। এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই শতাংশের দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্যে এনে সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসতে। লুটপাটের ও ভাগবাটোয়ার ধারা থেকে বেরিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তো জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৪