অক্টোবর ৩১, ২০২১ ১৬:৩৫ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদের নাম শুনেছো। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ তাকে ন্যায়পরায়ন রাজা হিসেবে তুলে ধরলেও তিনি ছিলেন একজন জালিম শাসক। তার শাসনামলে নবীবংশের মহান ইমামদের ওপর জুলুম-নির্যাতন এবং আলেম ও প্রতিবাদীদের কারাগারে নিক্ষেপ ও হত্যার বহু ঘটনা ঘটেছে।

খলিফা হারুনুর রশিদের কথা উঠলেই তার আমলের বিখ্যাত আলেম ওয়াহাব ইবনে আমর্‌-এর কথা চলে আসে। খলিফা হারুন ওই আলেমকে বাগদাদের প্রধান বিচারপতি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি একজন জালিম শাসককে সহযোগিতা করতে চাননি বলে বাকী জীবন ‘পাগল' হবার ভান করে কাটিয়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি ‘বাহলুল পাগল' নামেই পরিচিতি পান।

বন্ধুরা, আজকের আসরে খলিফা হারুনুর রশিদ ও বাহলুলকে নিয়ে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব। আর সবশেষে থাকবে এক নতুন বন্ধুর গানসহ সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।

(প্রধান বিচারকের পদ প্রত্যাখ্যান)

আব্বাসীয় বংশের পঞ্চম খলিফা হারুনুর রশিদ একবার বাগদাদে একজন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে চাইলেন। কাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায় এ নিয়ে তিনি তার সভাসদদের সাথে পরামর্শ করতে বসলেন। সবাই বলল: ওয়াহাব ইবনে আমর্‌-এর চেয়ে এই পদের যোগ্য আর কেউ নেই। কারণ তিনি একজন নামকরা আলেম ও ফকীহ ব্যক্তি। সবার পরামর্শে খলিফা হারুন বাহলুলকে ডাকলেন। তাকে উদ্দেশ করে বললেন, "ফকীহ সাহেব! আপনাকে আমরা প্রধান বিচারপতি বানাতে চাই। এত বড় পদে বসতে নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি নেই।"

ওয়াহাব ইবনে আমর্‌ খলিফার এ প্রস্তাবে মোটেই রাজি ছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন, জালিম শাসকের অধীনে এ ধরনের কোনো দায়িত্ব খেয়ানত ও গোনাহ'র ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। তাছাড়া, কোনো জালিম শাসককে সহযোগিতা করার পক্ষপাতি তিনি ছিলেন না। তাই তিনি বললেন: "মাননীয় খলিফা, আমি আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ আমি নিজেকে এ কাজের যোগ্য মনে করি না।"

খলিফা বললেন: "কিন্তু বাগদাদের লোকেরাতো আপনাকেই এই কাজের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মনে করে। তাদের পরামর্শেই তো আমি আপনাকে ডেকেছি।"

বাহলুল বললেন: না, না তারা ঠিক বলেনি। আমার যোগ্যতার ব্যাপারে তারা আমার চেয়ে বেশী জানে না। এরপরও যদি আপনি মনে করেন যে, আমি মিথ্যা বলছি তাহলে আমাকে বিচারক বানানো ঠিক হবে না। কারণ কোনো মিথ্যাবাদী বিচারক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।

বাহলুলের সাহস ও যুক্তি দেখে খলিফা খানিকটা অবাক হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, বাহলুল ইচ্ছে করেই দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। খলিফা হারুন এবার ভয়ভীতি দেখানোর কৌশল নিলেন। রেগে গিয়ে বাহলুলকে বললেন, তুমি যত তাল-বাহানাই করো না কেন, আমার আদেশ তোমাকে মানতেই হবে। নইলে তোমাকে চরম শিক্ষা দেব।

অবস্থা বেগতিক দেখে বাহলুল বললেন: আমাকে একদিন সময় দিন। আপনার প্রস্তাবটা নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করি। তারপর সিদ্ধান্ত জানাই।

ক) খলিফা বললেন: ঠিকাছে! তোমাকে একদিনের সময় দিলাম। তবে মনে রেখ- আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে মেনে নিতেই হবে।

এরপর বাহলুল বাদশাহ হারুনের দরবার থেকে বের হয়ে এলেন। বাসায় এসে চিন্তা-ভাবনার পর তিনি অদ্ভুত এক কৌশল গ্রহণ করলেন। কৌশল অনুযায়ী পরদিন সকালে তিনি পাগলের বেশ ধরে লম্বা একটা লাঠি নিয়ে বাজারে গেলেন। মানুষজন দেখল, বাহলুলের কাপড়-চোপড় ঠিক নেই। হাতের লাঠিতে সওয়ার হয়ে তিনি চিৎকার করে বলছেন- 'এই তোমরা আমরা সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। নইলে আমার এই ঘোড়া তোমাদেরকে লাথি মেরে ফেলে দিতে পারে। তখন কিন্তু আমার কোনো দোষ দিতে পারবে না।'

একজন বিজ্ঞ আলেম লাঠিকে ঘোড়া বানিয়ে অদ্ভুত আচরণ করছে দেখে মানুষজন অবাক হয়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল, বাহলুল পাগল হয়ে গেছে। তাদের একজন গিয়ে হারুনুর রশিদের কাছে এই খবর দিল।

খলিফা হারুন সব শুনে বললেন: তোমরা যা বলছ তা সত্য নয়। বাহলুল পাগল হয়নি বরং তিনি দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য আমাদের কাছ থেকে পালাচ্ছেন।

এ ঘটনার পর খলিফা হারুন বাহলুলকে আর বাগদাদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিলেন না। বাহলুলও দায়িত্ব এড়ানোর জন্য বাকী জীবন পাগলের বেশেই কাটিয়ে দেন।

(খলিফার মসনদে বাহলুল)

বাহলুল একদিন হারুনুর রশীদের প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। খলিফা তখনো প্রাসাদের দরবারগৃহে আসেন নি, তাই সিংহাসন খালি পড়েছিল। বাহলুল সাথে সাথে নির্ভয়ে ও নির্দ্বিধায় খলিফার মসনদে উঠে বসলেন।

খলিফার দরবারের গোলামরা এ দৃশ্য দেখে হৈহৈ করে ছুটে এল এবং চাবুকের কয়েক ঘা লাগিয়ে টেনেহিঁচড়ে সিংহাসন থেকে তাকে নামিয়ে আনল। নীচে নামিয়ে আনার পর বাহলুল কাঁদতে লাগলেন। এ সময় খলিফা হারুনুর রশিদ দরবারে প্রবেশ করলেন এবং বাহলুলকে কাঁদতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। গোলামরা ঘটনা খুলে বলল।

 সবকিছু শুনে খলিফা গোলামদের তিরস্কার করলেন এবং বাহলুলকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। কিন্তু বাহলুল বললেনঃ “আমি আমার জন্যে কাঁদছি না, তোমার জন্য কাঁদছি।”

এ কথা শুনে খলিফা আঁতকে ওঠে বললেন, “মানে!”

বাহলুল বললেন: “আমি তো মাত্র কয়েক সেকেন্ড মসনদে বসেছিলাম, তাতেই কত অপমান ও নির্যাতন সহ্য করতে হল! আর তুমি যে সারা জীবন এ মসনদে বসছ, তোমাকে কি পরিমাণ অপমান ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে ভেবে দেখেছ কি? নিজের পরিণতির কথা ভেবে তোমার ভয় করে করে না?"

(হারুনের প্রতি উপদেশ)

একদিন খলিফা হারুনুর রশিদের মনের অবস্থা ভালো ছিল না। বাহলুল আসতেই তাঁকে বললেনঃ “বাহলুল! আমাকে কিছু উপদেশ দাও।”

বাহলুল বললেন: “হারুন! তুমি যদি কোনো মরু প্রান্তরে আটকা পড়ে যাও এবং সেখানে পিপাসায় মৃত্যুকে অনিবার্য মনে হয় অথচ সাথে পানি না থাকে, সে অবস্থায় কেউ তোমাকে এক আঁজলা পানি দিলে তুমি তার বিনিময়ে কি দিতে প্রস্তুত?

হারুন বললেন: “একশ' স্বর্ণমুদ্রা।”

বাহলুল বললেন : “পানির মালিক যদি এতে রাজী না হয়?

হারুন বললেন: “আমার খেলাফতের অর্ধেক এলাকা তাকে দিয়ে দেবো।”

বাহলুল বললেন : “এ পানি পান করার পর যদি তোমার প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় এবং কেউ তার চিকিৎসা করে তোমাকে এ সঙ্কট থেকে মুক্তি দান করে তাকে কি প্রদান করবে?

হারুন বললেন: “আমার খেলাফতের বাকী অর্ধেক তাকে দিয়ে দেব।”

বাহলুল বললেন: “অতএব, এক আঁজলা পানি পান ও একবার প্রস্রাব করার চেয়ে যার মূল্য বেশী নয় সেই খেলাফতের কারণে কি অহঙ্কারী হওয়া উচিত? বরং এটাই কি উচিত নয় যে, আল্লাহর বান্দাহদের কল্যাণ সাধন করবে?"

(বাহলুলের শাস্তি)

খলিফা হারুন একবার বাহলুলের পিছনে গোয়েন্দা লাগালেন। বাহলুলের মাযহাবী চিন্তাধারা ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে বললেন। কয়েকদিন পর গোয়েন্দা এসে রিপোর্ট দিল: বাহলুল মহানবীর আহলে বাইতের প্রতি অত্যন্ত মহব্বত পোষণ করেন এবং তিনি আহলে বাইতের ইমাম মূসা কাযেমের একজন একনিষ্ঠ বন্ধু ও অনুসারী।

একথা শুনে হারুনুর রশিদ বাহলুলকে ডেকে আনালেন। বাহলুলকে তিনি বললেন: “শুনতে পেলাম, তুমি মূসা ইবনে জাফরের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের একজন। তুমি নাকি তার পক্ষে আর আমার বিরুদ্ধে প্রচার চালাও, আর আমার হাতে শাস্তিভোগ থেকে বাঁচার জন্যে পাগল সেজেছ।”

বাহলুল বললেন : “তা-ই যদি হয়, তো আমাকে কি করবে?”

এ কথায় হারুনুর রশিদ ক্রোধে আগুন হয়ে গেলেন। জল্লাদ মাসরুরকে হুকুম দিলেন- “বাহলুলের পোশাক খুলে ফেল, তার বদলে মালবাহী গাধার পিঠের গদী ওকে পরিয়ে দাও, আর ওর মুখে গাধার লাগাম লাগাও। তারপর ওকে সবগুলো প্রাসাদে ও গোসলখানাগুলোতে ঘুরিয়ে আন; সবশেষে আমার সামনে এনে শিরচ্ছেদ কর।”

মাসরুর হারুনের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। এরপর বাহলুলকে হারুনের সামনে নিয়ে এল এবং শিরচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত হল। ঘটনাক্রমে এ সময় হারুনের মন্ত্রী জাফর বারমাকী এসে উপস্থিত। বাহলুলকে এ অবস্থায় দেখে জাফর প্রশ্ন করলেন: “বাহলুল! কি অন্যায় করেছ?"

বাহলুল বললেন: “কোনো অন্যায়ই করি নি, যেহেতু সত্যকথা বলেছি, তার পুরস্কারস্বরূপ খলিফা তার গর্বের পোশাক আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন।”

বাহলুলের এ কথায় হারুন, জাফর এবং উপস্থিত পারিষদবর্গ হাসি সামলাতে পারলেন না এবং অনেকক্ষণ হাসলেন। রাগ পড়ে যাওয়ায় হারুন বাহলুলের গা থেকে গাধার পিঠের গদি ও তাঁর মুখ থেকে লাগাম খুলে ফেলতে এবং তার জন্যে জমকালো পোশাক আনার জন্যে মাসরুরকে নির্দেশ দিলেন। মাসরুর আদেশ পালন করল। কিন্তু বাহলুল খলিফার দেয়া পোশাক স্পর্শ করলেন না, বরং নিজের মোটা জুব্বা পরিধান করে হনহন করে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বন্ধুরা, আসরের এ পর্যায়ে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো বাংলাদেশের এক নতুন বন্ধুকে।

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো পরের সপ্তাহে।#