নভেম্বর ০৬, ২০২১ ১৯:০৯ Asia/Dhaka

ইউরোপীয়রা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে সব কিছুই করেছে। এরপরও সব কিছু চাপা থাকছে না।

সময়ের পরিক্রমায় কখনো কখনো মাটির নিচের দেহাবশেষও অকাট্য প্রমাণ হয়ে সামনে আসছে এবং গোটা বিশ্বকে ইউরোপীয়দের অতীত অপকর্ম সম্পর্কে সতর্ক করছে। সম্প্রতি কানাডায় যেসব আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া গেছে সেগুলো যেন উচ্চস্বরে বলছে, হে বিশ্ববাসী তোমরা আজ যাদের অনুসরণীয়-অনুকরণীয় ভাবছ তাদের ফিটফাট চেহারার আড়ালে রয়েছে এক কুৎসিত ইতিহাস, এদের পূর্বপুরুষেরা ভূমি ও সম্পদ দখলে নিতে অবলীলায় গণহত্যা করেছে।  নিষ্পাপ শিশুদের গণভাবে মাটিতে পুতে ফেলেছে। এসব খুনি ও দখলবাজের উত্তর প্রজন্মের ভেতরে পরিবর্তন এসেছে বলে কোনো প্রমাণ নেই। এই দখলবাজদের উত্তর প্রজন্মই প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরাইল। বিশ্বের গণমাধ্যমের দিকে তাকালেই  ইসরাইলি দখলবাজির প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিনিয়ত।

কানাডায় চলতি ২০২১ সালে এক হাজার একশ’ বেশি আদিবাসী শিশুর কবর পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে এ ধরণের আরও বহু গণকবর রয়েছে। কানাডায় প্রথম আদিবাসী শিশুদের গণকবরের সন্ধান মেলে চলতি বছর ২৯ মে। দেশটির ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যের কামলুপস এলাকার একটি পরিত্যাক্ত আবাসিক স্কুল থেকে ২১৫ জন আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার হয় ওই দিন। দেহাবশেষগুলোর মধ্যে ৩ বছর বয়সী শিশুর দেহাবশেষও ছিল। এরপর দেশটির সাসকাচুয়ান,অ্যালবার্টা ও মানিতোবা রাজ্যেও আদিবাসী শিশুদের গণকবরের সন্ধান মেলে। কয়েকশ’ বছর আগে ইউরোপীয়রা কানাডায় ঢুকেই আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা চালায়। এরপর বাকি যারা বেঁচে ছিলেন,তাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদান ও নিজেদের মতো করে গড়ে ক্যাথলিক গির্জার অধীনে কানাডাজুড়ে বিভিন্ন আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়। কয়েক লাখ আদিবাসী শিশুকে জোরপূর্বক তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভর্তি করা হয়েছিল এসব স্কুলে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা ও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চর্চা নিষিদ্ধ ছিল এই শিশুদের জন্য। তাদের সঙ্গে আচরণ করা হতো ক্রীতদাসের মতো এবং স্কুল শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের হাতে নিয়মিত শারীরিক,মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। অসহনীয় নির্যাতনের ফলে বহু শিশুর মৃত্যু হতো। পালানোর চেষ্টা করার কারণে অনেক শিশুকে হত্যা করা হতো। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শিশুদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। তখন তাদেরকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এসব সমাধিই এখন গণকবর। শিশুদের হত্যার পর তাদের মৃতদেহগুলো হস্তান্তরেরও প্রয়োজন মনে করতো না এসব ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারী। অভিযোগ রয়েছে রেড ইন্ডিয়ান ভাষা ব্যবহার করার অপরাধে জিহ্বায় সুচ ফোটানর মত জঘন্য নির্যাতনেরও। চালানো হতো যৌন নির্যাতন।

১৯২০ এর দশকে এসব স্কুলে শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন জর্জ ম্যানুয়েল। তিনি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এসব স্কুলের আদিবাসী শিশুরা সব সময় ক্ষুধার্ত থাকত। তাদেরকে পেট পুরে খেতে দেওয়া হতো না। শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সহ্য করতে হতো। গরম রাখার কোনো ব্যবস্থা করা হতো না। স্কুলের পরিবেশও অস্বাস্থ্যকর। হাম,ইনফ্লুয়েঞ্জা,যক্ষ্মা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়তো স্কুলগুলোতে।

আমেরিকা ও কানাডায় আদিবাসীরা রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচিত। পঞ্চদশ শতকে স্পেনীয় দখলবাজ ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন,তখন তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’ হিসেবে। গায়ের রঙে লালচে ভাব থাকায় সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জাতি নামেই চিনে আসছে বিশ্ববাসী।

আমেরিকার কথিত আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস নিজেও তার সঙ্গীদের নিয়ে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়েছে। ১৪৯২ সালের কথা। একদল অস্ত্রধারীকে সঙ্গে নিয়ে তিনটি জাহাজে করে ১২ অক্টোবর আমেরিকার বাহামাস দ্বীপে পৌঁছান ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সরলমনা স্থানীয় আদিবাসীরা তাদেরকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানান। কলম্বাসের একটি ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামতও করে দেন তারা। অভ্যর্থনা জানাতে আসা আদিবাসীদের দেহে স্বর্ণের অলঙ্কার দেখে কলম্বাস অনুমান করেন আশেপাশের কোথাও স্বর্ণের খনি রয়েছে। আদিবাসীদের সরলতা কলম্বাসকে মুগ্ধ করে এ জন্য যে, তিনি খুবই কম পরিশ্রমে ওই ভূখণ্ডের সব কিছু নিজের দখলে নিতে পারবেন। তিনি আমেরিকার মূল মালিক আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন এবং স্পেনে গিয়ে আরও এক হাজার দুইশ’ ইউরোপীয়কে সঙ্গে নিয়ে আসেন। শুরু হয় নির্মমতা, চলে গণহত্যা। কলম্বাস বাহিনী হিস্পানিওলা দ্বীপের একটি প্রদেশে ১৪ বছরের উপরের সব আদিবাসীকে তিন মাস পরপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশ মানতে যারাই ব্যর্থ হতো তাদেরই দুই হাত কেটে ফেলা হতো। হাত কাটার পর তারা রক্তপাতে মারা যেত। অনেকে বাঁচার জন্য পালানোর চেষ্টা করতো। তাদেরকে হিংস্র কুকুর দিয়ে খুঁজে বের করে নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হতো। অনেক আদিবাসীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।

হিস্পানিওলা দ্বীপে বসবাসকারীরা ছিল আরাওয়াক গোত্রের। ঐতিহাসিক সনদগুলো বলছে,কলম্বাসের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় বাহিনীর নির্মমতা সইতে না পেরে ৫০ হাজার আদিবাসী বিষ খেয়ে গণ-আত্মহত্যা করেছিলেন। মায়েরা তাদের ছোট ছোট বাচ্চাদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতেন যাতে ইউরোপীয়রা ওই বাচ্চাদেরকে কুকুরের খাবারে পরিণত করতে না পারে। এরপরও যারা বেঁচে ছিলেন তাদেরকে দাসে পরিণত করেন কলম্বাস। নিজের মতো করে সব কিছু গড়ে তুলতে আদিবাসীদের রাত-দিন পরিশ্রমে বাধ্য করেন। কলম্বাসের এই নিষ্ঠুরতার কারণেও মারা যায় হাজার হাজার আদিবাসী। আরাওয়াক গোত্র সংক্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, ১৫১৫ সালেও আরাওয়াক গোত্রের ৫০ হাজার সদস্য বেঁচে ছিল। কিন্তু ১৫৫০ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫০০ জনে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৫০ সালে দ্বীপটিতে আরাওয়াক গোষ্ঠীর আর কেউ বেঁচে ছিল না। এর বহু আগেই কলম্বাস মারা যান, কিন্তু সেখানে দখলদার ইউরোপীয়দের গণহত্যা থেমে থাকেনি। কলম্বাসের উত্তরসূরিরা একই কায়দায় আদিবাসী নিধন অব্যাহত রাখে।

কলম্বাসের সময়ের কিছু নির্মমতার ইতিহাস উঠে এসেছে তার নিজস্ব জার্নাল ও চিঠিতে। আরও তথ্য পাওয়া যায় স্পেনের ঐতিহাসিক বার্তোলমে দা লাস কাসাস এর লেখা ‘হিস্টোরি অব দ্য ইন্ডিজ’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন,কলম্বাস বাহিনী তাদের ছুরি ও তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করার জন্যও আদিবাসীদের টুকরো টুকরো করে কাটতো, নিষ্পাপ শিশুদের শিরশ্ছেদ করতো। কলম্বাস যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলে নামকরণ করেছিলেন সেই আদিবাসীদের একটা বড় অংশকে নিশ্চিহ্ন করার পর ইউরোপীয়রা নিজেদের বিলাসী জীবন নিশ্চিত করতে একদল সেবকের প্রয়োজন বোধ করে। তারা আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে মানুষ ধরে আনতে শুরু করে। এভাবেই আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আগমন।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীদের সঙ্গেও একই ধরণের আচরণ করা হয়েছে। সেখানকার অধিবাসীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এসব দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এখনও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে।

কানাডার আবাসিক স্কুলে আদিবাসী শিশুদের গণকবরের সন্ধান মেলার পর ইউরোপীয়দের দখলবাজি, দস্যুতা ও নৃশংসতার ঘৃণ্য ইতিহাস আবারও বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে। দুই বিশ্বযুদ্ধেও ইউরোপীয়দের উন্মত্ত আচরণ বিশ্ববাসী দেখেছে। এসব ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। কিন্তু এই ইতিহাস চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে অবিরত। ইউরোপীয় দখলবাজদের চাপা পড়া ইতিহাস পুরোপুরি প্রকাশিত হলে এবং সবাই তা জানতে পারলে পাশ্চাত্যের প্রতি বিশ্ববাসীর ঘৃণা আরও বাড়বে।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ