আসমাউল হুসনা (পর্ব-৪৭)
মহান আল্লাহর নাম আর গুণগুলো যত বেশি চেনা ও জানা সম্ভব হবে ততই তাঁর প্রতি ভালবাসাও বাড়তে থাকবে।
দয়াময় আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হ'ল ওয়াদুদ। ওয়াদুদ শব্দটি এসেছে উদ শব্দটি থেকে। এর অর্থ কারো প্রতি একনিষ্ঠ ও গভীর ভালোবাসা এবং তাঁর কল্যাণকামী হওয়া । মহান আল্লাহ ওয়াদুদ বলে তিনি তাঁর অনুসারীদের হৃদয়ের একান্তই প্রিয় এবং তিনিও তাঁর যোগ্য বান্দা বা দাসদের গভীরভাবে ভালোবাসেন ও তাঁদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।
ওয়াদুদ নামটি আরবি ব্যাকরণের পরিভাষায় সিফাতে মুশাব্বাহ জাতীয় শব্দগুলোর অন্যতম। এ ধরনের শব্দ দিয়ে কোনো গুণের দৃঢ়তা বা স্থায়িত্বকে জোর দিয়ে তুলে ধরা হয়। মুমিন বা বিশ্বাসীদের প্রতি মহান আল্লাহর ভালবাসা তাঁর স্থায়ী বা সত্ত্বাবাচক গুণের অংশ। এ ধরনের শব্দ আরবি ব্যাকরণের পরিভাষায় মাফউল বা কর্মপদ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আর সে অনুযায়ী ওয়াদুদ শব্দের অর্থ হবে প্রেমাস্পদ, প্রীতিভাজন বা সুহৃদ ও অত্যন্ত স্নেহশীল ইত্যাদি।
সুরা হুদের ৯০ নম্বর আয়াতে অত্যন্ত স্নেহশীল অর্থে ওয়াদুদ শব্দ ব্যবহার করে মহান আল্লাহ বলেছেন: আর তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁরই পানে ফিরে এসো নিশ্চয়ই আমার পরওয়ারদেগার তওবাকারীদের প্রতি খুবই মেহেরবান অতি স্নেহশীল। -এখানে নিজের নাম রাহিমের পরে ওয়াদুদ নাম এনে মহান আল্লাহ বোঝাতে চান যে তওবাকারীরা যে কেবল মহান আল্লাহর গভীর দয়ার পাত্র তা নয় তাদের প্রতি মহান আল্লাহর অনেক অনুরাগও রয়েছে। তওবাকারীদের জন্য রয়েছে মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও ভালবাসা।
সুরা বুরুজের ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ নিজের গ্বাফুর নামের পর ওয়াদুদ নাম এনে বলেছেন, তিনি ক্ষমাশীল ও তওবাকারীদের গভীরভাবে ভালবাসেন। - আর এ কারণেই বলা হয় মহান আল্লাহ তাঁর নবী-রাসুল, ফেরেশতাকুল ও মুমিন বান্দাদের ভালবাসেন এবং তাঁরাও আল্লাহকে ভালবাসেন। কেবল আল্লাহর প্রতিই তাঁদের ভালবাসা সবচেয়ে বেশি। মহান আল্লাহর অপার দয়া, ভালবাসা ও অনুগ্রহের কারণেই তিনি ওয়াদুদ এবং এ কারণেই তাঁকে মুমিনরাও ভালবাসেন।
মহান আল্লাহ সব ধরনের কল্যাণ ও সৌভাগ্যের উৎস। আল্লাহ তাঁর দাসদের ভালোবাসেন বলেই তাদের অন্তরেও আল্লাহর প্রতি ভালবাসা তিনিই যুগিয়ে দেন। আর আল্লাহর প্রতি ভালবাসার পুরস্কার হিসেবে তিনি তাঁর প্রতি দাসদের ভালবাসা বাড়িয়ে দিতেই থাকেন। জীবনের নানা দিকে ও ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি তাঁদের ভালবাসা বাড়তেই থাকে। এমনকি তাঁরা এক পর্যায়ে আল্লাহর প্রেমে এমনই মাতোয়ারা হন যে তারা আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই চান না ও আল্লাহ ছাড়া আর কাউকেই ডাকেন না। আর এই ভালোবাসার প্রভাব তাদের কাজে-কর্মে ও আচার-আচরণেও ফুটে উঠে।
মানুষের অন্তরে যদি খোদাপ্রেমের বীজ বোনা হয় তাহলে তিনি তার সর্বশক্তি দিয়ে তার কাজগুলোকে নিষ্ঠাপূর্ণ ও নিয়ত বা ইচ্ছাকেও পবিত্র করবেন। এমন ব্যক্তি যতই খোদাপ্রেমিক হতে থাকেন ততই আনন্দ অনুভব করতে থাকেন। তিনি তখন খোদাপ্রেমের আরও গভীরে যেতে তৎপরতা বাড়িয়ে দেন। তখন তিনি নিজ দায়িত্ব পালনের বাইরেও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নানা ধরনের কাজ করেন। যেমন, সুরা আলে ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, হে নবী আপনি লোকদের বলে দিন যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তাহলে আমার অনুসরণ কর যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসেন। -
আর আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তার প্রতি জনগণের হৃদয়েও ভালোবাসা সৃষ্টি করেন। সুরা মারিয়ামের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে তিনি হৃদয়গুলোতে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করেন।–
ইমাম জাফর আস সাদিক্ব আ. বলেছেন, মুমিনের হৃদয় যদি আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট থাকে তাহলে আল্লাহও মুমিনদের হৃদয়ে তার প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। আল্লাহর প্রেমিক হওয়ার পাশাপাশি আল্লাহ ও জনগণের ভালবাসা পাওয়ার চেয়ে বড় নেয়ামত আর কি আছে?
ওয়াদুদ নামের মূল তথা ওয়াদ্দা বা মাওয়াদ্দাত শব্দ পবিত্র কুরআনে মোট ছয় বার এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে এমন এক ভালবাসা যার প্রভাব বা ফল কাজে প্রকাশ পায়।
ভালবাসা প্রমাণ করতে হলে তার প্রকাশ দেখাতে হয়। তবে বিষয়টি মানুষের অন্তরের অনুভূতির ব্যাপার যা জোর করে অর্জন করা যায় না। বেশিরভাগ মানুষ অনেকের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করলেও তা প্রকাশ করে না। মহানবী (সা) বলেছেন, মুমিনের অন্তরে প্রকৃতিগতভাবেই আমার সন্তান হুসাইন বিন আলীর প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টি সহজাত। অন্য কথায় মুমিনের অন্তর কখনও ইমাম হুসাইনের প্রতি ভালবাসা থেকে শূন্য নয়। কোনো কিছুই তাদের এই ভালবাসাকে কেড়ে নিতে পারে না। বিষয়টি প্রকাশ পাক বা গোপন থাকুক এই ভালোবাসা চিরস্থায়ী। তাই তো বলা যায় হযরত আদম (আ) থেকে এ পর্যন্ত যত মানুষ ইমাম হুসাইনের জন্য অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে তা জমা করলে একটি সাগরের রূপ নেবে। তবে ওয়াদ্দা এমন এক ভালবাসা যা মানুষ প্রকাশ না করে পারে না। বিনয়ও দুই প্রকার। শারীরিক বিনয় ও মানসিক বা আত্মিক বিনয়। আল্লাহর প্রতি যারা মানসিকভাবে বিনয়ী তারা খোদাপ্রেমের কারণে নিজ প্রবৃত্তি ও খেয়ালীপনাকে বর্জন করে।
মহান আল্লাহ তার প্রতি ভালবাসার পাশাপাশি মহানবী সা. ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতিও ভালবাসার নির্দেশ দিয়েছে সুরা শূরার ২৩ নম্বর আয়াতে। আয়াতে মাওয়াদ্দাত নামে পরিচিত এই আয়াতে মাওয়াদ্দাত শব্দ ব্যবহার করে মহান আল্লাহ বলেছেন: হে নবী! আপনি মুসলমানদের বলুন: আমি রেসালাতের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের প্রতি আন্তরিক ও বাস্তব কর্মগত ভালবাসা ছাড়া অন্য কোনো বিনিময় বা পুরস্কার চাই না। যে কেউ উত্তম কাজ করে তথা এই ভালবাসা বাড়ায়, আমি তার জন্যে তা বাড়িয়ে দেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকারী, গুণগ্রাহী।– কাশাফ জামাখশারির তাফসির পবিত্র কুরআনের প্রাচীনতম তাফসির গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এই আয়াতের তাফসির সম্পর্কে ওই গ্রন্থে এসেছে: যখন মহানবীর (সা) কাছে এই আয়াত নাজিল হল তখন প্রশ্ন করা হয়: হে আল্লাহর রাসুল (সা)! আপনার এই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা কারা যাদের প্রতি ভালবাসা আমাদের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে? রাসুলে খোদা (সা) বললেন: এরা হচ্ছে আলী ইবনে আবি তালিব, ফাতিমা জাহরা এবং তাঁদের দুই সন্তান হাসান ও হুসাইন আলাইহিমুসসালাম। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।