আসমাউল হুসনা (পর্ব-৪৯)
দয়াময় আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হ'ল বায়িস। মৃতদের জীবিত করা বা উত্থান ঘটানোর অর্থবোধক বায়্সা থেকে এসেছে এই শব্দ।
কারণ মহান আল্লাহ মানুষকে চিরস্থায়ীভাবে জীবন যাপনের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। আর পার্থিব জগতের মৃত্যুর পর পরলোকের চিরস্থায়ী জীবন ওই আগের জীবনেরই ধারাবাহিকতা।
মহান আল্লাহর বায়িস নাম পবিত্র কুরআনে সরাসরি একবারও আসেনি, কিন্তু বায়িসের সমশ্রেণীর শব্দ ৬৭ বার এসেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবিত করা ও পুনরুত্থান বা মৃত্যুর পর জীবিত করা অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে এই শব্দ। আবার মানুষকে অচেতনতার ঘুম থেকে জাগাতে তথা সত্যের পথ দেখানোর জন্য নবী-রাসুলদের পাঠানোকেও বোঝানো হয়েছে এই একই শব্দ ব্যবহার করে।
মহান আল্লাহ মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর মানুষকে শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য দান করে মৃত্যুর পর আবারও তাকে জীবন দান করেন। সুরা হজের ৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের পুনরুত্থান সম্পর্কে বলেছেন:
হে লোকসকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হও, তবে (ভেবে দেখ-) আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট ও অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট মাংসপিণ্ড থেকে, তোমাদের কাছে আমার ক্ষমতার পূর্ণতা ও পর্যায়ক্রমিক সৃষ্টি-কৌশল ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি; তারপর যাতে তোমরা যৌবনে পদার্পণ কর। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌছানো হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে পতিত দেখতে পাও, অতঃপর আমি যখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায় এবং সর্বপ্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে।
এরপর একই সুরার ষষ্ঠ ও সপ্তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
এগুলো এ কারণে যে, আল্লাহ সত্য এবং তিনি মৃতকে জীবিত করেন এবং তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। এবং এ কারণে যে, কেয়ামত অবশ্যম্ভাবী, এতে সন্দেহ নেই এবং এ কারণে যে, কবরে যারা আছে, আল্লাহ তাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন।
মানুষের কাছে নবী-রাসুল পাঠিয়ে ও মানুষদের প্রতি সৃষ্টির নানা নিদর্শন দেখিয়ে মহান আল্লাহ প্রমাণ করেছেন যে তাদের মৃত্যুর পরই জীবন শেষ হয়ে যাবে না, বরং পুনরুত্থান হবে তাদের এবং তারা চিরস্থায়ী জীবন পাবে। অন্য কথায় সৃষ্টি জগতকে মহান আল্লাহ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে অস্তিত্বের জগতে এনেছেন এবং মুমিনদের হৃদয়কে ইয়াক্বিন বা সুনিশ্চিত বিশ্বাসসহ জীবিত করবেন। মহান আল্লাহর বায়িস নামের প্রভাবে মুমিনের কাছে অস্তিত্ব জগতের নানা বাহ্যিক ও রহস্যময় দিক স্পষ্ট করেন। ফলে তারা মৃত্যুর পর পরকাল ও জীবনের রহস্যগুলোকে দেখতে পায়। পার্থিব ও চিরস্থায়ী পারলৌকিক জীবনের মধ্যবর্তী বা অন্তর্বর্তী জগতও তখন সে দেখতে পায়। মুমিনদের কবর হয়ে যায় বেহেশতের অন্যতম বাগান ও কাফিরদের কবর হয়ে যায় দোযখ আগুনের গর্ত।
একবার এক যুবক রাসূলের(সা.) দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি দেখলেন এ যুবকের পা দু’টি টলটলায়মান, চোখ দু’টি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার রংও স্বাভাবিক নেই। রাসূলুল্লাহ(সা.) জিজ্ঞেস করলেন, “ কিভাবে রাত কাটিয়েছ?” সে জবাব দিল, “ হে রাসূলুল্লাহ্(সা.)! এমনভাবে সকালে প্রবেশ করেছি যে, নিশ্চিত বিশ্বাস বা ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি। যা আপনি মুখে বলেছেন ও আমি কান দিয়ে শুনেছি তা এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাই।” রাসূল চাইলেন সে আরও কিছু বলুক। তিনি বললেন, “তোমার ইয়াকীনের আলামত কি?” সে বলল, আমার ইয়াকীনের আলামত হলো দিনগুলো আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে আর রাতগুলো আমাকে জাগিয়ে রাখে” অর্থাৎ দিনে রোযা আর রাত্রিতে ইবাদত আমার ইয়াকীনের আলামত। আমার ইয়াকীন আমাকে রাতে বিছানায় শুতে দেয় না, আর দিনগুলোতে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত রাখে। রাসূল বললেন, “ এটা যথেষ্ট নয়, আরো আলামত আছে কি?” সে বলল, “ হে রাসূলুল্লাহ! যদিও এখন এ পৃথিবীতে আছি কিন্তু ঐ দুনিয়াকে অর্থাৎ আখেরাতকে দেখতে পাই, সেখানকার শব্দ শুনতে পাই। বেহেশত থেকে বেহেশতবাসীদের কণ্ঠ আর জাহান্নাম থেকে দোযখবাসীদের চীৎকার শুনতে পাই। ইয়া রাসূলুল্লাহ্! যদি অনুমতি দেন, তবে আপনার সাহাবীদের একে একে পরিচয় বলে দিই, কে বেহেশতী, আর কে জাহান্নামী।” রাসূল বললেন, “নীরব হও। আর কোন কথা বল না।” রাসুল (সা) সাহাবিদের বললেন, এ যুবকের অন্তরকে আল্লাহ ঈমানের নুরে আলোকিত করেছেন। তিনি ওই যুবককে এই অবস্থার ওপর অবিচল থাকতে বললেন। যুবকটি বলল: হে রাসুল! আপনার সঙ্গে জিহাদে গিয়ে যেন শহীদ হই আল্লাহর কাছে আমার জন্য সে দোয়া করুন। মহানবী(সা.) তার জন্য দোয়া করেন। ওই যুবক কিছুকাল পরই শহীদ হন।
মানুষকে অচেতনতার ঘুম থেকে জাগাতে তথা সত্যের পথ দেখানোর জন্য নবী-রাসুলদের পাঠানোকেও বোঝানো হয়েছে বায়িস শব্দের মাধ্যমে। আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) নাহজুল বালাগ্বায় উল্লেখিত প্রথম খুতবায় নবী-রাসুল মনোনয়ন বা পাঠানো সম্পর্কে বলেছেন: আল্লাহ্ একের পর এক নবী পাঠালেন যেন তাঁরা পূর্ব-প্রতিশ্রুতি তথা এক আল্লাহর ইবাদত পরিপূর্ণ করার মানবীয় সহজাত সত্ত্বার অঙ্গীকার বা ফিতরাতগত অঙ্গীকার পালনের দিকে মানুষকে আহবান করেন এবং ভুলে যাওয়া নেয়ামতগুলো স্মরণ করিয়ে দেন; যেন তারা আল্লাহর বিধি-বিধান প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে প্রণোদিত করা তথা মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব পরিপূর্ণ করেন, ও তাদের কাছে প্রজ্ঞার গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করে দেন এবং আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনসমূহ যেমন-সমুচ্চ আকাশ,বিছানো পৃথিবী,তাদের বাঁচিয়ে রাখার জীবনোপকরণ,মৃত্যু,বার্ধক্য জরা ও ক্রমান্বয়ে আগত ঘটনা প্রবাহ-তাদেরকে দেখিয়ে দেন।– তাই এটা স্পষ্ট বায়িস নাম মানুষের ভেতরে চিন্তা-চেতনার সেনা পাঠায় যাতে তারা জ্ঞানে ও আমল আখলাকে তথা কাজে ও আচার-আচরণেও উন্নত হন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন।
বিশ্বাসীরা মনে করেন যে ধ্বংসশীল এই পার্থিব জীবনের পর মহান আল্লাহ তাদের দেহকে আবারও জীবিত করে তাতে সেই আগের আত্মাকে আবারও যুক্ত করে পুনরুত্থান ঘটাবেন। আর এ বিষয়টি মনে রাখলে তারা আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য প্রাণপণ সচেষ্ট থাকবেন। বায়িস নামের প্রভাবে মুমিনরা মানুষকে মৃত্যুর দিক থেকে জীবনের দিকে এবং অজ্ঞতা থেকে বুদ্ধিমত্তার দিকে পথ দেখান।
ইমাম বাক্বির আ.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল সুরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াত তথা কেউ যদি কারো জীবন রক্ষা করল সে যেন গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষা করল। এ আয়াতের অর্থ কি? উত্তরে তিনি বলেন, এর অর্থ পুড়ে মরা, ডুবে মরা, ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে মরা, বন্য প্রাণীর হাতে প্রাণ হারানো থেকে রক্ষা বা দারিদ্র ও অভাব থেকে মুক্ত করা এবং এসবের চেয়েও বড় দিকটি হল বিভ্রান্তি বা পথহারা অবস্থা থেকে মানুষকে উদ্ধার করে তাকে সৌভাগ্য বা মুক্তির দিকে পথ দেখানো।
অন্য কথায় সুপথ দেখানো মানে মানুষকে জীবিত করা। আরেফদের মতে মানুষের মধ্যে তারাই বায়িস যারা মানুষকে একত্ববাদের দিকে আকৃষ্ট করেন ও তাদেরকে কবিরা গোনাহ ও মন্দ স্বভাব থেকে মহতী কাজের দিকে আহ্বান জানান এবং তাদের হৃদয় থেকে কদর্যতার কুমন্ত্রণা দূর করেন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।