ইসলামের অনন্য নক্ষত্র ইমাম রেজা (আ.)
(last modified Tue, 30 May 2023 14:31:47 GMT )
মে ৩০, ২০২৩ ২০:৩১ Asia/Dhaka

১৪৮ হিজরির ১১ জিলকাদ ইসলামের ইতিহাসের এক মহা-খুশির দিন। এই দিনে  মদিনায় জন্ম নিয়েছিলেন মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য ইমাম রেজা (আ.)।

এই মহান ইমামের জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক মুবারকবাদ এবং এই ইমামসহ বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে অশেষ দরুদ আর সালাম। 

১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম মুসা কাজিম ইবনে জাফর আস সাদিক (আ.)'র শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত তথা মাসুম বংশধররা ছিলেন খোদায়ী নানা গুণ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ এবং মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। অসাধারণ নানা গুণ ও যোগ্যতার জন্য আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) রেজা বা সন্তুষ্ট, সাদিক বা সত্যবাদী, ফাজেল বা গুণধর, মু'মিনদের চোখের প্রশান্তি বা আলো এবং কাফির বা অবিশ্বাসীদের ক্ষোভের উৎস ইত্যাদি উপাধির অধিকারী হয়েছিলেন। তবে ইমাম রেজা (আ.)'র একটি বড় উপাধি হল 'আলেমে আ'লে মুহাম্মাদ' তথা মুহাম্মাদ (সা.)'র আহলে বাইতের জ্ঞানী। 

প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত 'শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত' নামক বইয়ের হাদিসে এসেছে, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও হয়েছে অনূদিত (মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে) (পৃ.১৪৩-১৪৪)। এ বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ফাতিমা মাসুমা ছিলেন ইমাম রেজা-আ.’র ছোট বোন।  মাসুমা বা নিষ্পাপ ছিল তাঁর উপাধি। মহানবী (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। ইমাম রেজা (আ.)'র  ইমামতির বিশ বছর ছিল আব্বাসীয় তিনজন শাসক যথাক্রমে বাদশাহ হারুন এবং তার দুই পুত্র আমিন ও মামুনের শাসনকাল। ইমাম রেজা (আ.) তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাজিম ( আ. )’র নীতি-আদর্শকে অব্যাহত গতি দান করেন। ফলে বাবার মত তিনিও অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের রোষের মুখে পড়েন। আব্বাসীয় রাজবংশের বাদশা হারূন ও মামুন প্রকাশ্যে ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখালেও বাস্তবে ইমামদের নির্মূলের সুযোগ খুঁজতেন। অব্বাসিয়রা ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির কথা বলে একদিকে আহলে বাইত ও নবীবংশ প্রেমিকদের আন্দোলনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং অন্যদিকে শিয়া মুসলমানদের মন জয়ের চেষ্টা করত। 

ইমাম রেজা (আ.) শাসকদের ওই কপট রাজনীতি বানচালের উদ্যোগ নেন। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত উত্তরাধিকার কেবল নবী পরিবারের নিষ্পাপ ইমামগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং তাঁরা ছাড়া কেউ ঐ পদের যোগ্য নয়- জনগণের মাঝে এই সত্য প্রচারিত হলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাদশা’র বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবে-এ আশঙ্কায় ধূর্ত মামুন ইমাম রেজাকে (আ) সবসময়ই জনগণের কাছ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। প্রায় সকল ইমামকেই এভাবে গণ-বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যে উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসকরা তাঁদেরকে গৃহবন্দী করাসহ কঠোর প্রহরার মধ্যে রাখত। কিন্তু তারপরও নিষ্পাপ ইমামদের বার্তা জনগণের কাছে ঠিকই পৌঁছে যেতো। 

জনগণ মহান ইমামগণের বার্তা পেলে নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত। বাদশাহ মামুনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেজা (আ.) যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন ইরাকের অধিকাংশ জনগণ মামুনের বিরোধী হয়ে পড়ে। হযরত আলী(আ.)’র  পবিত্র খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহি হারাতে হবে-মামুন তা বুঝত। ফলে বাদশাহ মামুন ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম প্রথমত রাজি হননি, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে বাধ্য করা হয়। বাধ্য হয়ে ইমাম রেজা বসরা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি গতিপথ পরিবর্তন করে ইরানের দিকে পাড়ি দেন।  যাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। ইমামও নবী করিম (সা.), তাঁর আহলে বাইত ও নিষ্পাপ ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান জনগণের কাছে তুলে ধরেন। সেইসাথে বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান। 

ইমাম ইরানের নিশাপুরে এক বিশাল জনসমাবেশে একটি বিশেষ হাদিস উল্লেখ করেছিলেন। আব্বাসিয় বাদশাহ মামুনের প্রাসাদের দিকে যাওয়ার প্রাক্কালে জনগণের অনুরোধে বলা ওই হাদিস তাঁর থেকে সরাসরি শুনে লিপিবদ্ধ করেন বিপুল সংখ্যক আলেম ও হাদিস বিশারদ। বলা হয় শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে বিশ হাজারেরও বেশি আলেম এই হাদিস সেদিন সেখানেই লিপিবদ্ধ করেন। 

সিলসিলাতুল যাহাব বা স্বর্ণালী চক্র নামে খ্যাত ওই হাদিসে ইমাম রেজা (আ) ওই হাদিস উল্লেখ করে বলেন, মহানবী (সা) বলেছিলেন,  মহান ফেরেশতা জিবরাইল (আ) বলেছেন তিনি গৌরবময় মহান আল্লাহকে বলতে শুনেছেন যে তিনি বলেছেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা'বুদ বা উপাস্য নেই- এই বাক্যটি হচ্ছে আমার দুর্গ, তাই যে তাতে প্রবেশ করবে সে আমার শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে। এতটুকু বলার পর ইমামের কাফেলার যানবাহন চলা শুরু করলে তিনি আরও বলেন, অবশ্য এর তথা মহান আল্লাহর ওই ঘোষণার শর্তাবলী রয়েছে এবং আমি হচ্ছি এর অন্যতম শর্ত! অর্থাৎ তিনি এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে তাঁর ইমামত আল্লাহর পক্ষ থেকেই মনোনীত। আর তাই তাঁর আনুগত্য করা ফরজ।  

ধূর্ত মামুন ইমামকে খলিফা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ইমাম, মামুনের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি তুলে ধরে বলেছিলেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমাকে দান করে থাকেন তাহলে তা অন্যকে দেয়া উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হও, তাহলে সে দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার অধিকার তোমার নেই। ইমাম খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হতে বাধ্য করে। ইমাম রেজা (আ.) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে দূরে থেকে খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষার ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন না করার শর্তসাপেক্ষে যুবরাজের পদ গ্রহণ করেন। 

ইমাম রেজা'র এই দায়িত্ব গ্রহণে আব্বাসীয়রা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বাদশা মামুন তার আসল উদ্দেশ্যের কথা তাদেরকে খুলে বলে। আসলে ইমামকে খোরাসানে আমন্ত্রণ জানানোসহ মামুনের পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল, শিয়াদের বৈপ্লবিক সংগ্রামকে  গতিহীন করা। মামুনের আরেকটি লক্ষ্য ছিল আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। 

আব্বাসীয়রা ইমাম রেজাকে বিভিন্নভাবে হেয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই অপদস্থ করতে পারেনি। যেমন, বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে জটিল প্রশ্ন করে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করার চেষ্টা করে তারা। খরা-পীড়িত অঞ্চলে বৃষ্টির জন্য ইমামকে দিয়ে তারা এই আশায় দোয়া করিয়েছিল  যে দোয়া কবুল না হলে ইমামের মর্যাদা ধূলিসাৎ হবে। কিন্তু ইমাম প্রতিটি জ্ঞানগত বিতর্কে বিজয়ী হতেন এবং বৃষ্টির জন্য করা তাঁর দোয়াও কবুল হয়েছিল। এভাবে ইমাম রেজার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসাও বাড়তেই থাকে। 

আর ইমামও মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে জব্দ করা গেল না, তখন মামুন ইমামকে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করে। পঞ্চান্ন বছর বয়সে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। ইমাম শাহাদাতের মাধ্যমে অমর হয়ে যান।

ইমাম রেজার (আ.) দু'টি বাণী শুনিয়ে ও সবাইকে আবারও শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করব তাঁর জন্মদিনের আলোচনা। তিনি বলেছেন, "জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন এক গচ্ছিত সম্পদের মত যার চাবি হল, প্রশ্ন। যে মানুষের মাঝে সবচেয়ে প্রিয় হতে চায় সে যেন আল্লাহ সম্পর্কে সতর্ক বা মুত্তাকী হয় গোপনে ও প্রকাশ্যে। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।