জুলাই ২৩, ২০২৩ ১৯:০৫ Asia/Dhaka
  • কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইনের মাজারের আশপাশে শোকার্ত অনুরাগীদের জনসমুদ্র
    কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইনের মাজারের আশপাশে শোকার্ত অনুরাগীদের জনসমুদ্র

যারা মহান আল্লাহর প্রিয় তাঁদের প্রতি তিনি বিশ্বাসী ও সৎ জনগণের অন্তরে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা সৃষ্টি করেন। পবিত্র কুরআনের বাণীতে এমন বক্তব্য বা বার্তা রয়েছে। কুরআনে মহান আল্লাহ আরও বলেছেন, তোমরা শহীদদের মৃত বলো না...। এখানেই রয়েছে আল্লাহর ওলিদের প্রতি শোক প্রকাশের দর্শন।

একজন ইসমাইল (আ) ও বিবি হাজরার ত্যাগ-তিতিক্ষার ঘটনার স্মরণ হয়ে আছে হজব্রতের অপরিহার্য অংশ। ইসমাইল হয়েছিলেন কুরবানির সম্মুখীন। কিন্তু তাঁরই এক বংশধর হুসাইন হয়েছেন আরও ‘বড় কুরবানি’ বা ‘জিবহুন আযিম’ মহাসত্যকে রক্ষার জন্য।

আজ পৃথিবীর সবচেয়ে স্মরণীয় ও জীবন্ত মহামানবদের অন্যতম হলেন শহীদ-সম্রাট হযরত ইমাম হুসাইন (আ)। তাঁর জন্য যুগে যুগে মানুষ যত অশ্রু ফেলেছে ও ফেলবে তা জমা করলে হয়ত তা সাগরের রূপ ধারণ করবে। এর কারণ বীরত্ব, সত্য, ন্যায় ও মুক্তিকামিতার প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মগত।

মহানবীর (সা) আহলে বাইতের নাম মুছে ফেলার যত চেষ্টাই করেছিল উমাইয়া ও আব্বাসিয় শাসকগোষ্ঠী ততই তারা বেশি জনপ্রিয় হয়েছেন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যদিও কারবালায় সাময়িকভাবে ঘটেছিল মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত কাণ্ডারি নবী-পরিবারের মহা-বিপর্যয়।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক মু’মিনের হৃদয়ে হুসাইনের শাহাদাতের ব্যাপারে এমন ভালবাসা আছে যে তার উত্তাপ কখনও প্রশমিত হবে না। (মুস্তাদ্‌রাক আল ওসাইল, খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৩১৮)মহানবী (সা) আরও বলেছেন, হুসাইন নূরে আইনি, আনা মিনাল হুসাইন ও হুসাইন মিন্নি। অর্থাৎ হুসাইন আমার চোখের আলো, আমি হুসাইন থেকে ও হুসাইন আমা থেকে। তিনি আরও বলেছেন, হুসাইন মিজবাহুল হুদা ও সাফিনাতুন নাজাত। অর্থাৎ হুসাইন সুপথ দেখানোর প্রদীপ ও নাজাতের তরী। বেহেশতি যুবকদের অন্যতম সর্দার ইমাম হুসাইনের জন্য মহানবী (সা) আগাম কান্না করেছেন। তাঁর জন্য কেঁদেছেন অতীতের সব নবী-রাসুল!

ফার্সি ভাষার এক কবিতায় বলা হয়েছে: ক্যাসিকে আজ এশকে হোসেইন দিওয়ানেহ না শোদ উ আক্বেল নিস্ত। অর্থাৎ যে হুসাইনের প্রেমে পাগল হয়নি সেই বরং অপ্রকৃতিস্থ বা প্রকৃত পাগল।শোকাবহ সেই আশুরার চল্লিশ দিন পর মহানবীর (সা) প্রখ্যাত সাহাবি হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ আনসারি (রা.)’র মাধ্যমে সূচিত ইমাম হুসাইনের চেহলাম পালন ও তাঁর পবিত্র মাজার জিয়ারতের প্রথা চিরন্তন ও সর্বজনীন রূপ নেয়ার অনেক কারণ ও দিক রয়েছে। এসবের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ও উদ্দেশ্য হল ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ শাহাদাতকে চিরস্মরণীয় করে রেখে তা থেকে বীরত্ব, ত্যাগ ও সংস্কারের শক্তি নেয়া।

আসলে ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাতের মত শোকাবহ অথচ চরম বীরত্বপূর্ণ শাহাদতের ঘটনা আর নেই। কেউ কি দেখাতে পারবেন বা বলতে পারবেন যে সত্যের জন্য, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্য, মুক্তিকামিতার জন্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য এমন কোনো নেতা আছেন কি যিনি কেবল নিজের জীবনই নয়, নিজের পরিবার, সম্পদ, সন্তান ও এমনকি পরিবারের নারীদেরও চরম বিপদ, মৃত্যু আর অপমান এবং এমনকি শিশু সন্তানকেও আল্লাহর পথে শাহাদতের রক্তিম সুধা পান করাতে স্বেচ্ছায় প্রস্তুত হন?

আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও মর্মস্পর্শিতার নজিরবিহীন ঘটনা বলেই ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর বা ৬১ হিজরির দশ মহরমের ঘটনা-প্রবাহ কেবল মুসলিম মানসকে নয় বিশ্বের সব মুক্তিকামী, মুক্তমনা ও অমুসলিম মনীষী বা পণ্ডিতদের মনকেও বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছে। তাই বিখ্যাত ঐতিহাসিক গিবন লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, সুদূর অতীতের সেই বিশেষ পরিবেশে হুসাইনের ট্র্যাজিক মৃত্যুর দৃশ্য সবচেয়ে নিরাসক্ত বা কঠিন-প্রাণ পাঠকের হৃদয়েও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।

একদিকে মামুলি অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ১০০ জন ও অন্যদিকে প্রায় ত্রিশ হাজার সুসজ্জিত সেনার সেই অসম যুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কবি ফররুখ লিখেছিলেন:

হোক্ শত্রুসেনা অগণন তবু হে সেনানী দাও হুকুম!

মৃত্যু সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মোরা ভাঙ্গবো ক্লান্ত প্রাণের ঘুম।.

... .......

জীবন দিয়ে যে রাখলো বাঁচায়ে দীনি ইজ্জত বীর জাতির

দিন শেষে হায় কাটলো শত্রু সীমার সে মৃত বাঘের শির।

তীব্র ব্যাথায় ঢেকে ফেলে মুখ দিনের সূর্য অস্তাচলে,

ডোবে ইসলাম-রবি এজিদের আঘাতে অতল তিমির তলে,

কলিজা কাঁপায়ে কারবালা মাঠে ওঠে ক্রন্দন লোহু সফেন

ওঠে আসমান জমিনে মাতম;কাঁদে মানবতা:হায় হোসেন।।

মোহন-চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীর মত ব্যক্তিত্বও বলেন, আমার যদি হুসাইনের ৭২ সঙ্গীর মত নিবেদিত-প্রাণ সঙ্গী থাকত তাহলে আমি বহু আগেই ভারতকে স্বাধীন করতে পারতাম! তিনি বলেছেন, ' আমি মনে করি ইসলাম তরবারির জোরে নয় বরং ইমাম হোসেনের চরম আত্মত্যাগের ফলেই বিকশিত হয়েছে।....। মজলুম অবস্থায় কিভাবে বিজয় অর্জন করতে হয় আমি তার শিক্ষা পেয়েছি ইমাম হোসেনের কাছ থেকে। ভারত যদি একটি বিজয়ী রাষ্ট্র হতে চায় তাহলে তাকে ইমাম হোসেনের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। ইমাম হোসেনের ৭২ জন সেনার মত সেনা যদি আমার থাকতো তাহলে আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভারতের স্বাধীনতা এনে দিতে পারতাম।'

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ইমাম হুসাইনের অনন্য মহতী আদর্শের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, 'ন্যায়বিচার ও সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে অস্ত্র ছাড়াই বিজয় আসতে পারে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে ঠিক যেভাবে বিজয়ী হয়েছেন ইমাম হুসাইন। ইমাম হুসাইন মানবতার নেতা। ইমাম হুসাইন শীতলতম হৃদয়কেও উষ্ণ করেন। হুসাইনের আত্মত্যাগ আধ্যাত্মিক স্বাধীনতাকে তুলে ধরে।'

বাংলার বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহররম সম্পর্কে মহাকাব্য রচনার বিষয়ে বন্ধু রাজনারায়ণকে লিখেছিলেন, 'মুসলমানদের মধ্যে যদি কখনও কোনো বড় কবির উত্থান ঘটে তাহলে তিনি হুসাইন ও তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে এক অনন্য-সুন্দর বীরত্ব-গাঁথা লিখবেন। তিনি গোটা জাতির অনুভূতি তুলে ধরতে পারবেন তাঁর পক্ষ থেকে। আমাদের মধ্যে এমন কোনো বিষয় নেই।’তিনি আরও বলেছিলেন, ‘মহাকাব্য লিখিবার উপযোগী একটি বিষয় রহিয়া গেল- সে মুসলমানদের মহরম। জগতে এমন করুণ রসাত্মক বিষয় আর নাই। হিন্দুদের মহাভারতে ‘অভিমন্যু-বধ' যেমন একটি করুণ রসের প্রস্রবণ, মুসলমানদের মহরম তদপেক্ষা আরো অধিকতর করুণ- রসের মহাসমুদ্র। যদি কেহ লিখিতে পারেন, পরম উপাদেয় হইবে।'

পদ্মভূষণ পুরস্কার-প্রাপ্ত সাহিত্যিক জস মালিহাবাদি বলেছেন, 'মানবতাকে জাগ্রত করো; অত:পর সবাই হোসেনকে নিজের বলে দাবি করবে।'

বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স ইমাম হুসাইন (আ) সম্পর্কে কোনো কোনো মহলের সংকীর্ণ ধারণা ও মিথ্যাচার নাকচ করে দিয়ে লিখেছেন:যদি ইমাম হুসাইন পার্থিব কামনা বাসনার জন্য যুদ্ধ করতেন তাহলে তিনি তাঁর বোন, স্ত্রী ও শিশুদের সঙ্গে আনতেন না।

মহানবীর (সা)পবিত্র আহলে বাইত এবং বিশেষ করে ইমাম হাসান ও হুসাইনের প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা যে কত গভীর তা মহররম, কারবালা ও আশুরা সংক্রান্ত তাঁর লেখা বহু কবিতা, গান আর প্রবন্ধ এবং এসবের নানা অংশের উদ্ধৃতি থেকেই ফুটে উঠে। এ নিয়ে সব কথা লিখতে গেলে একটি বড় ধরনের বই রচনা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে এখানে তাঁর কয়েকটি গানের অংশ উল্লেখ করছি:

‘তৌফিক দাও খোদা ইসলামে...আঁজলা ভরে আনলো কি প্রাণ কারবালাতে বীর শহীদান!’, ‘ হাসান হোসেন হেসে হেসে নাচত আমার বক্ষে এসে/ চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে নেয়ামত/ আমি যদি আরব হতাম মদিনারও পথ...’, 'শোকে ছলছল কাঁদে অবিরল আজও ফোরাতের পানি', 'মহররমের চাঁদ এলো ওই কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়', 'কুল-মখলুক কাঁদিয়ে ওই এলো মহররম হায় হোসেন হায় হোসেন উঠলো রে মাতম'! নজরুলের এই গানটিও চোখে পানি নিয়ে আসে:

‘ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়…. ছুটে আয়

তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি

দ্বীনের শেষ বাতি বুঝি নিভিয়া যায় গো

বুঝি আঁধার হলো মদিনাপুরী।’

নজরুলের মহররম কবিতা যেন মধুসূদনের আশা অনেকাংশে পূরণ করেছে:

নীল সিয়া অসমান লালে লাল দুনিয়া,

–‘আম্মা ! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া’।

কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,

সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !

.... .....

কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,

বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!

গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,

‘আম্মা গো পানি দাও ফেটে গেল ছাতি মা!’

নিয়ে তৃষা সাহারার, দুনিয়ার হাহাকার,

কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার!

দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস

পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্‌মনও ‘সাব্বাস’!

... .... ....

একই কবিতায় কারবালার চরম অসম যুদ্ধে ইমাম হুসাইনের অনন্য বীরত্ব প্রসঙ্গে লিখেছেন:

হাইদরি-হাঁক হাঁকি দুল্‌দুল্-আস্‌ওয়ার

শম্‌শের চম্‌কায় দুশমনে ত্রাস্‌বার!

খসে পড়ে হাত হতে শত্রুর তরবার,

ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার।

....

কারবালার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একই কবিতায় নজরুল লিখেছেন:

জাগো ওঠো মুস্‌লিম, হাঁকো হাইদরি হাঁক।

শহীদের দিনে সব-লালে-লাল হয়ে যাক!

নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তিন,

ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন।

হাসানের মতো পি’ব পিয়ালা সে জহরের,

হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের;

আস্‌গর সম দিব বাচ্চারে কোর্‌বান,

জালিমের দাদ নেবো, দেবো আজ গোর জান!

সকিনার শ্বেতবাস দেব মাতা কন্যায়,

কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়!

মোহর্‌রম্! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসেনা!’

দেখো মরু-সূর্যে এ খুন যেন শোষে না!

কারবালা ও আশুরার ঘটনা তরবারির ওপর রক্তের বিজয়কে স্মরণ করার এবং তাকে সুস্থির ও সুদৃঢ় করার দিন। মহররমের এই দিনগুলো নবীজীর আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার ওসিলায় ঈমানকে জোরদার ও চাঙ্গা করার দিন। নজরুলের ভাষায় মৃত্যুকে প্রকৃত ও গৌরবময় জীবনের পানে ডাকার দিন এই দিন। সত্যের পথে হায়দারি হাঁক হাঁকার দিন হল এমনই দিন। আল্লাহতে যাদের পূর্ণ ঈমান তাঁদের সম্মানে ও তাঁদের চির-উন্নত শিরগুলোর সম্মানে অশ্রু ফেলার ও শোককে শক্তিতে পরিণত করার দিন হল ২০ সফর।

নজরুল হুসাইনি দর্শন ও আশুরার মূল চেতনাও বুঝতে পেরেছিলেন বলে ইসলামের নামে প্রচলিত পশু-শক্তির স্বরূপও বুঝতে পেরেছিলেন ও তা তুলে ধরতেও ভুল করেননি। তাই আশুরার শহীদি সংস্কৃতির দর্শনের আলোকেই তিনি লিখেছেন: শহীদি ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারি, সারা দুনিয়াতে হবে আবার ইসলামী ফরমান জারি। অন্যদিকে ইয়াজিদি পশুবাদ তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:

‘ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ

এসেছে এজিদী বিদ্বেষ পূনঃ মোহরমের চাঁদ

এক ধর্ম এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে

তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে

এসেছে সীমার এসেছে ‘কুফার’ বিশ্বাসঘাতকতা

ত্যাগের ধর্মে এনেছে লোভের প্রবল নির্মমতা

মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ

কাঁদে আসমান জমিন কাঁদিছে মহররমের চাঁদ

একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা

আরদিকে যত তখ্‌ত-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা

.....

এই দুনিয়ার মৃত্তিকা ছিলো তখত যে খলিফার

ভেঙে দিয়েছিলো স্বর্ণসিংহাসনের যে অধিকার

মদগর্ব্বী ও ভোগী বর্বর এজিদী ধর্ম্মী যত

যুগে যুগে সেই সাম্য ধর্মে করিতে চেয়েছে হত

এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন

আলীর সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান

এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়

হাসান হোসেনে গালি দিতে যেতো মক্কা ও মদিনায়!!

ইমাম হুসাইনের বিপুল শোকার্ত অনুরাগী থাকার রহস্য তুলে ধরে ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে জন্ম-নেয়া ও ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখে খ্যাতিমান হওয়া (নাইটঅ্যাঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া উপাধিধারী) সংগ্রামী ভারতীয় বাঙ্গালী নারী-কবি সরোজিনি নাইডু লিখেছেন:

Why do thy myriad lovers so lament?

Sweet saint, is not thy matchless martyrhood

The living banner and brave covenant

Of the high creed thy Prophet did proclaim,

Bequeathing for the world’s beautitude

Th’ enduring loveliness of Allah’s name?

অর্থ: (হে হুসাইন) কেন তোমার বিপুল অনুরাগী এত শোকার্ত?

সুমিষ্ট তাপস, তোমার তুলনাহীন শাহাদাত

নয় কি উচ্চ আদর্শের জীবন্ত প্রতীক,

খোদাকে দেয়া ওয়াদার বাস্তবায়ন?

যা বলেছিলেন তোমাদের পয়গাম্বর

সাজাতে বিশ্বকে অপরূপ সাজে

প্রকাশিতে মহান আল্লাহর নামের অক্ষয় সৌন্দর্য?

আরব খ্রিস্টান পণ্ডিত ও সাহিত্যিক জর্জ জুরদাক ইমাম হুসাইন (আ)’র আদর্শিক আকর্ষণ প্রসঙ্গে লিখেছেন:‘ইয়াজিদ যখন ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার জন্য জনগণকে উৎসাহ দিত এবং রক্তপাত ঘটানোর নির্দেশ দিত তখন তারা বলত, কতো টাকা দেবেন? কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সঙ্গীরা তাঁকে বলতেন, আমরা আপনার সঙ্গে রয়েছি। আমাদেরকে যদি সত্তুর বারও হত্যা করা হয় তবুও পুনরায় আপনার পক্ষে যুদ্ধ করতে ও নিহত হতে চাইব।’

জাস্টিস এ ডি রাসেল ‘কারবালার শহীদ’ (The Martyr of Karbala) শীর্ষক এক অসাধারণ সুন্দর কবিতায় ইয়াজিদ সেনার বর্শায়-বিদ্ধ ইমামের কর্তিত শির-মুবারক, তাঁর মুখ ও ঠোঁটে শিশু অবস্থায় নানা মহানবী (সা)’র চুমু ও বাবার তরবারি আর কুফার জীবনের আবেগময় স্মৃতিসহ মানুষের হৃদয়ে ইমামের বীরত্বপূর্ণ ও করুণ শাহাদাতের কালজয়ী গৌরব হয়ে থাকার বিষয় এবং দুরাচারী ইয়াজিদের প্রতি ঘৃণার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন :

From age to age, on Virtue's age,

Shall live the deathless story,

His loss remain the Martyr's gain,

His shame the Martyr's glory;

Till truth shall lie, and Honor die,

And time itself be hoary.?

Arise Husain, arise,

Chief of the Prophet's seed;

Fling broad thy banner to the skies,

And come with utmost speed,

Or ere the throne of the All-Wise

Usurped be by foul Yazid?.

He's donned his armour bright,

His father's sword girt on;

The sword of Ali, as the might

Of the Destroyer's own:

And he is off ere morning light

Across the desert wide and lone,?

Now, Kufa, keep thy word!

To the good cause be true;

Yazid has sent a giant horde

To march thy province through;

The hirelings of his father's hoard,

Who grace or mercy never knew.?

They bore his god-like head aloft,

His mouth struck with their whips.?

O mouth, that I have seen so oft,

A-teem with angel quips,

In baby-kisses, warm and soft,

Pressed to the Prophet's lips!?

O body, trampled, fouled, disdained,

Which charmed the gazer's eye,

The blood from out thy veins that drained

Was heaven's electuary;

No horses hooves were ever stained

In so divine a dye.O barren plain of Karbala,

With herb, nor yet with sod

Be clad eternally; for ah!

There, overwhelmed, down-trod,

The holy son of Fatima

Gave up his soul to God!

এইচ জি ওয়েলস ‘ট্রিবুট টু ইমাম হুসাইন’ কবিতার একাংশে ইয়াজিদের বিশাল বর্বর বাহিনীর মোকাবেলায় হুসাইনের সঙ্গীদের অনন্য সাহস আর বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের কথা তুলে ধরে একে ‘সুনিশ্চিত ঐশী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন:

Oh! How valiantly fought that pitiful few,

Against Yazid's wild murderers,

Fought with a courage unequalled in Time

Fought with a fierceness that was surely Divine.

The earth quaked and trembled as noon drew near.

But still the survivors knew no fear

But fewer grew that pitiful band,

For Islam, God, and Husain they stand.

At last, all were dead, the devil had won,

Blood red sank down the merciless sun,

Trampled and torn lay the gallant Husain,

For Islam, God, and the faithful were slain

Ethel M. Pope তাঁর Tragedy of Moharram শীর্ষক কবিতায় ইমাম হুসাইন (আ)-কে দাগহীন বা ত্রুটিহীন বীর হিসেবে উল্লেখ তাঁর মহৎ ত্যাগকে বিশ্বজোড়া খ্যাতির কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। মহৎ উদ্দেশ্যের কারণেই অসম যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটা সত্ত্বেও তিনি সবার প্রিয় হয়েছেন বলে পোপ লিখেছেন:

The loss of him beloved by all

A hero without stain,

Whose noble sacrifice has made

The world ring with his name

With open hand he gave his all;

His little children dear শীর্ষক শিরোনামে Ethel M. Pope আরও লিখেছেন: কারবালায় অসম যুদ্ধের মারাত্মক সংকটের মধ্যে যখন ইমামের ভাই, বন্ধু ও অসহায় নারীরা বিচলিত হয়ে তাঁর কাছে আসল তখনও অবিচলিত হয়ে ইমাম বীরের মত লড়াই করে শহীদ হলেন যাতে ইসলাম রক্ষা পায়। শহীদের এইসব স্মৃতি মানুষকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য করে ও প্রতি বছর বুকে জমে থাকা দুঃখের যেন বিস্ফোরণ ঘটে মহররম মাসে এবং যেন বেহেশত হতে ভেসে আসে ব্যাকুল ও অনির্বার আর্তনাদ : হায় হুসাইন, হায় হুসাইন, হায় হুসাইন!

Brothers, friends - helpless women too,

Cling to him in fear,

Unflinchingly, nor moved nor wept,

Secure in his just cause,

He nobly fought and nobly died,

To save Islam's great laws.

All the memory of martyrdom

A new the passions rise;

A bitter, sobbing, wailing cry,

Goes up unto the skies;

With each new year the latent grief,

Pent up, breaks out again,

And Heaven returns the impassioned cry,

Husain, Husain, Husain!

ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের অন্যতম অগ্রদূত ও সুফি-সাধক খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (র) তাঁর ফার্সি কবিতায় উল্লেখ করেছেন, 'শাহ আস্ত হুসাইন, পদশাহ আস্ত হুসাইন, দ্বীন আস্ত হুসাইন দ্বীন-পানাহ্ আস্ত হুসাইন / সরদাদ নাদাদ দস্ত দরদস্তে ইয়া‌জিদ/ হাক্কা‌কে বেনা‌য়ে লা ইলাহা আস্ত হুসাইন। অনুবাদ: হুসাইন শাহ, হুসাইন বাদশাহ, হুসাইনই দ্বীন বা ধর্ম , হুসাইনই দ্বী‌নের আশ্রয়দাতা, মাথা দি‌য়ে‌ছেন কিন্তু ইয়া‌জি‌দের হা‌তে হাত দেন‌নি। সত্যি বলতে কি লা-ইলাহার ভিত্তি হলেন হুসাইন।'মহানবী (সা) কেনো বলেছিলেন, হুসাইন আমা থেকে ও আমি হুসাইন থেকে তার ব্যাখ্যা মেলে এ কবিতায়। সম্ভবত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির (র) অনুসরণ করেই একই ধরনের মন্তব্য করেছেন কবি আল্লামা ইকবাল লাহোরি।

গোটা মানবজাতি ও মানব সভ্যতার গর্ব ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর বীর সঙ্গীরা আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, অসত্যের কাছে কভু নাহি নত করি শির, ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর। #

 

পার্সটুডে/এমএএইচ/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ