হজ ও মুসলিম ঐক্য
(last modified Sun, 11 Aug 2019 11:32:25 GMT )
আগস্ট ১১, ২০১৯ ১৭:৩২ Asia/Dhaka

বন্ধুরা‍! মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ইবাদত- হজের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করা। প্রতি বছর হজের মৌসুমে সারাবিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান সব ধরনের জাতিগত ও ভৌগোলিক ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে হজের আনুষ্ঠানিক ইবাদত সম্পন্ন করার মাধ্যমে একদিকে আল্লাহর বিধান পালন করেন এবং অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ শক্তিশালী করেন।

মুসলমান নেতদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হজের ভূমিকা নিয়ে আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবে। হজকে ইসলামের সবচেয়ে বিস্ময়কর ইবাদত বলা যেতে পারে। অন্য অনেক ইবাদতের মতো এই ইবাদতটি একাকি করা সম্ভব নয়। এখানে আল্লাহর অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একসাথে ইবাদতের ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয়। সাহস করে একথা বলাই যায় যে, শুধু ইসলাম নয় বিশ্বে প্রচলিত অন্য কোনো ধর্মে এত বিশাল ইবাদতের অনুষ্ঠান আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমানরা জমায়েত হওয়ার মাধ্যমে তাদের অন্তরের ঘনিষ্ঠতা শক্তিশালী করেন।

হজের আনুষ্ঠানিকতার বিভিন্ন দিক রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিধানের রাজনৈতিক দিকটিকে ব্যবহার করে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি অমুসলিমদের সামনে একটি বিশাল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ইমাম জাফর সাদেক (আ.) এ সম্পর্কে বলেন: মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করে তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে মঙ্গল লাভের উপায় বাতলে দিয়েছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মুসলমানরা যাতে এক স্থানে জমায়েত হয়ে পরস্পরকে চিনতে পারে এবং নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে সেজন্য আল্লাহ হজের বিধান দিয়েছেন।

পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে মানুষকে একতাবদ্ধ থাকার প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানব সৃষ্টির শুরুতে তারা ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে মহান আল্লাহ তাদের কাছে নবী-রাসূল পাঠান যাতে তারা আবার ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সিরাতুল মুস্তাকিম বা সঠিক পথের দিশা লাভ করতে পারে।

পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা সে (বিশাল) নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদিগকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। ফলে, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ। তোমরা এক অগ্নিকুন্ডের পাড়ে অবস্থান করছিলে। অতঃপর তা থেকে তিনি তোমাদেরকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ নিজের নিদর্শনসমুহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা হেদায়েত প্রাপ্ত হতে পার।”

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইসলামের এই একতাবদ্ধ থাকার নির্দেশের ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সব উপাদান ধ্বংসের উপায় বলে দিয়ে গেছেন। তিনি মদীনায় হিজরত করার পর আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদেরকে চুক্তিতে আবদ্ধ করে দেন। এসব চুক্তির ধারাগুলো ছিল এমন যে, এগুলো মুসলমানদের মধ্যে সংহতি বাড়িয়ে দিত। এ ছাড়া, হজের আনুষ্ঠানিকতা ছিল বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি ইমাম খোমেনী (রহ.) হজকে এমন একটি ইবাদত হিসেবে উল্লেখ করেন যা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সংহতি স্থাপনের পাশাপাশি অমুসলিমদের সামনে মুসলমানদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। কাজেই হজ করতে আসা আলেম ও চিন্তাবিদগণ হজের আনুষ্ঠানিকতার অবকাশে বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন বলেই আশা করা যায়। অবশ্য ইমাম খোমেনী (রহ.)’র মতে, ইসলামের ফিকাহ শাস্ত্রে আলেমদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। মহানবী (সা.) যেমনটি বলেছেন: আমার উম্মতের মধ্যে মতপার্থক্য হচ্ছে আল্লাহর রহমত। তবে এই মতপার্থক্য নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরিয়ে গেলে তা হবে বিপজ্জনক। সেক্ষেত্রে ইসলামের শত্রুরা সুযোগ  নেবে এবং তারা বিষয়টিকে মুসলমানদের দুর্বল করার কাজে ব্যবহার করবে।

বর্তমান যুগের অনেক উন্নত ও কথিত সভ্য দেশ যৌথ স্বার্থ রক্ষা করার লক্ষ্যে অনেক বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং চুক্তি সই করে। ইউরোপীয় দেশগুলো অভিন্ন পার্লামেন্ট ও বাজার প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ঐক্যকে এতটা শক্তিশালী করেছে যে, তারা এখন অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহার করছে এবং এসব দেশের সীমান্তরেখা এখন একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেই এ ধরনের সহযোগিতা সম্ভব। যদিও সব মুসলিম দেশ অভিন্ন সীমান্তের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত নয় কিন্তু তারপরও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এগুলো তেমন কোনো বাধাই নয়। হজ হচ্ছে এমন একটি ইবাদত যেখানে মুসলিম নেতারা এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করতে পারেন যাতে মুসলিম দেশগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ইস্পাতকঠিন ঐক্য সৃষ্টি হয়।

ইমাম খোমেনী (রহ.)  এ সম্পর্কে বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ইচ্ছা অনুযায়ী মুসলমানদের মধ্যে যদি সেরকম কোনো ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলিম দেশগুলো একটি সম্মিলিত সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারে যা হবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো অন্তত তাদের জাতি, ভাষা ও মাজহাবগত বিভেদ ভুলে শুধুমাত্র ইসলামের কথা মাথায় রেখে এ বিষয়টি  নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে এবং  এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।

এ সম্পর্কে ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন: হজ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর শক্তি প্রদর্শনের স্থল এবং ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। এখানে সব মুসলমান এক পোশাকে এক স্থানে সমবেত হওয়ার মাধ্যমে পরস্পরকে চিনতে ও জানতে পারেন এবং পরস্পরের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাদের মধ্যে অন্তরের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। মুসলিম দেশগুলো পরস্পরকে সহযোগিতা করার সুযোগ পান হজের মৌসুমে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে যারা হজ পরিচালনার দায়েত্ব রয়েছেন তারা এ ধরনের কোনো উদ্যোগই নিচ্ছেন না।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, হজ যদি ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পালন করা হয়  তাহলে মুসলমানদের সম্মান আরো বেড়ে যাবে এবং তাদের মধ্যে ঐক্য আরো শক্তিশালী হবে। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/মো.আবুসাঈদ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।