ইমাম খোমেনী (র.) নারীসহ সব শ্রেণীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশ্বনবীর (সা.) আদর্শকে তুলে ধরতেন
ইসলামী সভ্যতার পুননির্মাতা ইমাম খোমেনী (র)
ইসলামী সভ্যতার শীর্ষস্থানীয় পুননির্মাতা মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা। ইসলামী বিপ্লবের সফল নেতা ইমাম খোমেনী (র.) আধুনিক যুগে প্রথমবারের মত ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা বিশ্ব-ব্যবস্থা আর সংস্কৃতির ...
কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্ব-রাজনীতিতে এক প্রবল ভূমিকম্প হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। ইসলামী বিপ্লবের সফল নেতা ইমাম খোমেনী (র.) আধুনিক যুগে প্রথমবারের মত ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা বিশ্ব-ব্যবস্থা আর সংস্কৃতির কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্ব-রাজনীতিতে এক প্রবল ভূমিকম্প হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। খোদাবিমুখ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কথিত পরাশক্তিগুলোর আধিপত্যকে অবজ্ঞা করে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামকে তুলে ধরেছেন সমসাময়িক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও চ্যালেঞ্জিং শক্তি হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি ইরানি জাতির প্রবল চপেটাঘাত ইবলিসি শক্তিগুলোর একাধিপত্যকে নড়বড়ে করে দেয়। বিগত হাজার বছরের ইতিহাসে ইসলামী শক্তির এমন প্রবল উত্থান আর কখনও ঘটেনি।
" ইসলাম ধর্ম মেনেই স্বাধীনতা অর্জন" ছিল ইরানের ইসলামি বিপ্লবের আন্তর্জাতিক বার্তা। অথচ সমাজবাদী ও লিবারেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার কর্তৃত্বাধীন আধুনিক বিশ্ব-ব্যবস্থায় ধর্মীয় আইন-ভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থার কথা কেউ কল্পনাও করেনি।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী (র.) ছিলেন প্রজ্ঞাবান, সাহসী ও অকুতোভয়। এ ছিল এই বিপ্লবের এক বিরল সৌভাগ্য। নবী-বংশের রক্তধারী এই ইমাম ছিলেন সময়ের গতি-প্রকৃতি অনুধাবনে সক্ষম। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা ও আকুতি ইসলামী জাগরণকে করেছে বেগবান। তাঁর নেতৃত্বের কারণেই ইরানি জাতি পরাশক্তিগুলোর প্রভাব এবং অবসাদ ও হতাশার মত শয়তানী শক্তিগুলোকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। ইমাম ছিলেন দ্বিধাহীন ও নিঃশঙ্ক আত্মত্যাগের এক প্রজ্জ্বোল দৃষ্টান্ত।
ইমাম খোমেনী (র.)’র ব্যাপক দূরদৃষ্টি ও ইস্পাত-কঠিন খোদায়ী সংকল্প তাঁকে দিয়েছে কিংবদন্তীতুল্য জনপ্রিয়তা। তিনি খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের চেতনায় জাগিয়ে তুলেছিলেন ইরানের আলেম সমাজ ও জনগণকে। ইমামের খোদাভীতি ও একনিষ্ঠতাও ছিল বিশ্বনবী (সা.)’র নুরানি আদর্শের প্রতিফলন। ফলে তাঁর দিক-নির্দেশনার সুবাদে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার প্রেরণায় ইরানি জাতি এতটা উজ্জীবিত হয়েছিল যে তাদের সব স্তরে, বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে জিহাদ ও শাহাদতের সংস্কৃতির বিস্ময়কর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। আর এ বিষয়টি বিশ্ববাসীকে অভিভূত করেছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) একাধারে এমন একটি ঐতিহ্যের উত্তরসূরি ও এই ধারার সফল পরিপূর্ণতাদানকারী যে ধারার আলোকে ইরানের আলেম, জনগণ এবং এমনকি বুদ্বিজীবী সম্প্রদায়েরও সবাইই মুজতাহিদ ফকিহদের আনুগত্য করতেন।
অবশ্য ইমাম খোমেনী (র.) যোগ্যতা ও অবদানের দিক থেকে সমসাময়িক যুগের সব মুজতাহিদকে ছাড়িয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হামিদ আলগার বলেছেন:
"আয়াতুল্লাহ খোমেনী মানবাদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি কেবল নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতার এক অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে ইরানে এরূপ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। … রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লব পরিচালনায় তিনি যে অবদান রেখেছেন তা সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে অতুলনীয় এবং সে ভূমিকা পণ্ডিত, দার্শনিক ও আধ্যাত্মবাদী হিসেবে তার পরিচিতিকে ছাড়িয়ে গেছে।...১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দেশে ফিরে আসলেন। কিন্তু তিনি সাথে করে কোনো সম্পদ আনেননি, কোনো রাজনৈতিক দলও গঠন করেননি ও কোনো গেরিলা যুদ্ধও চালাননি। কোনো বিদেশী শক্তির সাহায্যও তিনি নেননি। অথচ এর মধ্যেই তিনি ইসলামী আন্দোলনের তর্কাতীত নেতৃত্বে সমাসীন হলেন। "
ইমাম খোমেনীর ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তি। তিনি কখনও আপোষ করতেন না। অনেকেই যখন মরহুম ইমাম খোমেনীকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার তখন তিনি তাদের এই উপদেশে কান দেননি। তাদের যুক্তি ছিল এটা যে যখন বিশ্বের বৃহত্তম অনারব সুন্নি রাষ্ট্র তুরস্ক ও বিশ্বের বৃহত্তম আরব রাষ্ট্র মিশরও দখলদার বর্ণবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে তখন আমরা কেন ইরানকে বিপদাপন্ন করব? কিন্তু ইমাম তাদের এ পরামর্শে কান না দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। .. আর এটাই হল ইসলামের আপোষহীন ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি। আর এমন মহান ব্যক্তি আসলেই ইসলাম ও মুসলমানের জন্য এক মহা-ঐশী উপহার।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র নেতৃত্বে সংঘটিত মহান কারবালা বিপ্লবের অনন্য আত্মত্যাগের দর্শন ও শিক্ষার পুনরুজ্জীবন ইমাম খোমেনীর সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ।
ইমাম খোমেনী (র.) নারীসহ সব শ্রেণীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা.)’র আদর্শকে তুলে ধরতেন। ইমাম খোমেনী (র.) ছিলেন অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। বিশ্বের বড় বড় দেশের নেতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা ইমামের বাসভবনের অতি সাধারণ অবস্থা দেখে বিস্মিত হতেন।
বিশ্ব ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী এক অসাধারণ, বরেণ্য ও শক্তিশালী নেতা হওয়া সত্ত্বেও ইমাম খোমেনি ছিলেন সদালাপী, অত্যন্ত বিনয়ী ও নিরহংকার। তিনি বলতেন, আমি জনগণের একজন সেবক মাত্র, আমাকে নেতা না বলে সেবক বলাই ভাল হবে।
আল্লাহর প্রতি ইমাম খোমেনী (র.)'র সুগভীর নির্ভরতা থেকে উদ্ভূত তাঁর নানা বক্তব্য এবং এই গভীর আস্থার ফলে সৃষ্ট তাঁর সদা-প্রশান্ত চিত্ত পরিদর্শকদের মুগ্ধ করত। তাই বাহ্যিক দৃষ্টিতে ইমামের অনেক কথা খুব সাধারণ মনে হলেও শ্রোতাদের মধ্যে তা গভীর প্রভাব ফেলত।
ইমাম খোমেনীর ডাকে সাড়া দিয়েই ইরানি জাতি ৮ বছরের পবিত্র প্রতিরক্ষার এক অনন্য নজির গড়ে তোলে যা ইরানকে দিয়েছে অনন্য বিজয়, মর্যাদা এবং সামরিক স্বনির্ভরতা ও সাম্রাজ্যবাদীদের বুকে কাঁপন-ধরানো জিহাদের অমর গৌরব।
ইমাম খোমেনী (র) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিগুলোকে জাগিয়ে তোলার জন্য সব সময় সক্রিয় ছিলেন। আধুনিক যুগে ইসলামী ঐক্যের প্রধান রূপকার হিসেবে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। মুসলিম বিশ্বের প্রধান সংকট সমাধানের লক্ষ্যে তথা মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসাকে পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি প্রবর্তন করেন বিশ্ব-কুদস দিবস যা পালন করা হয় প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবারে। তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠেছে ইসরাইল বিরোধী অদম্য বিজয়ী শক্তি লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের ইসলামী জিহাদ ও হামাস। ইহুদিবাদী ইসরাইলের মোকাবেলায় এইসব সংগ্রামী দলের গত কয়েক দশকের ও সাম্প্রতিক সাফল্য ইমাম খোমেনীর আদর্শিক অনুপ্রেরণার কাছে ঋণী।
পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা)’র প্রতি অবমাননাকারী কুখ্যাত মুর্তাদ সালমান রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ঐতিহাসিক ফতোয়া দিয়ে ইমাম খোমেনী (র) পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ক্রুসেডের দাঁতভাঙ্গ জবাব দিয়েছিলেন। বিশ্বনবীর (সা) সুন্নাত অনুসরণ করেই ইমাম তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠিয়েছিলেন এবং সমাজতন্ত্র জাদুঘরে স্থান পাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ইমামের ওই ভবিষ্যদ্বাণী কয়েক বছরের মধ্যেই সফল হয়েছিল। মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে আবারও গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি ।#
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/আবুসাঈদ/০৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।