জেরুজালেমের ইহুদিকরণ-বিরোধী ইউনেস্কোর ঘোষণা: বিপাকে ইসরাইল
(last modified Sat, 22 Oct 2016 12:07:11 GMT )
অক্টোবর ২২, ২০১৬ ১৮:০৭ Asia/Dhaka
  • মুসলমানদের প্রথম কিবলার শহর বায়তুল মুকাদ্দাসে আল-আকসা মসজিদের দৃশ্য
    মুসলমানদের প্রথম কিবলার শহর বায়তুল মুকাদ্দাসে আল-আকসা মসজিদের দৃশ্য

সম্প্রতি জাতিসংঘের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ ইহুদিবাদী ইসরাইলকে দখলদার শক্তি এবং আল-আকসা মসজিদকে মুসলমানদের মালিকানাধীন স্থাপনা বলে ঘোষণা করেছে।

এ ইশতেহারের সুবাদে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির জন্য সহায়তার পথ প্রশস্ত হবে বলে অনেকেই আশা করছেন। 
বহু বছর ধরেই মুসলমানদের প্রথম কিবলা তথা পবিত্র আল আকসা মসজিদ ও বায়তুল মুকাদ্দাস শহরের মালিকানা নিয়ে নানা বিতর্ক চলছিল। জাতিসংঘ ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে-থাকা এ অঞ্চলটিকে অধিকৃত অঞ্চল বলে মনে করে।জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ অঞ্চল থেকে ইসরাইলকে ১৯৬৭ সালের পূর্ববর্তী সীমান্তে ফিরে যেতে বলেছে বহু বছর আগেই। 
অথচ বর্ণবাদী ইসরাইল চায় বায়তুল মুকাদ্দাস শহরটিকে কথিত ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। অন্যদিকে আল-আকসা মসজিদ তথা মুসলমানদের প্রথম কিবলার শহর বায়তুল মুকাদ্দাসের পূর্বাঞ্চলকে ফিরে পেতে চায় ফিলিস্তিনিরা এবং তারা এ অঞ্চলকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করতে চায়।  
সম্প্রতি ইউনেস্কোর খসড়া প্রস্তাবে আলআকসা মসজিদ ও আশপাশের এলাকাকে কেবল ইসলামী নাম ‘হারাম শরিফ ’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইহুদিদের কথিত ‘টেম্পল মাউন্ট’  বা ‘উপাসনা-পর্বত’-এর কোনও উল্লেখ করা হয়নি ওই ইশতিহারে। 
জাতিসংঘের বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’ এই একই ইশতিহারে এই পবিত্র এলাকায় মুসলমানদের ওপর ইসরাইলি সহিংসতার নিন্দাও জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো এবং পূর্ব বায়তুল মুকাদ্দাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রক্ষার চেষ্টা করছে ইউনেস্কো। 

ইউনেস্কোর এই ইশতেহারে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে দখলদার শক্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটি ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে। ওই একই ইশতেহারে এখানকার স্থাপনাগুলোর ইসলামী নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তবে ইশতেহারের শুরুতেই বলা হয়েছে যে এই এলাকার সব কিছুই ইব্রাহিমি সব ধর্ম তথা ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের কাছে সম্মানিত। আর তাই বায়তুল মুকাদ্দাসের পশ্চিম প্রাচীরও এইসব পবিত্র স্থাপনার অংশ যা ইহুদিদের ইবাদতের স্থান।
ইউনেস্কোর খসড়া ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে, ইসরাইলকে মাসজিদুল আকসার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হবে।  ২০০০ সাল থেকে এই পবিত্র এবং ঐতিহাসিক মসজিদ নিয়ন্ত্রণ করছে দখলদার ইসরাইল। এর আগে মুসলমানদের প্রথম কিবলার এই স্থাপনা পরিচালিত হত জর্দানের ওয়াকফ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে। ইউনেস্কোর ইশতিহারে জর্দানের সেই নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। 

ইশতেহারের অষ্টম  অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ইউনেস্কো এ অঞ্চলে ইসরাইলের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের পাশাপাশি ওয়াকফ দপ্তর ও এর কর্মীদের ওপর নানা সীমাবদ্ধতা আরোপের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। সংস্থাটি ধর্মকর্মের স্বাধীনতায় ও মাসজিদুল আকসা তথা হারাম শরিফের পবিত্র স্থানে মুসলমানদের যাতায়াতে বাধা দেয়ারও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। 
ইউনেস্কোর ওই ইশতেহারের নয় নম্বর অনুচ্ছেদে আল আকসা মসজিদে উগ্র ইসরাইলিদের হামলার দায়-দায়িত্ব ইসরাইলি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বর্তায় বলে উল্লেখ করা হয়।  
ইউনেস্কোর ওই ইশতেহারের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসন এবং ফিলিস্তিনি নাগরিক, ঐতিহাসিক স্থাপনার সঙ্গে জড়িত কর্মী ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ওপর ইসরাইলি হামলাগুলোর নিন্দা জানানো হয়েছে। একই অনুচ্ছেদে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ফিলিস্তিনিদের গ্রেফতার ও তাদের আহত করারও নিন্দা জানানো হয়।
ইউনেস্কোর ওই ইশতেহারে আল-খলিল শহরে অবৈধ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের জন্য নানা স্থাপনা ও সড়ক নির্মাণের ইসরাইলি তৎপরতাগুলোরও নিন্দা করা হয়েছে। এ ছাড়াও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি শিশু আর শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সহিংসতা ও অবৈধ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীসহ উগ্র নানা গ্রুপের  নানা উস্কানিমূলক তৎপরতা বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে ওই ইশতেহারে।
ইউনেস্কো ইহুদিদের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকা থেকে ফিলিস্তিনিদের দু’টি ওয়েব সাইট বন্ধ করে দেয়া সংক্রান্ত ইউনেস্কোর আগের ইশতেহারগুলো বাস্তবায়নে ইসরাইলের বিরত থাকার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি ওইসব ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে আবারও ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।  
ইউনেস্কোর ওই ইশতিহারে এই সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধিদের ওপর ইসরাইলের নানা বাধা-বিপত্তি চাপানোর কথাও বলা হয়েছে। সংস্থাটি বায়তুল মুকাদ্দাসের আশপাশে ইসরাইলের ১৮টি পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের কাজ যথাশিঘ্র সম্ভব বন্ধ করতে বলেছে।  
ইহুদিবাদী ইসরাইল ইউনেস্কোর নানা ইশতেহার পালন করছে না বলে এ সংস্থার কার্যকরী পরিষদের আগামী বৈঠকে ‘অধিকৃত ফিলিস্তিন’ শিরোনামে আলাদা বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। 
ইউনেস্কোর এই ইশতেহার ২৪টি ভোট পেয়ে পাস হয়েছে। এর বিপক্ষে ভোট পড়েছিল মাত্র ৬টি। অন্যদিকে ৬ সদস্য-দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। 
এদিকে ইহুদিবাদী ইসরাইল ইউনেস্কোর এই ইসরাইল বিরোধী ইশতেহারের প্রতিবাদে সংস্থাটির সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে। ইসরাইলে কথিত শিক্ষামন্ত্রী নাফতালি বেনিত ইউনেস্কোর মহাসচিব ইরিনা বোকোভার কাছে লেখা এক চিঠিতে লিখেছেন, ইউনেস্কো বায়তুল মুকাদ্দাসের সঙ্গে ইহুদিদের কথিত হাজার হাজার বছরের সম্পর্ককে উপেক্ষা করেছে ও  ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে সহায়তা দিচ্ছে! 
বর্ণবাদী ইসরাইলের বর্ণবাদী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ইউনেস্কোতে অন্তঃসারশূন্য ও বিপর্যয়কর নাটক এখনও চলছে এবং আজ এই একই সংস্থা আরও একটি অবাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছে, ‘টেম্পল মাউন্ট’ ও ‘কান্নার প্রাচীর’-এর সঙ্গে ইসরাইলি জনগণের কোনও সম্পর্ক নেই।
মোশে আমির নামের ইসরাইলি রেডিও’র এক বিশ্লেষক ইউনেস্কোর ইসরাইল বিরোধী ইশতিহারের জবাবে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছেন, ইউনেস্কোর উচিত আবারও ইতিহাস পড়ে দেখা!। তিনি আরও বলেছেন, জাতিসংঘের শাখা সংস্থাগুলো লজ্জাহীন! এবং এই ইশতেহারের বক্তব্যগুলো ইরানের ইসলামী সরকারেরই কথা!
ইউনেস্কোর এই ঐতিহাসিক ইশতেহার অনুমোদন হওয়ার পর সংস্থাটির মহাসচিব ইরিনা বোকোভা বলেছেন, জেরুজালেম তথা বায়তুল মুকাদ্দাস তিন একত্ববাদী ধর্ম তথা ইহুদি, খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মের কাছে পবিত্র শহর। আর এখানকার অসাধারণ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দেয়ার জন্যই ইউনেস্কো এই শহরটিকে সংস্থাটির বিশ্ব-ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করেছে। তার মতে বায়তুল মুকাদ্দাসের ঐতিহ্যকে বিচ্ছিন্ন বা ভাগ করা সম্ভব নয় এবং এই ঐতিহ্য কেবল কোনও একটি বিশেষ ধর্মের একক সম্পত্তি বলে দাবি করা হলে তাতে এ শহরের অখণ্ডতা তথা ঐক্য ক্ষুণ্ণ হবে।
তিনি বলেন, ইউনেস্কোর দায়িত্ব হল সহিষ্ণুতা ও ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধার প্রসার ঘটানো। আর এই দায়িত্ববোধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা অভিন্ন মানবজাতির অংশ এবং বিচিত্রময় এ বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হল সহিষ্ণুতা।
ইসলামী ইরান বায়তুল মুকাদ্দাসের ইহুদিকরণের বিরোধী ইউনেস্কোর ইশতেহারটির প্রশংসা করে বলেছে, এর ফলে এ শহরের ওপর ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের বাস্তবতা ও ইহুদিবাদীদের নানা অবাস্তব দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়েছে।  উল্লেখ্য, এর আগে ইউনেস্কো বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী বলে ঘোষণা করায় ফিলিস্তিনি মহলসহ নানা মহলে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। যদিও ইসরাইল জাতিসংঘের নতুন মহাসচিবের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সাম্প্রতিক এই ইশতেহারকে অকার্যকর করতে চায়, তা সত্ত্বেও ইউনেস্কো তার সাম্প্রতিক ইশতেহারটি বাস্তবায়ন করে ফিলিস্তিনে সংস্থাটির অতীতের নানা ভুলের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিবে বলে ন্যায়কামী বিশ্ব-জনমত আশা করছে। #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/২২
 

ট্যাগ