ইসলামী জ্ঞানের অমর নক্ষত্র শেখ মুফিদ
(last modified Tue, 29 Nov 2016 15:39:23 GMT )
নভেম্বর ২৯, ২০১৬ ২১:৩৯ Asia/Dhaka
  • ইসলামী জ্ঞানের অমর নক্ষত্র শেখ মুফিদ

খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের বিকাশ তথা প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের প্রসারে অমূল্য অবদান রেখে যারা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন শেখ মুফিদ তাঁদের অন্যতম।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের ধারায় প্রচারিত ইসলামী শিক্ষার সংরক্ষণ ও ক্রমবিকাশে অমূল্য অবদান রেখেছেন এই মহান আলেম।
মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন নো’মান শেখ মুফিদের প্রকৃত নাম। শেখ মুফিদ তাঁর উপাধি। তিনি ছিলেন হিজরি চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ও হিজরি পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধের শীর্ষস্থানীয় শিয়া মুসলিম আলেমদের অন্যতম। বারো ইমামি শিয়া মুসলিম মাজহাবের জন্য ইসলামী জ্ঞানের পুনরুজ্জীবন এবং শিয়া মুসলিম সংস্কৃতি ও বিধানের প্রসার-প্রচারে অমূল্য অবদান রেখেছেন শেখ মুফিদ। তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য কেবল শিয়া মুসলিম জগতেরই নয় অন্যান্য মুসলিম মাজহাবের বরেণ্য ব্যক্তিত্বদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে।
মজার ব্যাপার হল প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন নো’মানকে শেখ মুফিদ বলে অভিহিত করেছিলেন প্রখ্যাত সুন্নি আলেম কাজি আবদুল জাব্বার। আর এরপর থেকেই তার এই নামই ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ে। 
প্রখ্যাত হাদিসবিদ ও সুন্নি শাফিয়ি মাজহাবের বিশিষ্ট আইনবিদ ইবনে হাজার আসকালানি শেখ মুফিদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন অত্যধিক ইবাদাতকারী, সংযম-সাধক, তাহাজ্জদ নামাজি, বিনয়ী এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে অধ্যবসায়ী। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার কাছ থেকে উপকৃত হয়েছে।’
শেখ মুফিদের ছাত্র শেখ তুসি তার এই মহান শিক্ষক সম্পর্কে বলেছেন, মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন নো’মান ইমামি মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় চিন্তা-নায়ক। নিজের যুগে তিনি ছিলেন শিয়া মুসলমানদের আধ্যাত্মিক কর্তা ও নেতা। আইন ও কালাম শাস্ত্রে তিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর ছিল খুব ভালো স্মরণ-শক্তি ও যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাৎক্ষণিকভাবে সব ধরনের প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন। 
শেখ মুফিদ বাগদাদে ৫০ জন প্রখ্যাত শিয়া ও সুন্নি আলেমের কাছে পড়াশুনা করেছিলেন। ইতিহাসে এসেছে প্রখর মেধা ও সততার কারণে মাত্র ৫ বছর বয়সেই হাদিস বর্ণনার অনুমতি পেয়েছিলেন শেখ মুফিদ। শেখ সাদুক, ইবনে জুনাইদ ইসকাফি ও আবু গালিব জারারি ছিলেন বাগদাদে শেখ মুফিদের প্রখ্যাত শিক্ষকদের অন্যতম। 
সাইয়্যেদ মুর্তাজা ও শেখ তুসি শেখ মুফিদের দুই কৃতী ছাত্র। শেখ মুফিদ ছোট ও বড় ২০০টি বই লিখেছেন। তৎকালীন সমাজের নানা চাহিদা ও যুগ-জিজ্ঞাসার  জবাব পাওয়া যেত এসব বইয়ে। বইগুলো শেখ মুফিদ লিখেছেন অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সহজ ভাষায়। 

শেখ মুফিদের আগে শিয়া মুসলিম আলেমদের মধ্যে ফিক্‌হ বা আইন শাস্ত্র বর্তমান যুগের মত বিন্যস্ত ছিল না। বরং তাঁদের আইনের বইয়ে পবিত্র ইমামদের (আলাইহিমুসসালাম) কাছ থেকে বর্ণিত ইসলামী বিধান সংক্রান্ত হাদিসগুলোকেই সব সনদসহ হুবহু বর্ণনা করা হত। 
এইসব হাদিসের টেক্সট বা বাক্যের মূল অর্থের ওপর ইজতিহাদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণার কোনও ধারা তখনও শিয়া মুসলিম আইনবিদদের মধ্যে প্রচলিত হয়নি। আইনের ক্ষেত্রে হাদিসের বাহ্যিক অর্থকেই গুরুত্ব দেয়া হত। অবশ্য পরবর্তীকালে এইসব হাদিসের গণ্ডীর মধ্যেই সীমিত মাত্রায় ইজতিহাদ করার ও ফতোয়া দেয়ার ধারা চালু হয়। আর শেখ মুফিদই প্রথমবারের মত নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক প্রখরতার আলোকে ইসলামী আইন ব্যাখ্যার সুশৃঙ্খল মূলনীতি প্রণয়ন করেন। সাইয়্যেদ মুর্তাজা ও শেখ তুসিও এই ধারার অনুসরণ করেন। 

শেখ মুফিদ আকল্ বা বুদ্ধিবৃত্তিকে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে উচ্চতর আসন দান করেন এবং একে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ বোঝার অন্যতম উপায় বলে মনে করতেন। তাঁর মতে যে হাদিস বিবেক বা আকলের পরিপন্থী তা পরিত্যাজ্য। 
সেযুগে আহলে হাদিস বা উগ্র হাদিস-বাদীদের মোকাবেলায় আরেকটি উগ্র গ্রুপ ছিল (সুন্নি) মু’তাজিলা সম্প্রদায়। মু’তাজিলারা মনে করত কেবল আকল্ দিয়েই ধর্মের সব বিষয় বোঝা সম্ভব এবং আকল্‌ই এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। শেখ মুফিদ উগ্র হাদিস-বাদীদের বিভ্রান্ত চিন্তার বিরুদ্ধে যেমন কঠোর জ্ঞানগত অবস্থান নেন তেমনি তুলনা বা কিয়াসকে বিধান আহরণের মানদণ্ড মনে করার বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নেন। তিনি এই উভয় গ্রুপের মোকাবেলায় শক্তিশালী নানা যুক্তি তুলে ধরে কয়েকটি বই লিখেছেন।

শেখ মুফিদের মতে কেবল আকল্ দিয়েই ধর্মীয় বিশ্বাস ও ইসলামের বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত জ্ঞান তথা কালাম শাস্ত্রের সব কিছু বোঝা সম্ভব নয়। যেমন, আল্লাহর ইচ্ছা, শোনা ও দর্শনসহ এ জাতীয় গুণের বিষয়ে আকল্ কেবল ওহি ও নিষ্পাপ ব্যক্তিত্বদের বক্তব্যের সহায়তা নিয়েই সঠিক ধারণা অর্জন করতে পারে। অর্থাৎ ইসলামী আইন ও কালাম শাস্ত্রের ক্ষেত্রে শেখ মুফিদের পন্থাটি হল মধ্য পন্থা যাতে রয়েছে আকল্ ও বর্ণনার সমন্বয়। 
বর্তমান যুগে কুরআন ও হাদিস থেকে জটিল শরিয়তি বিধান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে   শিয়া মুসলিম মাজহাবের পন্থাগুলো আরও অনেক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ। আর এই অগ্রগতির প্রক্রিয়ায় যারা পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুফিদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। 
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইসলামী ফিকাহ’র বিষয়গুলোকে বিজ্ঞান-সম্মত করার ক্ষেত্রে শেখ মুফিদের পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, 
‘এই মহান শেখ তথা শেখ মুফিদ তাঁর সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তি দিয়ে এক্ষেত্রেও ক্রমবর্ধমান উন্নতি,  সাফল্য ও গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকা অগ্রগতিতে ভরা এক নতুন ইতিহাসের সূচনা করেন। কয়েক শতক ধরে কেবল মাসুম ব্যক্তিত্বদের কথা ও ইসলামী বর্ণনার বাহ্যিক টেক্সট বা পাঠের আলোকে ফতোয়া দেয়াকেই ইসলামী আইনের সূত্র বলে মনে করা হত। কিন্তু তিন শতক পর এই বিশাল সম্পদকে বৈজ্ঞানিক চিন্তার কাঠামোয় বিন্যস্ত করা ও এই উৎসগুলো থেকে ইসলামী বিধান আহরণ করার শিল্পময় ও সুশৃঙ্খল পন্থা উদ্ভাবন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।’ 

শেখ মুফিদ অন্যান্য ধর্ম ও ইসলামী মাজহাবের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে নানা সময়ে জ্ঞানগত বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এইসব বিতর্ক ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। বাগ্মিতা, প্রখর মেধা, সূক্ষ্মদর্শিতা ও গভীর জ্ঞানের পাশাপাশি তার সততা ও আন্তরিকতা ফুটে উঠেছে এইসব বিতর্কে। দর্শকরা ছাড়াও  এমনকি শেখ মুফিদের বিরোধীরাও তার এইসব দক্ষতা আর গুণের প্রশংসা করেছেন। বিরোধীদের সন্দেহের জবাব দেয়ার জন্য তিনি তাদের পুরো বইই মুখস্থ করতেন। 
 শেখ মুফিদ ছিলেন একজন সৎকর্মশীল ও নিজ লক্ষ্যে অবিচল ইস্পাত-কঠিন ইমানের অধিকারী ব্যক্তিত্বের দৃষ্টান্ত। তিনি রাতে খুব কমই ঘুমাতেন। কুরআন পাঠ, নামাজ ও দোয়া কিংবা ক্লাস নেয়ার মধ্য দিয়ে রাত কাটাতেন শেখ মুফিদ।  তিনি খুব বেশি দান করতেন ও রোজা রাখতেন। তাঁর আধ্যাত্মিক অবস্থানও ছিল অতি উন্নত।
ইমাম মাহদি (আ) শেখ মুফিদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু ইমামের নির্দেশে তিনি তা গোপন রেখেছিলেন এবং শেখ মুফিদের মৃত্যুর পরই তা অন্যরা জানতে পারেন। 
শেখ মুফিদ মারা যান হিজরি ৪১৩ সালে। তার দাফনের সময় উপস্থিত হয়েছিল ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ। এমনকি শেখ মুফিদের বিরোধীরাও অশ্রুসজল চোখে হাজির হয়েছিল তার দাফন অনুষ্ঠানে।

তার কয়েকটি বিখ্যাত বইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করা হল: 'আল-আমালি বা আল-মাজালিস', 'তাসিহ আল ইতিকাদাত', 'আওয়ায়িল আল মাকালাত', ' কিতাব আল ইরশাদ', 'আহকাম আন-নিসা' ও 'আল মুগ্বনিয়া' ইত্যাদি। #
 

ট্যাগ