জে. সোলাইমানির শাহাদাত বার্ষিকীতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে বক্তারা যা বললেন
(last modified Mon, 03 Jan 2022 13:43:49 GMT )
জানুয়ারি ০৩, ২০২২ ১৯:৪৩ Asia/Dhaka
  • জে. সোলাইমানির শাহাদাত বার্ষিকীতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে বক্তারা যা বললেন

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসি’র কুদস ফোর্সের সাবেক প্রধান লে. জেনারেল কাসেম সোলাইমানির দ্বিতীয় শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বিকেলে এক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এটির আয়োজন করে।

ওয়েবিনারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মতো ন্যায় দক্ষ সেনানায়ক সচরাচর পাওয়া যায় না। তিনি ছিলেন ‘সেল্ফ মেইড ম্যান’ ও ‘সেল্ফ মেইড জেনারেল’। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও মেধায় বলীয়ান ছিলেন। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়েই তিনি নিজেকে গঠন করেছিলেন এবং তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করে শাহাদাত বরণ করেছেন।

ওয়েবিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ রেজা নাফার বলেন, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি শাহাদাতের পর লক্ষ লক্ষ মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রামের অধিবাসী ও সাধারণ পরিবারের সদস্য। তিনি এটি নিয়ে গর্ববোধ করতেন। তিনি ২২ বছর ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কিন্তু তিনি নিজেকে একজন সৈনিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। এমনকি তাঁর অসিয়তনামায় তিনি তাঁর কবরের উপর সৈনিক পদবি লিখার জন্য বলেন। তিনি সামরিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তাঁর কারণেই আমেরিকার বড় বড় পরিকল্পনা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানসহ অনেক দেশ তাদের নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে জেনারেল কাসেম সোলাইমানির কাছে ঋণী। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই নামে কম্পিত ছিলেন। আর এজন্যই ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সরকারি সফরে থাকাকালীন তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন। কিন্তু এটি ছিল তার নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।

তিনি আরও বলেন, ৩ জানুয়ারি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর আমেরিকার সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই শুধু নয়, আমেরিকাবাসীও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্য থেকে মিত্রবাহিনী দ্রুত সরে যেতে বাধ্য হয়। আর ৮ জানুয়ারি ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আইন আল-আসাদে ইরানি হামলায় মার্কিনিরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় যা তারা গোপন করে যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে এটি প্রকাশ হয়ে পড়ে। আর বর্তমানে মার্কিনিদের এমন অবস্থা হয়েছে যে, বিশ্ববাসী আর তাকে সুপার পাওয়ার মনে করে না।

ওয়েবিনারে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর ড. সাইয়্যেদ হাসান সেহাত বলেন, জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটি ইতিহাসের পাতা থেকে বিস্মৃত হওয়ার কোনো ঘটনা নয়। তিনি ছিলেন এমন এক বীর যার যাকে নিয়ে কেবল ইরানিরা নয় বরং বিশ্বের সকল মানুষ গর্ববোধ করে। তিনি নিজ চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও প্রতিভার গুণে মুসলিম বিশ্বের আদর্শে পরিণত হয়েছেন। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর জানাযায় লক্ষ-কোটি ইরানির উপস্থিতি ইরানি জাতির ঐক্য, হৃদ্যতা ও সংহতিকে প্রকাশ করে। ইসলামি বিপ্লব এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে যার মাধ্যমে জেনারেল সোলাইমানির মতো ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। আর এ ধরনের ব্যক্তিত্ব সারা বিশ্বের সকল জাতির জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে রয়ে যায়।

রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগের সিনিয়র সাংবাদিক জনাব সিরাজুল ইসলাম বলেন, শহীদ কাসেম সোলাইমানি একজন আদর্শ সেনানায়কে পরিণত হয়েছিলেন যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তাঁর শাহাদাতের পর প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা দেখলে। কয়েকদিন ধরে সংবাদ ও টক শোগুলোতে তাঁর উপর আলোচনা চলতে থাকে। এসব আলোচনায় রাজনীতিক, কুটনীতিক বড় বড় ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করে তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখেন। পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা চোখে পড়ে না। মধ্যপাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন। আধিপত্যবাদী শক্তি ‘নিউ মিড্ল ইস্ট প্ল্যান’ সফল করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটাকে নস্যাৎ করে দেন জেনারেল সোলাইমানি। রাজনৈতিক, সামরিক সর্বদিক থেকে পরাশক্তির নীলনকশা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ান জেনারেল সোলাইমানি। যার কারণে তারা তাঁকে হত্যা করে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামালউদ্দিনের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে খুলনা ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টারের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়্যেদ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, আমেরিকা কর্তৃক আইএস তৈরি করার পেছনে সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে তারা অগ্রসর হয়। যাতে পাশ্চাত্যে ইসলাম ধর্মের প্রসার রোধ করা যায়। তারা আইএস সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের এমন একটি কদর্য রূপ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিল যাতে মানুষ ইসলামকে একটি পাশবিক ধর্ম হিসেবে মনে করে। দ্বিতীয়টি হলো আইএস সৃষ্টির মাধ্যমে ইসরাইলকে রক্ষা করা। আর তৃতীয়টি হলো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করা। তারা এ লক্ষ্যে ইরাকের মাধ্যমে ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। এরপর অবরোধ আরোপ করে।

তিনি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা বুঝতে পেরেছিলেন যে, যদি ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধ না করা হয় তাহলে ইরানের অভ্যন্তরে দায়েশের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। তাই জেনারেল সোলাইমানিকে তিনি দায়িত্ব দেন। জেনারেল সোলাইমানি শাহাদাতের চেতনা নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং বিজয় লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। মুসলিম জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার যে অপচেষ্টা পাশ্চাত্য চালিয়েছিল সেটার মোকাবিলায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে যে একক আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছিল সেটার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন জেনারেল সোলাইমানি। বর্তমান যুগের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও প্রাজ্ঞ রণবিশারদ ছিলেন এই মহান জেনারেল। তাঁর সৈনিক জীবন শুরু হয়েছিল ইরানের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের সময়। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। মধ্যপ্রাচ্যে তিনি রাহবারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুকে তিনি পরোয়া করেন নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু রাহবারের বক্তব্য অনুসারে জেনারেল সোলাইমানি মৃত্যুর পরও একই রকম আছেন। তিনি আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন।

দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র সাংবাদিক জনাব জামালউদ্দিন বারী বলেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রনায়ক ছিলেন জেনারেল সোলাইমানি। তিনি জীবনের দীর্ঘ সময় যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়েছেন। ইসলামি বিপ্লবে ইরানের যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে সেখানে জেনারেল সোলাইমানির মতো ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ইরানের সংঘাত ইসলামের সাথেই সংঘাত। তাই আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে না যেটি জাতিসংঘ কর্তৃক সংজ্ঞায়িত হওয়া উচিত ছিল। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো নিজেরাই সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা তৈরি করে বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণ করছে। মুসলমানদের উপর নির্যাতন চললেও সেটাকে সন্ত্রাসবাদ বলা হচ্ছে না, উপরন্তু মুসলিমদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। মহানবী (সা.) যে শান্তির ধর্ম প্রচার করেছেন সেই ধর্মকে সন্ত্রাসবাদী ধর্ম বলে অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠী তৈরি করেও ইসলামকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মিশন ছিল যেন তথাকথিত ইসলামি দলগুলো কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি করতে না পারে সেই পদক্ষেপ নেওয়া। আর তিনি সেই পদক্ষেপই নিয়েছিলেন।

মদিনাতুল উলুম মডেল ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুর রাজ্জাক বলেন, মুসলিম জাতির এক মহান সন্তানকে আমরা হারিয়েছি সেজন্য আমরা কষ্ট অনুভব করছি। এ হত্যাকাণ্ড ছিল মুসলিম জাতির সাথে চরম দুর্ব্যবহার। এটি সংঘটিত হওয়ার পেছনে কাজ করেছে মুসলমানদের দুর্বল হয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ এ দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য প্রয়োজন মুসলমানদের মধ্যে একতা গড়ে তোলা। মুসলমানরা যদি অনৈক্য পরিহার না করে তবে আরো দুর্গতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ইমাম খোমেনীর যে দূরদর্শিতা ছিল সেটার মাধ্যমে তিনি বিপ্লব করেছিলেন, মজলুমদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বর্তমানেও জুলুম নির্যাতনের মোকাবিলায় ইরানি জাতির সেই সক্ষমতা রয়েছে। তারা সামনে থেকে মুসলিম জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

ওয়েবিনারে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করবেন বিশিষ্ট ক্বারী এ. কে. এম. ফিরোজ।#

 

ট্যাগ