সাদী ও হাফিজের হৃদয়ের ধ্বনিই আমরা নজরুলের কবিতায় পাই: ড. কাহদুয়ী
(last modified Sat, 29 Sep 2018 07:07:27 GMT )
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৮ ১৩:০৭ Asia/Dhaka
  • সাদী ও হাফিজের হৃদয়ের ধ্বনিই আমরা নজরুলের কবিতায় পাই: ড. কাহদুয়ী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কাযেম কাহদুয়ী বলেছেন, "শেখ সাদী মানবাত্মাকে আল্লাহর রঙ্গে রঙিন করার ও রাসুল (সা.) প্রেমের পরম প্রশান্তির পথে ধাবিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা প্রবেশ করেছে মানব হৃদয়ের গভীরে। সাদী ও হাফিজের হৃদয়ের ধ্বনিই আমরা বাংলাদেশের নজরুলের কবিতায় পাই।"

ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘নজরুল ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যেগে ইরানের কবি শেখ সাদী ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের কবিতা ও সাহিত্য কর্মের উপর এক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।  

ড. মোহাম্মদ কাযেম কাহদুয়ী বলেন, "আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালনে এসেছি। আজ থেকে ২৫ বছর আগে যখন প্রথমবার বাংলাদেশে আসি তখন ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলাম ইমাম সাহেব মুনাজাতে দরুদ, দোয়ার সাথে শেখ সাদী (রহ.)-এর বিখ্যাত চারলাইন নাত পাঠ করছেন ‘বালাগাল উলা বিকামালিহী, কাশাফাদদুজা বিজামালিহী, হাসুনাত জামীউ খিসালিহী, সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।‘ -এটা শুনে আমার খুব প্রশান্তি অনুভব হয়েছে।"

ফার্সি ভাষায় নজরুল গবেষক ড. মোহাম্মদ কাযেম কাহদুয়ী বলেন, "হাফিজের দিওয়ান নজরুল অনুবাদ করেছেন। নজরুল হাফিজপ্রেমিক ছিলেন বলেই তিনি তার ছেলের নাম রেখেছিলেন বুলবুল। এই বুলবুল যখন জন্মগ্রহণ করে তখন নজরুল দিওয়ানে হাফিজ অনুবাদের কাজও শুরু করেন একই দিনে। সবচেয়ে বেদনা ও মর্মপীড়ার বিষয় এটা যে, যখন এই দিওয়ান অনুবাদ শেষ হলো যেইদিন সেইদিন নজরুলের পুত্রসন্তান বুলবুলও ইন্তেকাল করল অসুস্থতায়।"

তিনি বলেন, "নজরুল ধুমকেতু পত্রিকা সম্পদনা করেন। নজরুল প্রচুর ফার্সি শব্দ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তখনকার অনেক কবি লেখক সমালোচক নজরুলের এইসব ফার্সি শব্দ বাংলায় ব্যবহারের সমালোচনা করলে বিশেষ করে নজরুল ফার্সি ‘খুন' শব্দটি প্রয়োগ করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন ফার্সি আমার প্রাণের শব্দ সেগুলো আমার কবিতায় আমি অবশ্যই ব্যবহার করব।"

ড. মোহাম্মদ কাযেম কাহদুয়ী বলেন, "শেখ সাদী (রহ.) শিয়াও নন আবার সুন্নিও নন। তিনি শিয়া সুন্নির মিশ্রিত রূপ ছিলেন। তিনি যেমন আবুবকর, ওমর, ওসমানের ওপর কবিতা লিখেছেন। তেমনি আলী, ফাতেমা, হাসান, হোসেনের ওপরও কবিতা লিখেছেন এবং তাদেরকে উছিলা দিয়ে দোয়া করেছেন। তারও ওপরে তিনি একজন মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন।"

তিনি বলেন, "ফেরদৌসী, রুমী, সাদী, হাফিজ ইরানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কবি। ইরানের এই চার কবি বাংলাদেশের জনগণের কাছেও প্রিয় ও পরিচিত। বিশেষ করে শেখ সাদী ও রুমী মিশে আছে বাংলাদেশের ধর্মীয় আবহের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।"

কবি আবদুল হাই শিকদার

‘শেখ সাদীর জ্ঞানের গভীরতা পিথাগোরাসের থেকে অনেক উপরে’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নজরুল গবেষক, শেকড় সন্ধানী কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, "শেখ সাদীর জ্ঞানের গভীরতা পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী পিথাগোরাস এবং টেনিশন থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে। শেখ সাদী মানবাত্মাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন আধ্যাত্মিক চেতনা দিয়ে। শেখ সাদী ও হাফিজের মধ্যে পার্থক্য হলো 'হাফিজ মানবাত্মার রোদনকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন পরমলোকে। আর সাদী পরমলোক থেকে আলো এনে মানব জীবনকে স্বার্থক করতে চেয়েছেন। শেখ সাদী (রহ.) আল কুরআনের মানবতাবাদী আয়াত (‘সকল বিশ্বাসী মানবমণ্ডলী এক দেহের মতো এর যেকোনো অংশে আঘাত লাগলে সমস্ত দেহে এর বেদনা অনুভূত হয়’) অনুযায়ী যে কবিতার লাইন রচনা করেন তা জাতিসংঘের সদর দরোজায় লিপিবদ্ধ আছে। শেখ সাদীসহ ইরানি কবিদের রচনার পরিচয় পেতে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ‘পারস্য প্রতিভা’ ও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘ইরানের কবি’ পড়তে হবে। শেখ সাদীর কবিতা বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। শেখ সাদী যেদিন এই ধরাধামে জন্ম গ্রহণ করেন সেই দিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেন বিখ্যাত অলি আবদুল কাদের জিলানী (র)। এ যেন এক সূর্যের অস্ত গিয়ে একই ভাবাদর্শের আরেক সূর্যের উদয়।"

আবদুল হাই শিকদার আরও বলেন, "শেখ সাদী (রহ.) অত্যাচারের প্রতিবাদে অনেক কবিতা লিখেছেন। তিনি জালিম শাষকদের অত্যচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যখন ডাকাত হালাকু- মঙ্গোলরা বাগদাদ নগরী দখল করে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। বিশ লক্ষ লোকের মাঝে ষোল লক্ষ লোককেই তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তিনি এই হত্যকাণ্ড দেখে প্রচণ্ডভাবে বেদনাহত হন এবং বাগদাদ ছেড়ে মক্কায় চলে আসেন।"

কবি আবদুল হাই শিকদার প্রাসঙ্গিকভাবে বলেন, "ইরানের সাহিত্যের মতো ইরানি জাতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনাও শাণিত। এ জাতি ঐক্যবদ্ধ জাতি। ইরান অস্তিত্বহীন হলে মুসলমানদের আর কিছুই থাকবে না। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সাহিত্যেও আমরা পাই ব্রিটিশ সাম্রারাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা। আমরা ইরানি জাতিকে সমর্থন করি। ইরানের মার্কিন সাম্রাজ্যাবাদ বিরোধী চেতনাকে সালাম জানাই। আমরাও ইহুদি যায়নবাদের প্রতি ধিক্কার জানাই।"

এরশাদ মজুমদার

‘সাদীর সাহিত্য আমাদেরকে মানবতাবাদী হতে বলে’

প্রবীণ সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার বলেন, "সাদীর সাহিত্য আমাদেরকে খাঁটি মানুষ ও মুসলমান হতে বলে; সেইসাথে মানবতাবাদী হতে বলে। কথা প্রসঙ্গে তিনি ধর্মদ্রোহিতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামীর সীমাবদ্ধতা উভয়ের সমালোচনা করেন। শেখ সাদীর তাসাউফ যুক্ত সাহিত্য মানুষকে আল্লাহর রঙে রঙিন করতে চায় ও ইনসানে কামেল হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু আজকে মানুষের কথা ও কাজের কোন মিল নেই। সৃষ্টির সেরা মানুষ আজ তাদের স্বভাব চরিত্রে পশুত্বকে হার মানিয়েছে। মানুষের ভেতর ঢুকে পড়েছে মুনাফেকি ও স্ববিরোধিতা।"

‘শেখ সাদীর কবিতা জং ধরা আত্মাকে মরিচামুক্ত করতে সহায়তা করে’

লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহসানুল হাদী অনুষ্ঠানের বক্তাদের বক্তব্যকে বাংলা থেকে ফার্সি ভাষায় এবং ইরানি বক্তাদের ফার্সি বক্তব্যকে বাংলায় ভাষান্তর করেন। এছাড়া তিনি তার বক্তব্যে বলেন, "কবিদের কবিতায় অফুরন্ত এক জীবনী শক্তি লুকায়িত থাকে যা যুগ যুগ ধরে আলো বর্ষণ করে। সেই আলোকে গ্রহণ করে মানব সমাজকে পশু সমাজের থেকে পৃথক করা হয়। শেখ সাদীর কবিতা জং ধরা আত্মাকে মরিচামুক্ত করতে সহায়তা করে।"

আহসানুল হাদী

‘শেখ সাদী তাঁর রচনায় ধর্মের প্রকৃতরূপ তুলে ধরেছেন’

নয়া সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক একরামুল ইসলাম বলেন, "ধর্মের প্রকৃত রূপ কখনো উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। শেখ সাদী তাঁর রচনায় ধর্মের প্রকৃতরূপ তুলে ধরেছেন। ইসলামের জিহাদ আর উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ এক জিনিস নয়। ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ, বোমা মেরে অতর্কিতে মানুষ মারা ইহুদি যায়নবাদীদের ফিলিস্তিনি হত্যা, বর্মী নাসাকা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা হত্যা একই অপরাধ। ইসলামের বিজয় হচ্ছে নৈতিক বিজয়। সেটা শেখ সাদীর মতো আল্লাহর খাঁটি বান্দাও রাসুল (সা) প্রেমিকদের দ্বারাই হয়েছে।"

‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরান সবসময়ই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে’

কবি ও আবৃত্তি শিল্পী আহমদ বাসির বলেন, "হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে ইরানের। আর পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানই সারা বিশ্বে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসার ঘটাতে সর্বদা তৎপর। বিভিন্ন দেশে আরব রাষ্ট্রগুলোর কোন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। ইরান ইসলামী বিপ্লব করেছে। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চেতনা মিলে মিশে যে আত্মবিশ্বাস ইরানি জাতির মধ্যে তৈরি হয়েছে সেই আত্মবিশ্বাসই তাদের সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিজয়ী করেছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সব সময়ই ইরান প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের সাথে শেখ সাদীর বড় মিল উভয়ই রাসুলের (সা) শানে নাত লিখেছেন। শেখ সাদী ও রুমির কবিতার ভেতর যে অফুরন্ত শক্তি রয়েছে সেটা আত্মোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।"

নজরুল-ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সংস্কৃতিসেবী জাহিদুর রহমানের উপস্থাপনায় উক্ত অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সিলর সাইয়েদ মাহদি হুসাইনি ফায়েক, নয়া সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ড. মুহাম্মদ একরামুল ইসলাম, কবি ও আবৃত্তিকার আহমদ বাসীর, কবি শাহ সিদ্দিক, মাহবুব মুকুল। শেখ সাদীকে নিবেদিত কবিতা পড়েন কবি আমিন আল আসাদ ও কবি রহমান মাজিদ। #

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৯

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ