করোনাভাইরাস মোকাবিলা
পোশাক শ্রমিক ছাটাইয়ের ঘোষণা বিজিএমইএ’র: বিভিন্ন মহলের ক্ষোভ
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে বংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানায় চলতি মাস থেকে শ্রমিক ছাটাইয়ের ঘোষণায় শ্রমিকদের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক মহল এ ঘোষণাকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল বা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মতলব বলে মনে করছেন।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শ্রমিক ছাটাইয়ের এ ঘোষণা দেন। এ সময় রুবানা হক জানান, ‘জুন থেকে শ্রমিকদের ছাঁটাই হবে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা। কিন্তু করার কিছু নেই। কারণ, শতকরা ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটিতে ফ্যাক্টরি চলছে। আমাদের ছাঁটাই ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
এ প্রসঙ্গে সরকার সমর্থক বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগ-এর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি রেডিও তেহরানকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক ছাটাই বা বেতন পরিশোধ না করে কারখানা বন্ধ করে দেবার ঘটনা ঘটছিল গত দুমাস ধরেই। কিন্তু হঠাৎ করে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কারণে শ্রমিকদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিক ছাটাইয়ের এ সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকরা মেনে নেবে না।
তিনি দাবি করেন, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই পোশাক শিল্পকে রক্ষা করার স্বার্থে এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণ নিরসন করে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।
ওদিকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে পোশাক শ্রমিকেরা মালিকদের জন্য মুনাফা আর রাষ্ট্রের জন্য বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের সুযোগ করে দিতে এগিয়ে এসেছে। সরকার মালিকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনাও বরাদ্ধ করেছে। এ অবস্থায় শ্রমিক ছাঁটাই করার ঘোষণা অত্যন্ত অমানবিক কাজ এবং দেশের প্রচলিত আইনেরও পরিপন্থি।
সাইফুল হক মনে করেন আসন্ন বাজেটকে সামনে রেখে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা আদায় করার কৌশল হিসেবেও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিষয়টি প্রচার করা হতে পারে। তবে রপ্তানি আয়ের এ বিরাট খাতকে শ্রমিক আসন্তোষের মুখে ঠেলে দিতে না চাইলে সরকারকে অবশ্যই দ্রুত মালিকদের এরকম খামখেয়ালি তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও উসকানিমূলক: জাসদ
ওদিকে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হকের শ্রমিক ছাঁটাই বিষয়ক বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও উসকানিমূলক’ বলে আভিহিত করেছেন।
গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে জাসদের নেতৃদ্বয় উল্লেখ করেন বৈশ্বিক ও জাতীয় দুর্যোগের মধ্যে কীভাবে শিল্প কল-কারখানা চলবে, শ্রমিকদের চাকরি ও জীবিকা রক্ষা হবে তা নিয়ে দেশে সরকারসহ অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সম্প্রদায়ও সচেতন আছেন এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সরকার শ্রমিকদের বেতনের জন্য ৫,০০০ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। ইইউ ৪৯০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা বাতিল হওয়া রপ্তানি কার্যাদেশ পুনর্বহাল করেছেন।
এরকম অবস্থায় রুবানা হকের অসত্য তথ্য দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের হুমকি দেয়া পরিস্থিতি ঘোলাটে করার রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও উসকানি ছাড়া আর কিছুই না।
তারা বলেন, দুর্যোগকালে শ্রমিক ছাঁটাই করা যায় না। এ ব্যাপারে আইএলও কনভেনশনসহ সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইন আছে। সরকারের সাথে কোনো সমন্বয় ছাড়া রুবানা হকের যা ইচ্ছা তাই বলার কোনো এখতিয়ার নাই। বিজিএমইএর সভাপতি বা কারখানার মালিক হওয়া মানে শ্রমিকদের বা দেশের মালিক হওয়া নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর আগে সরকারের সাথে কোনো সমন্বয় ছাড়া রুবানা হক নিজের ইচ্ছেমতো কারখানা একবার খোলা, একবার বন্ধ করার ঘোষণা দিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে অবর্ণনীয় অমানবিক দুর্দশার মধ্যে ফেলেছিলেন। রুবানা হকের শ্রমিকদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করতে হবে।
জাসদ নেতারা শ্রমিকদের নিয়ে মালিকদের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে সরকারের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ও অবস্থান ঘোষণার দাবি জানান।
কোনো অজুহাতেই পোশাক শ্রমিকদের ছাঁটাই করা যাবে না: নাগরিক ঐক্য
করোনা মহামারীর মধ্যে পোশাক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণায় নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে নাগরিক ঐক্যে।
সংগঠনের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেছেন, বছরের পর বছর ধরে যে শ্রমিকদের শ্রমকে পুঁজি করে এই পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, সেই শ্রমিকদের এই দুঃসময়ে কর্মহীন করা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোনো অজুহাতেই পোশাক শ্রমিকদের ছাঁটাই করা যাবে না।
মান্না বলেন, বিজিএমইএ সভাপতি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এখনো ১৮ হাজার শ্রমিকের কয়েক মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। শ্রমিকদের জন্য তহবিল গঠনের জন্য সরকারের সঙ্গে বসা হবে। শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ কি যথেষ্ট ছিল না? সে বিষয়ে তো আপনারা কিছু বলছেন না। তিনি দাবী করেন, প্রত্যেক শ্রমিকের বকেয়া বেতন চলতি জুন মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। যারা ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন, তাদের শ্রম আইন অনুযায়ী বেতন বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের পুনঃনিয়োগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এই সব বিষয়ে পোশাক কারখানা মালিকদের সহযোগিতা করার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় পোশাক খাতের এই অস্থিরতা যে পরিস্থিতি তৈরি করবে তা সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।