ঈদের ছুটি শেষে ১৪ দিনের দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউন: বিভিন্ন মহলের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
ঈদ-উল-আজহার ছুটি শেষে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা প্রসঙ্গে শিল্পমালিকগণ প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে চিঠি পাঠিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেছেন, এ সময় শিল্পকারখানা বন্ধ রাখলে অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে, শিল্পমালিকদের আপত্তিকে উপেক্ষা করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন আজ শনিবার ( ১৭ জুলাই) গার্মেন্ট ও শিল্পকারখানা বন্ধের বিষয়ে সরকারের আগের সিদ্ধান্তই পুনরুল্লেখ করেছেন।
আজ শনিবার (১৭ জুলাই) দুপুরে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবির ৯৬তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী জানান, ২৩শে জুলাই থেকে ১৪ দিনের লকডাউন আরো কঠোর হবে। ঈদের আগে আট দিন বিধিনিষেধ শিথিলের ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই সময়ে চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ শিথিল করলেও আমরা স্বাস্থ্যবিধি কিন্তু শিথিল করিনি। আমরা চাই, প্রত্যেকটি মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। সবাই মাস্ক পরে এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে চলে, বিনা প্রয়োজনে কেউ বাইরে আসবে না, ঘরে থাকে।’
এফবিসিসিআই কলকারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়েছে
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) কোরবানির ঈদের পর দেশে লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ ফের চালু করা হলেও সে সময় শিল্প কলকারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়েছে।
শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধে সব ধরনের শিল্প কারখানা চালু রাখার আহ্বান জানান।
সংগঠনের সভাপতি বলেন, বিধিনিষেধের মধ্যে সব ধরনের শিল্প কারখানা বন্ধ রাখা হলে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিঘ্নিত হবে। এতে উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিশেষ করে, খাদ্যসামগ্রী, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, বোতলজাত পানীয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন বন্ধ থাকলে সাধারণ ভোক্তারা সমস্যায় পড়বেন। পণ্যসামগ্রী সঠিকভাবে সরবরাহ ও বাজারজাত না হলে পণ্যের মূল্য বাড়বে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ বিপদে পড়বে। পাশাপাশি তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাতে ক্রয়াদেশ হারাতে হবে।
তিনি বলেন, রপ্তানি খাতের কারখানা বন্ধ থাকলে নির্ধারিত সময়ে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে না। এতে রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা তৈরি হবে। ঈদের ছুটিসহ প্রায় ১৮ থেকে ২০ দিন কারখানা বন্ধ থাকলে গ্রীস্ম ও বড়দিন এবং আগামী শীতের বস্ত্র খাতের ক্রয়াদেশ হাতছাড়া হতে পারে। এক মাসের রপ্তানি শিডিউল বিঘ্নিত হলে পরবর্তী ছয় মাসের রপ্তানি শিডিউলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেইসঙ্গে উৎপাদন বন্ধ থাকলে আমদানি করা কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এতে আমদানিকারক ও উৎপাদক উভয়ই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া ক্ষুদ্র ও ছোট কারখানা লম্বা সময় বন্ধ রাখা হলে উদ্যোক্তারা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন। এমনকি কারখানাগুলো পুনরায় চালু করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ইতোমধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, প্লাস্টিক গুডস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ টেরি-টাওয়েল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ রপ্তানি ও উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারগুলো শিল্প-কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য শীর্ষ এ সংগঠনকে অনুরোধ জানিয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কঠোর বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে ওষুধ কারখানার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। যদি ওষুধ কারখানা বন্ধ রাখা হয়, তাহলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। অপরদিকে ট্যানারি বন্ধ রাখা হলে কোরবানির ঈদে সংগ্রহ করা চামড়া সংরক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হবে।
জসিম উদ্দিন বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে জীবনরক্ষাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা হলে খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেবে। সে জন্য ঈদের পর দুই সপ্তাহের কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও সব ধরনের শিল্পকারখানা চালু রাখা প্রয়োজন।
শতাধিক রপ্তানি আদেশ স্থগিত
এদিকে, লকডাউনে শিল্প-কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণায় তৈরি পোশাকের শতাধিক রপ্তানি আদেশ স্থগিত হয়ে গেছে এবং অনেক কারখানার রপ্তানি আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এমনকি, যেসব ব্র্যান্ড ও ক্রেতার সঙ্গে রপ্তানি আদেশের বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে ছিল সেগুলো আপাতত বন্ধ।
দেশের অন্তত ১০টি কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে আজ (১৭ জুলাই) এরকম একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকা।
এর মধ্যেই ঈদের পর কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাসহ সব ধরনের শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকার খবর প্রকাশের পরপরই বিদেশী ক্রেতারা তাদের উদ্বেগ জানিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ইমেইলে, ফোনে যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান জানিয়েছেন, এরই মধ্যে শতাধিক কারখানার রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে গেছে। অনেক ক্রেতা কেবল হাতের কাজটিই কোনো রকমে উঠিয়ে দিতে বলেছেন। বাড়তি কাজ আর দিচ্ছেন না।
নিজের কারখানার উদাহরণ দিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, জায়ান্ট গ্রুপের কারখানায় মার্কিন ব্র্যান্ড ওয়ালমার্টের রপ্তানি আদেশের কাজ চলছিল। আরও কাজ নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই ব্র্যান্ড প্রতিনিধিরা হাতের কাজ আগে শেষ করতে বলেছেন। বাকি রপ্তানি আদেশের আলোচনা স্থগিত আছে। উল্লেখ্য, তৈরি পোশাক দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। মোট রপ্তানি আয়ে সমজাতীয় পণ্য মিলে পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশ। ৩৬ লাখ শ্রমিক কাজ করে এ খাতে। বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আগের অর্থবছরের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বেশি হয়েছে ১৩ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক।
গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ
ওদিকে, গাজীপুরের তিন সড়ক এলাকায় স্টাইল ক্রাফট পোশাক কারখানায় বকেয়া বেতনের দাবিতে আবারো আন্দোলনে নেমেছে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। দাবি আদায়ের লক্ষে শনিবার (১৭ জুলাই) সকালে কর্মবিরতি করে ঢাকা- গাজীপুর সড়ক অবরোধ করে তারা। দুপুর বারোটার দিকে বৃষ্টি নামলে শ্রমিকরা সড়ক ছেড়ে দিলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারখানা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এছাড়া সড়ক অবরোধের কারণে বিকল্প সড়কে যানবাহন চলাচল করে।
পুলিশ ও কারখানার শ্রমিকরা জানান, স্টাইল ক্রাফট কারখানার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৭০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ৭ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। এছাড়া অন্তত চার হাজার শ্রমিকের চলতি মাসের বকেয়া বেতন পাওনা রয়েছে। কয়েকদিন ধরে আন্দোলন চললে ও মালিক পক্ষের সাথে বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ নিয়ে কোনো সমাধান না হওয়ায় শনিবার সকাল আবারো আন্দোলনে নেমে সড়ক অবরোধ করে শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। শিল্প-পুলিশ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে কয়েক দিন ধরেই আন্দোলন করছে শ্রমিকরা। মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/ বাবুল আখতার/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।