'ইরানের পথে-প্রান্তরে' বইয়ের পাতায় ইরান দেখা
(last modified Sun, 14 Nov 2021 12:13:44 GMT )
নভেম্বর ১৪, ২০২১ ১৮:১৩ Asia/Dhaka
  • ইরানের পথে-প্রান্তরে বই হাতে রিভিউ লেখক জাহানুর রহমান খোকন
    ইরানের পথে-প্রান্তরে বই হাতে রিভিউ লেখক জাহানুর রহমান খোকন

ইসলাম ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতার সম্রাজ্য ইরান। সেই ইরানের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি কালচার নিয়ে রচিত গ্রন্থ 'ইরানের পথে প্রান্তরে'।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুমিত আল রশিদ রচিত বইটিকে আপনি কোন ক্যাটাগরিতে ফেলবেন সেটা নিয়ে যদিও একটু দ্বিধায় পড়ে যাবেন। তবুও বইটি ভ্রমণ পিপাসু পাঠক মনে নির্দ্বিধায় জায়গা করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।

তবে কি 'ইরানের পথে-প্রান্তরে' বইটি ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ? পাঠক মনে প্রশ্ন জাগবে। না বইটিকে শুধু ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ বললে ভুল হবে। বইটির প্রতিটি পাতায় পাতায় রয়েছে ইরানের বিভিন্ন কৃষ্টি কালচার ও ইতিহাসের বর্ণনা। তাহলে কী বইটি ইতিহাসের বই? না গ্রন্থটি ইতিহাসের নয়। বরং 'ইরানের পথে-প্রান্তরে' গ্রন্থটি লেখকের ইরান ভ্রমণের দিনলিপির সমন্বয়ে ইরানের রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনীতি, ভৌগোলিক বর্ণনা ও ইতিহাসের মিশেলে অনন্য সাহিত্য রত্ন হিসেবে রচিত গ্রন্থ বলা যায়।

ধরুন আপনি বসে আছেন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম শহরের ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত একটি দ্বীপ চরে। আর আপনার হাতে একটি গ্রন্থ, নাম 'ইরানের পথে-প্রান্তরে'। তখন আপনাকে আর বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না বরং ঐ সময়ে বইটির লেখনি বর্ণনা শক্তির বদৌলতে আপনার আত্মা হেঁটে বেড়াচ্ছে প্রাচ্যের মরুভূমির শহর পাড়ি দিয়ে বায়জিদ বোস্তামীর সমাধি কিংবা শিরাজিদের সোনালী আঙ্গুর ক্ষেতে। কেমন হবে?

জানতে হলে পড়তে হবে 'ইরানের পথে-প্রান্তরে' গ্রন্থটি।

কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটিকে ৩৪ টি ছোট ছোট পরিচ্ছেদ কিংবা প্রবন্ধে সাজানো হয়েছে। যার প্রথম প্রবন্ধটি হলো নাম প্রবন্ধ 'ইরানের পথে-প্রান্তরে'।

যেখানে ইরানকে বাংলাদেশের থেকে ১২ গুণ বড় আয়তন বর্ণনার পাশাপাশি ইরানের ভৌগোলিক অবস্থানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে নিখুঁতভাবে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা যা রাজধানী তেহরানের উত্তরে অবস্থিত। আর এই পর্বতমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ দামাভান্দ যাকে ঘিরে রচিত হয়েছে ইরানের অসংখ্য সাহিত্য। ইরানে অপর প্রান্তে জাগরোস নামের অন্য একটি পর্বতমালা রয়েছে। এই পর্বতমালার পাদদেশেই খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ অব্দে খুজিস্তান প্রদেশের শুশ নগরীতে ইরানের সর্বপ্রাচীন ইলামী সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে ইরানে মানব সভ্যতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পবিত্র কুরআন ও বাইবেলে উল্লেখ দাশতে কাভির ও দাশতে লুত মরুভূমি দুইটি এখানে অবস্থিত। ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ৯৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিরাজ নগরীতে অবস্থিত কবি হাফিজ শিরাজির সমাধি। যেখানে বসে এখনো প্রেমিক প্রেমিকারা কবির কবিতা আওড়ানোর পাশাপাশি অশ্রুসিক্ত হন ভালোবাসায়। তবে ইরান দেশের নাম শুনলে আমাদের যাদের মাথায় ভাসে জলকনা হীন মরুভূমির শহর তাদের জন্য রয়েছে অন্য খবর। ইরানের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে উঁচু নিচু পাহাড় ও ঝর্ণা। তেমনি একটি পাহাড়ি ঝর্ণার নাম রুকনাবাদ নদী। হ্যাঁ,  নদী। আমাদের দেশে যেমন তুরাগ নদী কিংবা বুড়িগঙ্গা নদী সহ অন্যান্য নদী দিনদিন সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, তেমনি কবি হাফিজ শিরাজির প্রিয় নদী রুকনাবাদ ঝিরঝিরে বয়ে চলা পাহাড়ি ছড়া। যেখানে বসে কবি রচনা করেছেন সেই বিখ্যাত কবিতা পঙক্তি-

''প্রাণে যদি দেয় ধরা মোর শিরাজের ঐ তুর্কি তম্বী মনচোরা,

প্রিয়ার কালো তিলের তরে- দেই বিলিয়ে সমরখন্দ ও এই বোখারা।''

ইরানের মধ্যে অবস্থিত খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট নির্মিত মসজিদের মিনারের মতো জেলখানাটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। মহাকবি হাফিজ শিরাজি এই জেলখানাটি নিয়ে লিখেছিলেন একটি অনবদ্য কবিতা-

''মন আমার ভীত সন্ত্রস্ত দেখে আলেকজান্ডারের জেলখানা

চলে যাব সোলায়মানের রাজ্যে এটাই হয়তো ভাগ্যের নির্মম লেখা।''

মহাকবি হাফিজের সমাধি কমপ্লেক্সে লেখক ড. মুমিত আল রশিদ

ইরানি জনগণ প্রাচীনকাল থেকেই সংগীতবোদ্ধা হিসেবে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত। তেমনি ইরানি জনগণ রসবোধে অসম্ভব রকমের। তাড়া সমকালীন যেকোন বিষয় নিয়ে উপস্থিত জোকস তৈরি করে ফেলতে পারেন। আর এই জোকসের মাধ্যমে একে অপরকে নাস্তানাবুদ করে ফেললেও উভয়ই প্রাণখুলে হাসেন। তেমনি একটি কৌতুক 'ইরানের পথে-প্রান্তরে' গ্রন্থ থেকে লেখকের ভাষায়-

পিতা ও পুত্রের কথোপকথন:

পিতা: আমাকে বেশি ভালোবাসিস, নাকি তোর মাকে?

পুত্র: দু'জনকেই

পিতা: যদি আমি আমেরিকা যাই এবং তোর মা ফ্রান্সে যায়, কার সঙ্গে যাবি?

পুত্র: ফ্রান্সে

পিতা: তার মানে, মাকে বেশি ভালোবাসিস!

পুত্র: নাহ! আমি ফ্রান্সকে ভালোবাসি।

পিতা: যদি আমি ফ্রান্সে যাই, আর তোর মা আমেরিকা যায়, কার সঙ্গে যাবি?

পুত্র: আমেরিকা

পিতা: কেন?

পুত্র: কেননা আমি আগে ফ্রান্সে গিয়েছিলাম।

পিতা: (রাগান্বিত হয়ে) নির্বোধ গাধা! এখন যদি আমি ও তোর মা একসঙ্গে ফ্রান্সে যাই, তুই কোথায় যাবি?

পুত্র: এখানেই থাকবো।

পিতা: এখন কী কারণে এখানে থাকবি?

পুত্র: যেহেতু আমি ক্লান্ত! কারণ কিছুক্ষণ আগে আমেরিকা ও ফ্রান্স থেকে ফিরলাম।

রাজধানী তেহরানেরবিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বড় বড় সিনেমাহল। অতিরক্ষণশীল এবং ধর্মীয় বিধি-নিষেধের মধ্যে থেকেও ইরানি চলচ্চিত্র বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বড় বড় পোস্টার ও নায়ক নায়িকাদের ছবিতে ছেয়ে থাকে চারপাশ।

'ইরানের পথে-প্রান্তরে' বই হাতে রিভিউ লেখক জাহানুর রহমান খোকন 

উল্লেখ যে, ড. মুমিত আল রশিদ অভিনীত ''পাঞ্জহ কিলো অ'লবা'লু'' সিনেমাটি ইরানি নববর্ষ উপলক্ষে সেখানে মুক্তি পেয়েছিল। লেখকের ভাষায়- "ইরানি চলচ্চিত্র এতো চমৎকার এবং সিনেমাহলসহ সেখানের পরিবেশ এতো সুন্দর যে, সেখানে প্রেমিক প্রেমিকা একসাথে বসে সিনেমা দেখে। সেখানে নেই বেহায়াপনা, নেই বখাটেপনা কিংবা ধর্মীয় উগ্রতা। বড় বড় রাস্তায় রাস্তায় বিশাল সব সিনেমার পোস্টার। ইসলামের নামে উগ্রতা, ধর্মান্ধতা, ফতোয়ার দৌরাত্ম্যে কি তাহলে আমাদের সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে?"

লেখকের এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ইরানি চলচ্চিত্র যে লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তা আপামর ইরানি মানুষের অন্তরে প্রোথিত হয়েছে। সর্বশেষ দশকে ইরানের বেশ কিছু চলচ্চিত্র অস্কার এবং আন্তর্জাতিক কান পুরস্কার পেয়েছে। তবে ১৯৯৭ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামির 'টেস্ট অব চেরি' চলচ্চিত্রের মানচিত্রে ইরানকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ইরানে প্রতি বছর গড়ে ১৩০ টির মতো চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।

ইরানের বেশ কিছু ঘরোয়া চলচ্চিত্র রয়েছে যেগুলো ইরানিদের একান্ত নিজস্ব। এই ঘরোয়া চলচ্চিত্র আবার দুই ধরনের। এক ধরণের ঘরোয়া চলচ্চিত্রে রয়েছে ধর্মীয় এবং জাতীয় শক্ত মোটিভস। আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে রয়েছে জনপ্রিয় অভিনেতাদের অভিনয় নির্ভর চলচ্চিত্র। এই দুই ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অজানা।

ইরানি চলচ্চিত্রের মধ্যে সবসময় ইতিহাস নির্ভর হয় এমনটা নয়, ইরানি চলচ্চিত্রে ফুটে উঠে সমাজে মাদকের ভয়াবহতা, বিবাহ বিচ্ছেদ, শরণার্থী সমস্যা, বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ বিগ্রহ, ধর্মীয় উগ্রবাদ। যা সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধানকেন্দ্রিক। বস্তুত এইসকল সমস্যা প্রায় বিশ্বের সকল দেশে একই রকম।

'ইরানের পথে-প্রান্তরে' বইটির একটি পরিচ্ছেদ সাজানো হয়ে জিভে জল আসা ইরানি খাবারের সমারোহে। ঐতিহ্যবাহী খাবারের দিক থেকেও ইরানভূমির অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইরানের শিরাজ শহরের বিখ্যাত খাবার ফালুদা। সাগুদানার উপর কিছু মিষ্টিজাতীয় দানা যুক্ত করে বলা হয় এটিই ফালুদা। লেখকের কাছে যদিও ফালুদা ভালো লাগেনি কিন্তু খা'মে নামক খাবারটি ভালো লেগেছে। খা'মে বাংলাদেশের বাটারবনের মতো হলে, তবে গোলাকার। ইরানিদের খাদ্যরসিক পরিচয় দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন, 'আপনি বাংলাদেশ থেকে ইরানের যেকোন দেশে পৌচ্ছামাত্র আপনার  ঘ্রাণেন্দ্রিয় সচল হবে মিষ্টি বা কাবাবজাতীয় খাবারের ম-ম করা সব ঘ্রাণে।'

ইরানের ছোট শহর থেকে বড় শহর কিংবা গলিপথের দোকানে দোকানে সাজানো থাকে বিভিন্ন সাইজের রুটি। লেখকের রুটির বর্ণনা পড়ে নুনে সাঙ্গাক রুটিটি আমার খাইতে ইচ্ছে করেছিল। ফারসি কথ্য ভাষায় নুন অর্থ রুটি আর সাঙ্গাক অর্থ ছোট পাথর। অর্থাৎ নুরি পাথরের ওপর ভাঁজা হয় যে রুটি, তার নাম নুনে সাঙ্গাক। ইরানের বড় উনুনে ভাজা হয় যে রুটি তাকে বলা হয় নুনে বারবারি। বড় উনুন মানে একটি উনুন বড় সাইজের একটি রুমের সমান।

তবে ইরানের ঐতিহ্যবাহী কাবাবের মধ্যে রয়েছে জুজে কাবাব। এটি ইরানে বেড়াতে আসা সব বিদেশিদের প্রিয় খাবার। এছাড়াও রয়েছে চেলু গোশত, কাবাবে কুবিদে। যা ইরানের প্রাচীন খাবারের একটি এবং মোরাচ্ছা পোলু, যেখানে মুরগীর মাংস ঝুরিঝুরি করে কেটে বাদামকুচি, আনারসের শুকনো দানাসহ ভাতের সাথে মিশিয়ে বানানো হয়। এছাড়া গিলান প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবার কাবাবে তোরশ। এটি বাচ্চা গরুর মাংস ও হরেক রকম টক বা আচার জাতীয় খাদ্য দিয়ে তৈরি করা হয়। বইটি পড়ার পাশাপাশি এইসব খাবার আমার চোখের সামনে দৃষ্টিগত হচ্ছিলো। আমি কাবাবে তোরশ সম্পর্কে খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছি তবে বাচ্চা গরু অর্থাৎ কত বছরের গরু বর্ণনা না থাকায় খাবারটি বইয়ের পাতায় এবং আমার স্মৃতিপটে থেকে গেল। ইরানের আরো কিছু কাবাব বিখ্যাত বলে লেখক বইটিতে উল্লেখ্য করেছেন। যেমন- কাবাবে বারগ ও সুলতানি, কাবাবে দুশ, কাবাবে বখতিয়ারি। ইরানের বড় বড় স্কয়ার ও মেট্রো স্টেশনগুলো ঘিরে ফালাফেল নামক একপ্রকার বার্গার জাতীয় খাবার দেখা যায়। এটি আরবদের খাবার হলেও বর্তমানে দুপুরের খাবারের বিকল্প হিসাবে ভ্রমণকারী ও ইরানিদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে। খাবারটি তুলনামূলক সস্তা ও তৃপ্তিদায়ক। এগুলো ভোজন রসিকদের কাছে সমাদৃত হলেও বাঙ্গালি ঝোল খাওয়া বাবুদের জন্য বিশেষ একটি পদ রয়েছে। খোরেশত গ্বেইমে। এখানে ঝোলের সাথে মাংসের কয়েকটি টুকরা থাকে।

যাই হোক ঝোলের কথা যখন বললাম তখন ইরানের স্যুপ নিয়ে একটু বলি। লেখকের ভাষায়, 'ইরানের স্যুপের কথা না বললে ইরানের কোন খাবার দিয়েই এ লেখা পরিপূর্ণতা পাবে না।'

ইরানের মূল ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে একটি হলো স্যুপ। ইরানের ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় বিভিন্ন জায়গায় এই স্যুপের বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতা রয়েছে। অ'শে রেশতে। এক ধরণের দুগ্ধজাত দ্রব্য, শিমের বিচি, বুটের ডাল ও বিভিন্ন প্রকার ছোলা দিয়ে তৈরি স্যুপ। ইহা পুরা ইরানে প্রসিদ্ধ।  অ'শে তোরশ হলো টক জাতীয় স্যুপ। তবে বাংলাদেশের বোরহানী বা মাঠার মতো দেখতে এবং খেতে টক এক ধরনের খাবার রয়েছে ইরানে। একে বলা হয় দুগ। পুদিনাপাতাসহ বিভিন্ন রকম ভেষজ মিশিয়ে তৈরি করা হয় দুগ।

ইরানি জনগণ যে শুধু ভোজনরসিক তা নয়, তারা প্রচণ্ড রকমের উৎসব মুখর থাকতে ভালোবাসেন। পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম লীলাভূমি ইরান। সেই সাথে এই জাতি লৌকিক ঐতিহ্য ও আচার, কালচারের প্রাচীনত্বের দাবিদার। ইরানি জনগণের মূল উৎসব নওরোজ বা নববর্ষ।  তবে নববর্ষ শুরুর আগের মঙ্গলবার বিকেলের পর বুধবার সন্ধ্যা শুরু হয়। যাকে ফারসিতে বলা হয় চাহার শাম্বে সুরি উৎসব। ইরানের চাহার শাম্বে সুরি উৎসবে অগ্নি প্রজ্বলন করা হয় বাড়ির আঙ্গিনায়। বাড়ির ছেলে-মেয়ে থেকে সবাই সেই অগ্নিকুণ্ডের উপর দিয়ে লাফ মারে যাতে দেহের নিস্তেজতা, বিবর্ণতা দূর হয়। ইরানের প্রাচীন সম্রাট জামশিদের (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ) আমল থেকেই এই উৎসবটি পালিত হচ্ছে। চাহার শাম্বে সুরি ইরানের নওরোজকে স্বাগত জানানোর একটি অন্যতম উৎসব। আরবরাও চাহার শাম্বে সুরিকে অমঙ্গলজনক অলুক্ষণে ও নিরানন্দের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। জা'হায তার আল মোহাসেন ওয়া আল আযদাদ বইয়ে লিখেছেন, 'বুধবার হচ্ছে অলুক্ষণে ও দুঃসহ একটি দিন।' বিখ্যাত ফারসি কবি মনুচেহর দা'মেগানি চাহার শাম্বে সুরি নিয়ে আরবদের বিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছেন,

'বালা-মুছিবতের চাহার শাম্বেতে শরাবে হও বিভোর

পান করো আঙুরের মদ, তাতেই হোক সুস্থ-সালামত।'

নওরোজ উৎসবকে কেন্দ্র করে ইরানে ১৫ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। ১৩ তম দিনটিকে ইরানিরা মনে করে অপয়া সংখ্যা। তাই এই সংখ্যাটিকে জাগ্রত করতে ইরানিরা সেদিন বাড়ির বাইরে অবস্থান করে।

শাবে ইয়ালদা

২১ ডিসেম্বর শীত ঋতু শুরু করার আগের রাত্রিতে ইরানিরা আরো একটি উৎসব পালন করে থাকে। তা 'শাবে ইয়ালদা' নামে পরিচিত। এই রাত্রিটিকে তারা কালোরাত্রি হিসাবে মনে করেন। ফার্সি ইয়ালদা অর্থ সর্ববৃহৎ। বছরের এই রাত্রিটি দীর্ঘতম রাত্রি হওয়ায় তারা সারারাত জেগে কাটান। ছেলেমেয়েরা নানাবাড়ি দাদাবাড়িতে অবস্থান করেন। সেখানে শিমবিচি, লাউয়ের বিচি, সূর্যমুখী দানা, কুমড়া বিচি জাতীয় খাবার খেয়ে সারারাত গল্প করে কাটিয়ে দেন। তবে বর্তমানে শাবে ইয়ালদা বা সূর্যের জন্মোৎসব রাত্রি হিসেবেই এটি বেশি জনপ্রিয়। গজলসম্রাট হাফিজ শিরাজি তাঁর গজলে শাবে ইয়ালদাকে এভাবে তুলে ধরেছেন-

''ভণ্ড স্বেচ্ছাচারী শাসক আর অন্ধকারাচ্ছন্ন শর্বরী

দ্বারে আলোকবর্তিকা হাতে সূর্যছানা যেন ডানা মেলা পরী!''

কবি এখানে সূর্যকে ডানা মেলা পরীর সাথে তুলনা করেছেন। এবং সূর্যছানার নিকষকালো অন্ধকার ভেদ করে আসবার কথা বলেছেন। তাইতো ইরানিরা এই রাত্রিতে সারারাত বসে থেকে জেগে কাটান। এই রাত্রিতে ইরানিরা তরমুজ খেতে পছন্দ করেন। মহাকবি হাফিজ শিরাজের কাব্য সংকলন এ রয়েছে ভাগ্যের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। তাই এই রাত্রিতে কবির কাব্য সংকলন নিয়ে ভাগ্য গণনা করে কাটিয়ে দেন অনেকেই। কোথাও আবার মহাকবি ফেরদৌসীর শাহনামা থেকে শুর করে পাঠ চলে সারারাত।

ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে দেশটিতে চলে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। নির্বাচনের দিনটিকে তারা জাতীয় উৎসবের দিন হিসেবে ঘোষণা করেছেন। জনগণ নিজেরাই ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরে নেচে গেয়ে ভোটকেন্দ্রগুলোতে যান ভোটারদের বিনোদন দিতে। ইরানের নির্বাচনকেন্দ্রীক লেখকের বই থেকে দুইটি জিনিস আমার ভালো লেগেছে তার একটি হলো বিজয়ী প্রার্থী যদি ৫০ শতাংশের কম ভোট পান, তবে এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বার ভোট গ্রহণ হবে। অন্যটি হলো নির্বাচনের রাতেই রাস্তাঘাট সব জায়গা থেকে নির্বাচনী পোস্টার, ব্যানার খুলে শহরকে ঝকঝকে করে ফেলা হয়। ইস! আমাদের দেশে কবে যে এরকম পোস্টারের শহরের খ্যাতি থেকে রক্ষা পাবে!

ইরানিদের শিষ্টাচার নিয়ে প্রায়ই বিদেশি পর্যটকরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। ইরানি জনগণ শিষ্টাচারের দিক অনন্য সাধারণ। এখানে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারী, পিয়ন দারোয়ান, এমনকি ছোটদের সাথে বড়দের আচরণ চোখে পরার মতো। ধরুন আপনি ট্যাক্সি করে কোথাও ঘুরতে গেছেন কিন্তু যখন ভাড়া দিতে যাবেন তখন ট্যাক্সি চালক বিনয়ের সাথে বলবে কা'বেল নাদা'রে অর্থাৎ আপনি যতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করেছেন তা আসলে তেমন কিছুই নয়। জনাব, ভাড়ার তুলনায় যাত্রাপথ খুবই নগণ্য! আবার ধরুন আপনি শপিংমলে গেছেন কেনাকাটা করতে, কেনাকাটা শেষে দোকানদারকে টাকা দিতে যাবেন, দোকানদার টাকা নিতে অপারগতা প্রকাশ করবে। লেখকের ভাষায়- দোকানদার বিনয়ের সাথে বলবেন, 'কা'বেল নাদা'রে অর্থ্যাৎ জনাব আপনি যেগুলো কিনেছেন সেটা খুবেই নগণ্য! টাকাগুলো ঐ জিনিসের তুলনায় খুবেই বেশি।'

সে সময়ে ইরানের জনগণ উত্তরে বলেন, খা'হেশ মিকোনামশোমা লোতফ দারিন অর্থাৎ অনুরোধ করছি। এটা আপনার বিনয়, নম্রতা! টাকাগুলো রাখুন। এই বলে তারা দোকানিকে টাকা পরিশোধ করেন। ভাবুনতো ভাড়া কিংবা পণ্যের মূল্য বিনিময়ে অর্থ নিতে গিয়েও ইরানিদের বিনয় কত উন্নত ধারার অথচ আমাদের দেশে...। যাক প্রাচীনতম নগরীর শিষ্টাচার রাষ্ট্র গরিয়ে সর্বময় ছড়িয়ে পরুক।

দেজে আলামুত। ইরানের কাযভিন প্রদেশ থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কেল্লাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৬৩ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। যার আয়তন ২০ হাজার বর্গমিটার। বিখ্যাত পর্যটক মার্ক পোলোর ভাষায় ইহা স্বর্গের নন্দন কানন। ৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে দিয়ালাম রাজবংশের আদদাই ইলায়ালহাক হাসান বিন যায়েদ এই কেল্লাটি নির্মাণ করেন। মার্ক পোলো এই কেল্লা সম্পর্কে বলেন, 'আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে যে খোদা আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়াকে এই স্বর্গে রেখেছেন, তবে আমি সেটা সত্য হিসাবে ধরে নেব!' এতো নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে এই আলামুত দুর্গটি কাযভিন ও কাম্পিয়ান সাগরের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। যার চারপাশে ধান আর গমের জমি। আঙুর, চেরি আর আখরোটের বাগানগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই কেল্লা পাহাড়ের একদিকে রয়েছে পাহাড়ি নদী রেজাই দাশত। তবে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে ঘুড়ি কিংবা লাটিমের মতো ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গে যাওয়ার মতো উপরে যেতে হবে। বাহন ঘোড়ার গাড়ি। বইটির লেখক এখানে উঠতে উঠতে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা বিড়বিড় করে আবৃত্তি করেছেন, 'পাতাল ফেড়ে নামবো নিচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে; বিশ্বজগত দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।' বইটিতে আলমুত কেল্লা বা দেজে আলমুতের বর্ণনা পড়ে আমারও কাজী নজরুলের এই কবিতার কথাই মনে হয়েছে।

ইরানে রয়েছে অদ্ভুত কিছু গ্রাম ও শহর। যেমন অন্ধদের গ্রাম। ইস! এতো সুন্দর একটি দেশ অথচ তার উত্তরে খোরাসান প্রদেশের ইসফারাইয়ান অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ অন্ধ হিসেবে জন্ম নেয়। জেনে ব্যথিত হলাম। আবার আনন্দিত হলাম ভারা'মিন শহর সম্পর্কে জেনে। যে গ্রামের কোনো দোকানে সিগারেট বিক্রি হয় না। আবার তাবরিয-এ কোনো ভিক্ষুক নেই। ভালোই লাগলো। পাশাপাশি নিজের দেশের পার্ক কিংবা মসজিদের গেটে ভিক্ষুকের বাড়িয়ে দেওয়া হাত চোখের সামনে যখন হাজির হলো তখন তারপরের পরিচ্ছেদ পারস্যে বিয়ে রীতি পড়বার আগ্রহ নিয়ে শুরু করলাম। পারস্যের বিয়ে অনেকটা বাংলাদেশের মতো তবে এখানে কনে দেখা থেকে বিয়ে পর্যন্ত সম্পর্ক গড়াতে প্রায় সাতটি স্তর পাড়ি দিতে হয়। আমি শুধু ভাবি এতো স্তর পাড়ি দিয়ে এরা বিয়ে করতে যায়! ধৈর্য অনেক। যাই হোক ইরানের বিয়েতে আমাদের দেশের মতোই গায়ে হলুদে গান গাওয়া হয়।

পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কাছে রমজান একটি পবিত্র মাস। ইরানেও এই মাসকে পবিত্রভাবে ভাবগাম্ভীর্যের সাথেই পালন করা হয়। ইরানের সিরজান অঞ্চলে সেহরীতে মানুষকে ডেকে দেওয়ার জন্য এক অভিনব প্রচলন আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেহেরীতে আমাদের দেশে যেমন মাইক দিয়ে উচ্চস্বরে জাগো জাগো বলে ডাকা হয়। ইরানে তার বদলে কর্তার গৃহের সামনে গিয়ে কর্তাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া হয় মজার মজার ছড়া। লেখকের ভাষায়- (ফার্সি থেকে অনুবাদ) ''ওহে বয়োজ্যেষ্ঠ  উঠুন সেহেরী খাই, খাই বরফ, চিনি  মিশ্রিত ফালুদা, আরতো সময় নাই।''

বইটি পাঠে যেমন সুখপাঠ্য, তেমনি তথ্যবহুল। প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইরানের  বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের পাশাপাশি লেখক ইরানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি কালচার, উৎসব সম্পর্কে যেভাবে বর্ণনা ধরেছেন, তা একজন সাধারণ মানুষের কাছে ইরানকে জীবন্ত ও প্রাণবন্তরুপে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বইটিকে পাঠকের মনজগতে দর্পন স্বরুপ উপস্থাপন করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি বইটির সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। যা দেখে একজন পাঠক সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত না থেকেও নিজেকে ইরানের মধ্যে আবিস্কার করতে পারবেন। তবে রঙিন ছবি হিসাবে ফটোগ্রাফগুলো যুক্ত করলে বইটির লেখনি মানের সাথে আরো সাদৃশ্যপূর্ণ ভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হতো।

ড. মুমিত আল রশিদ রচিত 'ইরানের পথে প্রান্তরে' দ্বিতীয় মুদ্রণ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ২০৮ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য ৩০০ টাকা। বইটির ISBN নাম্বার 978-984-95156-9-2

 

রিভিউ লেখক-

জাহানুর রহমান খোকন, সাবেক সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা, কুড়িগ্রাম। 

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৩

ট্যাগ