রক্তে ভেজা মিম্বর: আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ওপর ১৯৮১ সালের সন্ত্রাসী হামলা
-
তেহরানের বাহারলু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী (১৯৮১)
আশরাফুর রহমান: ১৯৮১ সালের ২৭ জুন, শুক্রবার। দক্ষিণ তেহরানের আবুজার মসজিদে যোহরের নামাজের পর মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন এবং উপস্থিত মুসল্লিদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী। তিনি তখন তেহরানের জুমা নামাযের খতিব, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনির প্রতিনিধি ও একজন সংসদ সদস্য। তাঁর কথাগুলো রেকর্ড হচ্ছিল কয়েকটি রেকর্ডারে। তবে মিম্বরে রাখা একটি রেকর্ডারে লুকানো ছিল বিস্ফোরক।
বেলা একটার দিকে হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। রক্তে ভিজে ওঠে মিম্বর, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন মাংসপিণ্ড; মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো মসজিদ, আকাশবিদারী আর্তনাদে কেঁপে ওঠে ভেতরের পরিবেশ। ইমাম খামেনেয়ী মারাত্মকভাবে আহত হন। উপস্থিত মুসল্লিরা আতঙ্কিত ও শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। অনেকের চোখে অশ্রু, কেউবা দোয়া করতে শুরু করেন।
চিকিৎসা ও সার্জারি:
অচেতন অবস্থায় ইমামকে মসজিদের বাইরে বের করে আনা হয়। তাঁকে প্রথমে নিকটস্থ ক্লিনিকে, তেহরানের পরে বাহারলু হাসপাতালে নেওয়া হয়। পথে একাধিকবার জ্ঞান ফিরে এলেও কিছু বলতে পারেননি— শুধু কালেমা শাহাদাত পাঠ করছিলেন।
চিকিৎসকদের নিরলস প্রচেষ্টা, একটি বড় অস্ত্রোপচার এবং ৩৭ ইউনিট রক্ত দেওয়ার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হয়। পরে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ‘শহীদ রাজায়ী হৃদরোগ হাসপাতাল’-এ পাঠানো হয়।
রক্তাক্ত দেহ, অটুট মনোবল
বিস্ফোরণে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ডান কাঁধ, বুক ও উরু ক্ষত-বিক্ষত হয়। কলারবোন ভেঙে যায়, ডান হাতের স্নায়ু ও রক্তনালী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরে তাঁর ডান হাতটি চিরদিনের জন্য প্রায় সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। তবে তাঁর মনোবল ছিল অটুট। ৯ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর তিনি পুনরায় রাজনীতির ময়দানে ফিরে আসেন এবং ১৭ আগস্ট থেকে সংসদ অধিবেশনেও নিয়মিত অংশগ্রহণ শুরু করেন।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও গণসমর্থন
হামলার পর পরই হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে জড়ো হয়। আয়াতুল্লাহ বেহেশতি, আয়াতুল্লাহ মুন্তাজেরি, প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী রাজায়ী, পার্লামেন্ট সদস্যবৃন্দ—সবাই একসাথে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। নেতৃবৃন্দ এটিকে ‘বিপ্লবের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখেন।
আল্লামা তাবাতাবায়ি, আয়াতুল্লাহ হাকিম এবং এমনকি ইরাক, লেবানন, পাকিস্তানের বহু আলেমগণও এ হামলার নিন্দা জানান। ইমাম খোমেনি নিজেও শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “আল্লাহ এই বিপ্লবী সন্তানকে আমাদের জন্য রক্ষা করেছেন।”
রাফসানজানির ডায়েরিতে সেই দিন
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাশেমি রাফসানজানি আবুজার মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে লিখেছেন: “আমি কয়লা খনি পরিদর্শনে যাচ্ছিলাম, তখন সারওয়ান সাজ্জাদি খবর দিলেন যে, খামেনেয়ীর ওপর হামলা হয়েছে, তবে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। বিস্ফোরক ভর্তি রেকর্ডার তাঁর মিম্বরের ওপর রাখা হয়েছিল। মুহূর্তে মনে হলো, যেন সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গীরা লক্ষ্য করলেন, আমি ভারসাম্য হারাচ্ছি। তখন সাজ্জাদি কিছু আশাব্যঞ্জক তথ্য দিয়ে আমাকে কিছুটা স্থির করলেন। এরপর বললাম— বনী-সাদরের অপসারণের পর নিরাপত্তার দিকে আরও মনোযোগী হওয়া দরকার ছিল।”
রাফসানজানি ওইদিনই রাত ৮টায় তেহরান ফিরে সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে খামেনেয়ীকে দেখতে যান।
ইমাম খামেনেয়ীর স্মৃতিচারণ
এই সন্ত্রাসী হামলার সবচেয়ে মানবিক ও গভীর অধ্যায় লুকিয়ে আছে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর নিজের মুখে বলা এক সাক্ষাৎকারে। এই বয়ান শুধু তাঁর শারীরিক কষ্ট নয়, বরং তাঁর আত্মিক উপলব্ধির এক জীবন্ত দলিল। তিনি বলেন:
"যখন মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটল, আমি প্রথমবার মাটিতে পড়ে যাই। বুঝতে পারিনি কীভাবে পড়লাম। এরপর জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত তিনবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরে পাই। প্রতিবার একেকরকম অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু একবার, আমি স্পষ্টভাবে অনুভব করলাম—মৃত্যু আমার সামনে। আমি যেন বারযাখের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে।
সেই মুহূর্তে বুঝলাম, একজন মানুষের কাছে আল্লাহ ছাড়া কোনো আশ্রয় থাকে না। কোনো কৃতিত্ব, কোনো আমল—কিছুই কাজে আসে না যদি আল্লাহর দয়া না মেলে। আমি ভেবেছিলাম, আমার আমলগুলো কি খালেস ছিল? লোক দেখানোর কিছু ছিল না তো?
আমরা তো ভুলে ভরা মানুষ, আমাদের নিয়ত সবসময় পরিশুদ্ধ থাকে না। তখন আমি যেন আকাশ ও মাটির মাঝে এক টুকরো খড়, দিকহীন, সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন। সেই বিচ্ছিন্নতার মুহূর্তে আমি আল্লাহর কাছে বলেছিলাম, ‘হে প্রভু, আপনি জানেন আমি কতটা শূন্য। আপনার করুণা ছাড়া আমার কোনো ভরসা নেই।’
আমি মৃত্যুকামনা করিনি, কিন্তু ভয় করছিলাম যেন সৌভাগ্যের পথ থেকে ছিটকে না পড়ি। এরপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।”

মুজাহিদিন-ই খালক ও সন্ত্রাসের ছায়া
ঘটনার দায় অস্বীকার করেছিল সন্ত্রাসী সংগঠন মুজাহিদিন-ই খালক, তাদের দাবি ছিল: “এই বিস্ফোরণ ফোরকান গ্রুপের কাজ, আমাদের নয়।”
তবে রেকর্ডারের অভ্যন্তরে পাওয়া যায় এক বার্তা: “ফোরকান গ্রুপের উপহার”— এভাবে মার্কার পেনে লেখা ছিল এবং তাদের স্বাক্ষরসহ একটি পুস্তিকাও প্রচার করা হয়েছিল।
তবে জনমতের বিচারে মুজাহিদিন-ই খালকই ছিল মূল সন্দেহভাজন। সংবাদমাধ্যমগুলোও সেই ধারণাকেই প্রতিফলিত করেছিল। বিশেষ করে, খামেনেয়ীকে হত্যাচেষ্টার পরদিনই ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পার্টির সদর দফতরে মুজাহিদিন-ই খালকের আরেকটি সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। সেই ঘটনায় শহীদ হন প্রধান বিচারপতি সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ হোসেইনি বেহেশতিসহ ৭২ জন বিপ্লবী নেতা। এ দুটি হামলার পেছনে কারা ছিল তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ফোরকানপন্থিদের কিছু গুপ্ত-সদস্য তখনও সক্রিয় ছিল এবং তারা মুজাহিদিন-ই খালক-এর সন্ত্রাসকে আদর্শিক কাঠামোতে ব্যবহার করছিল।

একটি বিস্ফোরণ, এক আত্মিক জাগরণ
চার দশক পেরিয়ে গেলেও সেই রক্তাক্ত শুক্রবারটি কেবল একটি সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহ স্মৃতি নয়—বরং এক বিপ্লবীর আত্মিক জাগরণের অমর দলিল হয়ে আছে। মিম্বরে রক্ত ঝরেছিল, তাঁর শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল, কিন্তু মনোবল বিন্দুমাত্র ভাঙেনি। বরং সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই গড়ে উঠেছিল আরও দৃঢ়চেতা, আরও অন্তর্দর্শী এক খামেনেয়ী—যিনি মৃত্যুর প্রান্তসীমা ছুঁয়ে এসে উপলব্ধি করেছিলেন জীবনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, নির্ভর করেছিলেন কেবল আল্লাহর ওপর।
মৃত্যুর প্রান্তসীমা থেকে ফিরে আসা সেই মানুষটি মাত্র তিন মাস পর, ১৯৮১ সালের ২ অক্টোবর ইরানের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮১–১৯৮৯ সাল পর্যন্ত।
১৯৮৯ সালের ৪ জুন, ইমাম খোমেনির ইন্তেকালের পর খামেনেয়ী নির্বাচিত হন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা—যা তিন যুগ ধরে দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন তিনি।#
লেখক: রেডিও তেহরান বাংলা বিভাগের সিনিয়র সাংবাদিক
পার্সটুডে/এমএআর/৩০