নাম পরিবর্তনের হিড়িক! এর পিছনে কী উদ্দেশ্য?
দেশবাসীকে ভালো রাখতে নাম পরিবর্তনের দরকার হয় না: ড. শেখ কামাল উদ্দীন
ভারতে বিভিন্ন জনপদ, রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদির নাম বদলের যে ধারাবাহিকতা চলছে সেই তালিকায় এবার হায়দরাবাদের নাম যুক্ত হয়েছে।
সম্প্রতি তেলেঙ্গানায় এক নির্বাচনি সভায় বক্তব্য রাখার সময়ে ঐতিহ্যবাহী ‘হায়দরাবাদ’ শহরের নাম ‘ভাগ্যনগর’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ফায়ারব্রান্ড নেতা যোগী আদিত্যনাথ। তিনি ‘মেহবুব নগর’-এর নাম ‘পালামুরু’ করা হবে বলেও ঘোষণা করেছেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে।
ওই ইস্যুতে আজ (মঙ্গলবার) পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ড. শেখ কামাল উদ্দীন রেডিও তেহরানকে বলেন, ‘ছিল মুঘলসরাই। হয়ে গেল পন্ডিত দীন দয়াল উপাধ্যায় জংশন! এই পরিবর্তন করলো বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকার। নাম পরিবর্তনে কি হলো? আরও বেশি ট্রেন চলাচল করছে ওই স্টেশনের উপর দিয়ে? আরও বেশি মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন থামছে ওই স্টেশনে? এমন খবর কিন্তু নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে তা’হলে কেন এই নাম পরিবর্তন? স্টেশনগুলোর নাম না পরিবর্তন করে যাত্রীদের সুরক্ষিত যাতায়াতের দিকে সরকার নজর দিক। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৭৫ সালে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগ শহরে একটি দুর্গ নির্মাণ করে তার নাম দেন ইলাহাবাদ। কিছুদিন আগে সেই জায়গার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় প্রয়াগরাজ।’
তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ভবনের বিখ্যাত মুঘল গার্ডেনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো অমৃত উদ্যান। আচ্ছা, একটি সরকারের কী কাজ স্টেশন, জনপদ, উদ্যানের নাম পরিবর্তন করা? মুঘল গার্ডেনে যে গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ফুটতো সেগুলোর নামও কী এখন থেকে পাল্টে যাবে? যদি না যায় তবে কেন এই নাম পরিবর্তনের হিড়িক! এর পিছনে কী উদ্দেশ্য? নতুন প্রজন্মকে কি ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নিহিত রয়েছে এই নাম পরিবর্তনের পিছনে? নাকি আরও গভীর কোনো ষড়যন্ত্র!’
ড.শেখ কামাল উদ্দীন বলেন,‘হোশঙ্গাবাদ পরিবর্তন করে করা হয়েছে নর্মদাপুরম। আওরঙ্গাবাদ হয়েছে সম্ভাজিনগর। উসমানাবাদ থেকে ধারাশিব হয়েছে। এবারের স্বাধীনতা দিবসের আগে পর্যন্ত নাম ছিল নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি। হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি। কারণ হিসেবে বলা হল, কোনো ব্যক্তিবিশেষের নামে নয়, প্রধানমন্ত্রীর নামেই মিউজিয়াম হোক। বেশ ভালো কথা। তবে মুঘলসরাই স্টেশনের নাম ব্যক্তিবিশেষের নামে কেন রাখা হল? কিংবা গার্ডেনরিচ বন্দরের নাম কেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নামে? ব্যক্তি বিশেষের নামে যদি নামকরণ করতে না হয়, সেটি যদি উদ্দেশ্য না হয় তাহলে পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নামকরণ নরেন্দ্র মোদীর নামে কেন? প্রয়াত, বিশ্ববরেণ্য, সফল ভারতীয় কোনো ক্রিকেটারের নামে কী করা যেত না? কোনওদিন হয়তো শুনবো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস কথাটা বাদ দিয়ে দেওয়া হবে।’
তেলেঙ্গানায় নাম পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি তেলেঙ্গানা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে, নাম পরিবর্তনের অন্যতম কান্ডারী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছেন তারা ক্ষমতায় এলে তেলেঙ্গানার বহু বিখ্যাত জায়গার নাম পরিবর্তন করবেন। আর ‘মিম’-এর সর্বময়কর্তা ব্যারিস্টার আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এমপি জানিয়েছেন, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর তেলেঙ্গানের বিভিন্ন স্থানের নাম পরিবর্তন করার যে স্বপ্ন তা স্বপ্নই থেকে যাবে, কোনদিনই সত্যে পরিণত হবে না। আবার এই ওয়াইসি সম্পর্কেই বলা হয়, তিনি বহু জায়গায় প্রার্থী দিয়ে সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ কেটে নিয়ে বিজেপিকেই ক্ষমতায় আসতে সুবিধা করে দিচ্ছেন! নাম পরিবর্তন নিয়ে দুই রাজনীতিবিদের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আসলে সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগির কোনো কৌশল নয় তো!’
ড. শেখ কামাল উদ্দীন আরও বলেন, ‘নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় দরকারে। কেন নাম পরিবর্তন তা পরিষ্কার করে বলা হোক, জনমত নেওয়া হোক। তা না হ’লে যে দৃষ্টান্ত এই সরকার স্থাপন করছেন, সরকার পরিবর্তন হলে আবার পুরনো নামকরণ করা হবে না তো! এই বারবার নামকরণের ফলে যে সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ ব্যয় হয় তা তো সাধারণের করের অর্থ। সেই অর্থ ব্যয় করতে হলে সাধারণের মতামত নেওয়া হবে না কেন?
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ একটি সরকারি হাসপাতাল তৈরি করা হোক যেখানে বিনামূল্যে গরিবরা চিকিৎসা পরিসেবা পেতে পারেন। সেই হাসপাতালের নামকরণ সরকার তাদের ইচ্ছেমতো করুন। শুধু বিনামূল্যে রেশন দেওয়াই নয়, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা পরিসেবা দেওয়া জরুরী। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা প্রায় উঠে যাওয়ার শামিল হয়েছে। বহু জায়গায় ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বজায় থাকছে না।তাই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কোনো বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হোক, যেখানে বিনামূল্যে ভারতবাসী পড়াশোনা করার সুযোগ পাবেন। সেই কবে ইংরেজ কবি শেক্সপিয়ার বলে গিয়েছিলেন যে, নামে কী আসে যায়! গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা সব সময় সুন্দর। যদি দেশকে সুন্দর রাখতে হয়, দেশবাসীকে ভালো রাখতে হয় তাহলে জনপদের নাম পরিবর্তনের দরকার পড়ে না। দরকার শাসকের মনোভাব পরিবর্তনের। তা তো চোখে পড়ছে না’ বলেও মন্তব্য করেন পশ্চিমবঙ্গের হিঙ্গলগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ ড. শেখ কামাল উদ্দীন।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/জিএআর/২৮