ইরানে বসবাসের জন্য আমরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ: বিশিষ্ট সুন্নি ইমাম
ইরানে সুন্নিদের অবস্থা সম্পর্কে তালেবানের অভিযোগ ও বাস্তবতা
সম্প্রতি আফগানিস্তানের তোলো নিউজ চ্যানেলে সেদেশে তালেবানের সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের একজন সদস্য শাহাব লিওয়ালের একটি সাক্ষাতকার প্রচারিত হয়েছে। এতে তিনি দাবি করেছেন ইরানের শাসন ক্ষমতায় সুন্নি মুসলমানদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। তবে তার এ বক্তব্য অজ্ঞতাপ্রসূত বলে মনে করা হচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।
ইসলামি ইরানে সুন্নি মুসলমানদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে হলে দেশটির সংবিধানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। কেননা সংবিধানেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়া আছে। সংবিধানের ১২ তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী 'ইরানের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম এবং মাযহাব হবে জাফরী, ১২ ইমামি; এই অনুচ্ছেদটি আবহমানকালের জন্য অপরিবর্তনীয়, ইসলামের অন্যান্য মাযহাব-হানাফি, শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী ও যাইদী পূর্ণ মর্যাদা লাভ করবে এবং এই মাযহাবসমূহের অনুসারীগণ তাদের নিজস্ব ফিকাহ্ অনুযায়ী স্বাধীনভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে এবং তাদের ধর্মীয় শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার এবং এ সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা আদালত কর্তৃক অনুমোদনের যোগ্য বিবেচিত হবে। কোনো অঞ্চলে যদি উপরে বর্ণিত কোনো মাযহাবের অনুসারীগন সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় তাহলে আঞ্চলিক নিয়মকানুন বা স্থানীয় পরিষদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়বে ওই মাযহাব অনুযায়ী হবে, তবে অন্যান্য মাযহাবের অনুসারীদের অধিকারও সংরক্ষণ করা হবে।'
ইরানের কেরমান প্রদেশের দক্ষিণে অবস্থিত মানুজান এলাকার সুন্নি মুসলমানদের জুমার নামাজের ইমাম মৌলভি মোহাম্মদ পেইকারদাদ যেহি সংখ্যালঘুদের অবস্থান সম্পর্কে বলেছেন, 'আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই যে আমরা ইরানের মতো একটি দেশে বসবাস করি। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে ইরান সমগ্র মুসলিম দেশ এমনকি অমুসলিম জাতিগুলোর জন্যও উদাহরণ হয়ে আছে।'
ইরানের সংবিধানের নীতিমালা এবং দেশটির সকল মাজহাবের অনুসারীদের সাথে দেশটির সরকারের আচরণ ও কার্যকলাপ থেকে বোঝা যায় ইসলামি ইরান সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে খুবই সচেতন ও যত্নশীল। এ কারণে ইরানে মুসলমানদের অন্য মাজহাবের অনুসারীদের নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রয়েছে।
ইরানের সানান্দায ইসলামি কেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তা মামুস্তা ইকবাল বেফাহমি বলেছেন, 'সত্যিকারের সুন্নি মুসলমানরা পবিত্র কোরআন শরীফ ও বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ(সা.)এর সঠিক অনুসারী এবং শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ বা সমস্যা নেই। মুসলমানরা যে মাজহাবেরই হোক না কেন ধর্মীয় বিষয়ে তাদের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। এমন কিছু অভিন্ন দিক রয়েছে যা শক্তিশালী মুসলিম উম্মার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।'
ইরানের সংবিধানের ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'সকল অনুমোদিত দল, সমাজ, রাজনৈতিক বা পেশাদারী ইউনিয়ন, ইসলামি বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগঠন এই শর্তে স্বাধীনভাবে তৎপরতা চালাতে পারবে যে, তারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় ঐক্য, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বুনিয়াদ এবং ইসলামি নীতিমালা লঙ্ঘন করবে না। এসব সংগঠনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না, আবার অংশ গ্রহণের জন্য কাউকে বাধ্যও করা যাবে না।'
এ ছাড়া সংবিধানের ৬৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে জাতীয় সংসদে ইসলামের অন্য মাজহাবের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতে পারবেন। ইরানের সংবিধানের ১৯ ও ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে জাতি, গোত্র নির্বিশেষে সকল জনগণের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং তারা ইসলামি বিধান অনুসারে মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার লাভ করবে।
ইরানে সুন্নিদের হাজার হাজার ছোট-বড় মসজিদ এবং তাদের নিজস্ব ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্র বা মাদ্রাসা রয়েছে। এ ছাড়া হাজার হাজার সুন্নি ধর্মীয় নেতা বা আলেম রয়েছেন ইরানে। এ থেকে বোঝা যায় ইসলামি ইরানের শাসন ব্যবস্থায় সুন্নি মুসলিম সমাজের বিশেষ অবস্থান রয়েছে। অর্থাৎ তারা সব রকম নাগরিক সুযোগ সুবিধা ও স্বাধীনতা ভোগ করছেন।
বর্তমানে শুধু যে ইরানের সংসদ মজলিশে শুরায়ে ইসলামিতে সুন্নি মুসলিমদের প্রতিনিধি রয়েছে তাই নয় এমনকি ইরানের গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞ পরিষদেও তাদের প্রতিনিধি রয়েছে। এ ছাড়া, ইরানের নৌবাহিনীসহ দেশটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সুন্নি মুসলমানদের উপস্থিতি রয়েছে এবং তারা দেশের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। ইরানের পভে উপশহরের জুমার নামাজের খতিব মামুস্তা হাজ মোল্লা কাদেরি মনে করেন, কেরমানশাহ, কুর্দিস্তান ও বেলুচিস্তানসহ আরো অন্যান্য এলাকার সুন্নি জনগণ, স্থানীয় জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রয়েছে এবং এ সম্পর্ক দিন দিন জোরদার হচ্ছে যার অর্থ হচ্ছে ঐক্য ও সংহতি আরো বেশি মজবুত হচ্ছে।
ইরানে শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাদের মধ্যে ঐক্য বজায় রয়েছে। বর্তমানে ইরানের সুন্নি মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রম মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণে ইসরাইলের প্রভাবিত গণমাধ্যমগুলো অজ্ঞাত ও বিভ্রান্ত কিছু ব্যক্তির সাক্ষাতকার প্রচারের মাধ্যমে ইরান সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বে নেতিবাচক ধারণা তৈরির চেষ্টা করছে। তারা এমন সব ব্যক্তির বক্তব্য তুলে ধরছে যাদের সমাজ ও ধর্মীয় বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই এমনকি মুসলিম বিশ্বের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও তাদের পরিপূর্ণ ধারণা নেই। ইরানের বজনুর্দ শহরের খাতামুল আম্বিয়া মসজিদের ইমাম অখুন্দ আতা দাউদি বলেছেন, ইসলামি বিপ্লবের স্থপতি মরহুম ইমাম খোমেনি শিয়া ও সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে গেছেন। তাই বিকৃত চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ কিংবা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে এমন যে কোনো কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার দায়িত্ব শিয়া ও সুন্নি ধর্মীয় নেতাদের ওপর বর্তায়।
যাইহোক, রাজধানী তেহরান ও এর আশেপাশে সুন্নি মুসলমানদের মোট নয়টি মসজিদ রয়েছে এবং সমগ্র ইরানে সুন্নিদের মসজিদের সংখ্যা ১৭ হাজার। প্রতি বছর প্রায় ২ শতাংশ পরিমাণ মসজিদের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া রাজধানীসহ অন্যান্য শহরগুলোতে অফিসিয়াল সমস্ত কার্যক্রমে শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা একে অপরকে সহযোগিতা করায় বিশ্ব ইহুদিবাদী চক্র প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ এবং তারা যে কোনো উপায়ে ইরানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে। যদিও সবার সচেতনতার কারণে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।