ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৪৩ বছর: বাংলাদেশি শ্রোতার দৃষ্টিভঙ্গি
(last modified Fri, 11 Feb 2022 12:19:45 GMT )
ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২২ ১৮:১৯ Asia/Dhaka
  • আবু তাহের
    আবু তাহের

মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইরান যার হাতে পৃথিবীর মোট তেল সম্পদের ১১% রয়েছে। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক দেশটির তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করতে চাইলে ১৯৫৩ সালে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সহযোগিতায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাহলভী বংশের শাসনব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা হয়।

পাহলভী বংশের দুঃশাসন নিয়ে কথা বলার মত কেউ ছিল না এবং যারা কথা বলত তাদের গোপন পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করা হতো। এমন পরিস্থিতিতে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইরাকে নির্বাসিত হন এবং সেখানে ১৫ বছর অতিবাহিত করেন। এই সুযোগে ইসলামি ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর দেশটি ইসলামি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রাধান্য পায়। এছাড়াও দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট ও পরিলক্ষিত হচ্ছিল এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটছিল। সংস্কৃতিগত অবক্ষয়ে ধর্মপ্রাণ ইরানি মুসলমানদের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তেহরানে শাহবিরোধী এক বিশাল সমাবেশ হয় এবং সেখানে গুলি করে কয়েকশ মানুষকে হত্যা করা হয়।

বিক্ষোভের মুখে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি দেশত্যাগ করে মিশরে আশ্রয় লাভ করেন। তখন আয়াতুল্লাহ খোমেনী (রহ) ছিলেন দেশটির ধর্মীয় নেতা যিনি প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন এবং ১৯৭৮ সালে তিনি ইরাকের নাজাফে নির্বাসিত ছিলেন। পরে ইরাক থেকে বিতাড়িত করা হলে তিনি ফ্রান্সে আশ্রয় নেন এবং পরে ইরানের ইসলামি  বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৫ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরেন। দেশে ফিরেই ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিপ্লবের প্রধান নেতা হিসেবে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম খোমেনী। এরপর থেকেই ১১ ফেব্রুয়ারিকে ইরানের ইসলামি বিপ্লব দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে ফ্রান্সের ফরাসি বিপ্লব ও রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের পর তৃতীয় মহান বিপ্লব হিসেবে ধরা হয়।

রেজা শাহ পাহলভি মিশর থেকে আমেরিকায় চিকিৎসা নিতে গেলে তেহরানে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ হিসেবে ৫২জন আমেরিকানকে জিম্মি করে এবং ৪৪৪ দিন পর তাদের মুক্তি দেওয়া হলেও ইরানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অন্যায় অবরোধ। কারণ ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল পাশ্চাত্য বিশ্বের জন্য হুমকি। বিপ্লবের ১ বছরের মধ্যেই আবার আমেরিকার পরোক্ষ সহযোগিতায় ইরান-ইরাক যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং দীর্ঘ সময় পর তা শান্তি আলোচনার মাধ্যমে শেষ হয়। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরেও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উন্নয়ন ও অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। মহাকাশে উপগ্রহবাহী রকেট প্রেরণ, ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বহির্বিশ্বে তেল রপ্তানি প্রভৃতি ঘটনা আমেরিকার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে ইরান এখন বিশ্বের প্রথম সারির চারটি দেশের অন্তর্ভুক্ত। পরিসংখ্যান বলছে- ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী দেশটি বিশ্বের আঠারতম অর্থনীতির দেশ এবং তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের অন্যতম সফল স্টক এক্সচেঞ্জ।

ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন যথেষ্ট প্রশংসনীয়। ২০২০ সালের মানব সূচক অনুযায়ী ১৮৭ দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান ৭৫তম। দেশটি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিজ্ঞান, গবেষণা, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করেছে। করোনা মহামারীতে দেশটি নিজ দেশে উৎপাদিত করোনার টিকা সফলতার সাথে প্রয়োগ করেছে।

ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে দেশটির জিডিপিতে অবস্থান ১৮তম, মাথাপিছু আয় ১৯,৩৭৭ ডলার, দেশটির প্রধানশিল্প হচ্ছে পেট্রোলিয়াম, সার, গাড়ি উৎপাদন, ফার্মাসিউটিক্যালস, যন্ত্রাংশ, টেলিযোগাযোগ, অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী, ভেষজ তেল উৎপাদন। দেশটি তার উৎপাদিত পণ্যের বিশাল একটা অংশ চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, জাপানে রপ্তানি করে এবং দেশটির জিডিপির পরিমাণ ৪৪৬.১০৫ বিলিয়ন ডলার।

ইরানের উপর ক্রমাগত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত যখন থেকে হয়েছে তখন থেকেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে। অর্থাৎ ৪৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশটিতে নিষেধাজ্ঞাও ৪৩ বছরে পড়ে গেছে। কিন্তু দেশটির জীবন যাত্রার মান যেভাবে বেড়েছে এবং অর্থনীতি, সামরিক, রাজনীতি, সামাজিক উন্নয়নের দিক দিয়ে যেভাবে এগিয়ে চলেছে এবং ইসলামি বিপ্লবকে মজবুত করেছে সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য রীতিমতো ভয়ংকর।

আবু তাহের

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

ট্যাগ