অ্যালেন ডেলন কীভাবে ইরানের একটি প্রজন্মের স্মৃতিতে স্থান করে নিয়েছেন?
পার্সটুডে- সদ্য প্রয়াত ফরাসি অভিনেতা অ্যালেন ডেলন ইরানি জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ইরানিরা পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি বন্ধুমহলে একত্রিত হলেই ঠাট্টা মশকরা করে পরস্পরের চেহারা ও বেশভূষাকে অ্যালেন ডেলনের সঙ্গে তুলনা করতেন।
অ্যালেন ডেলন গত ১৮ আগস্ট ফ্রান্সের ডুচিতে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে ইরানি পত্রিকা জাওয়ানে মোহাম্মাদ তাবরিজির লেখা একটি কলাম প্রকাশিত হয়েছে। ওই কলামের বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে:
ইরানি জনগণের কাছে অ্যালেন ডেলন ছিলেন একজন বিশিষ্ট অভিনেতা ও ব্যক্তিত্ব। বিদেশি অন্য কোনো অভিনেতা সম্পর্কে ইরানি মহলে এত বেশি আলোচনা হয়নি। এমনকি এই অভিনেতার নামটি ইরানের অলি-গলি ও বাজারে ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতো। কোনো তরুণ বা যুবক বেশভূষায় নায়কসুলভ আচরণ করলেই তাকে ঠাট্টা করে সবাই বলত: “আমাদের অ্যালেন ডেলন এসে গেছে।”
প্রশ্ন হচ্ছে, ইরানি জনগণের মধ্যে অ্যালেন ডেলন কেন এতটা পরিচিতি পেয়েছিলেন? ৮৮ বছর বয়সে তার মৃত্যুর খবরটিই বা কেন ইরানে এতটা গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হলো?
প্রথমত, এই ফরাসি অভিনেতার বহু সিনেমা ইরানি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। তিনি যুবক বয়সে অভিনয় জীবনে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন এবং পুলিশ কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা চরিত্রে তার অভিনয়ের জুড়ি ছিল না। ডেলনের অভিনিত সামুরাই, সিসিলিয়ান বাঞ্চ ও রেড সার্কেলের মতো সিনেমাগুলি ইরানের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বহুবার প্রচারিত হয়েছে।
যে যুগে ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়নি এবং মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল টেলিভিশন সে সময় ইরানি চ্যানেলগুলোতে এসব সিনেমা প্রচারিত হওয়ার ফলে এদেশের মানুষ ডেলনের ব্যাপক ভক্তে পরিণত হয়। তার আকর্ষণীয় চেহারা ও ব্যক্তিত্ব বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মতো ইরানি জনগণেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
ডেলন এমন এক প্রজন্মের অভিনেতা ছিলেন যখন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের অভিনয়ের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিলেন। এ যুগের অভিনয়শিল্পীদের মতো অদ্ভুত ও কিম্ভুতকিমাকার সব কাজকর্ম করে তারা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতেন না। তারা যেমন ছিলেন ঠিক তেমন করে নিজেদের ফুটিয়ে তুলতেন এবং তাদের সেই বাস্তব জীবন দর্শকদের বিমুগ্ধ করত। ১৯৬০, ৭০ ও ৮০’র দশক ছিল অ্যালেন ডেলনের অভিনয় জীবনের সোনালী যুগ এবং সে যুগের অভিনয় শিল্পীদের সঙ্গে বর্তমান অভিনয় শিল্পীদের আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইরানি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যত বিদেশি সিনেমা দেখানো হোক না কেন তার প্রত্যেকটি ফার্সি ভাষায় ডাবিং করে দেখানো হয়। অ্যালেন ডোলেনের অভিনিত সিনেমাগুলোর ডাবিংয়ে তার সংলাপগুলোতে নিয়মিত কণ্ঠ দিয়েছেন বিখ্যাত ইরানি কণ্ঠশিল্পী খসরু খসরুশাহি। খসরুশাহির কণ্ঠ অ্যালেন ডেলনের চেহারার সঙ্গে এতটা মিলে গিয়েছিল যে, ইরানিরা রাস্তাঘাটে এই ইরানি কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠ নকল করার চেষ্টা করত। কিন্তু ইরানি দর্শকদের কাছে খসরুশাহির কণ্ঠটি অতি পরিচিত হলেও তাকে চেহারা দেখে কেউ চিনত না।
বিষয়টি এতটা সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল যে, এ নিয়ে খসরুশাহি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একবার বলেন যে, তেহরানের একটি সড়কে একবার তিনি গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি গাড়ির সঙ্গে তার গাড়ির সংঘর্ষ হয়। খসরুশাহি গাড়ি থেকে নেমে অন্য গাড়ির লোকটির সঙ্গে কথা বলেন। তার কণ্ঠটি ওই ব্যক্তির কাছে অ্যালেন ডেলনের কণ্ঠের মতো মনে হয় এবং তিনি ভীষণ রেগে যান। তিনি খসরুশাহিকে বলেন: “আমার গাড়িটার তো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো। আবার অ্যালেন ডেলনের ডায়লগও মারছো?!!!”
১৯৬০, ৭০ ও ৮০’র দশকে জন্মগ্রহণকারী বহু ইরানির জীবনে ডেলনকে নিয়ে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। ডেলন ছিলেন এমন একজন অভিনেতা যাকে সবাই ভালোবাসত এবং এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে যে তার প্রতি কোনো কারণে ক্ষুব্ধ ছিল। তার মৃত্যুতে বিশ্বের চলচ্চিত্র জগত একজন ক্লাসিক ও কিংবদন্তি অভিনেতাকে হারাল। এমন একজন বিশ্বখ্যাত অভিনেতা চিরতরে হারিয়ে গেলেন বর্তমান যুগে যার জুড়ি মেলা ভার। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এমএআর/২০